বাংলাদেশ-ভারতের জলধারা ও কবিতাকৃতিতে জ্যোতি বসু

বিশাল ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবস ২৬ জানুয়ারি। এই জানুয়ারি মাসের ১২ তারিখে জন্ম স্বামী বিবেকানন্দের। ২৩ জানুয়ারি জন্ম নেতাজি সুভাষ বসুর। আর ১৭ জানুয়ারি দেহাবসান হয় বাংলাদেশ-বান্ধব রাজনীতিক জ্যোতি বসুর। ইংরেজি পঞ্জিকার সূচনা-মাসটিতে রয়েছে স্মৃতিপ্রদ নানা ইতিহাস। প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির অঙ্ক নিয়েও রয়েছে প্রামাণ্য পর্যালোচনা।
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের জলবণ্টন সমস্যা নিয়ে বিতর্ক দীর্ঘকালীন। ৫৪টি আন্তর্জাতিক নদীর মধ্যে চুক্তির মাধ্যমে সমাধান হয়েছে মাত্র একটির। সেটি গঙ্গা/ভগীরথী বাহিত ফারাক্কা বাঁধ-সংক্রান্ত। এ জলপ্রবাহ নিয়ে প্রথম কার্যকর চুক্তিটি হয় ১৯৭৭ সালে। তখন বাংলাদেশে জিয়াউর রহমান, বীরোত্তম সরকার প্রধান। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন জোট সরকারের মোরারজী দেশাই। শেষ চুক্তিটি ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে সম্পাদিত। তখন বাংলাদেশের সরকার-প্রধান ছিলেন শেখ হাসিনা। আর ভারতের দ্বাদশতম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এইচ ডি (হারাদানাহাল্লি দোদ্দেগৌড়া) দেবগৌড়া। ৩০ বছর মেয়াদের এই চুক্তিটি চলমান। ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষরে দুজন ভারতীয় ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী আইপি গুজরাল। অন্যজন পশ্চিমবঙ্গের দীর্ঘমেয়াদি মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু।
একটানা ২৩ বছর ক্ষমতায় ছিলেন জ্যোতি বসু। ১৯৭৭ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত। সিপিআই (এম) তথা কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন। জন্ম ১৯১৪ সালের ৮ জুলাই, অবিভক্ত ভারতে। দেহাবসান ২০১০ সালের ১৭ জানুয়ারি, কলকাতায়। পৈতৃক বাস ছিল বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জ জেলার বারদিতে। শৈশবের অনেকটা সময় সোনারগাঁয়ের বারদিতেই কাটে। বাবা নিশিকান্ত বসু ছিলেন পেশায় চিকিৎসক। তাঁর ছিল রাজনীতিমুক্ত জীবন; তবে ব্রিটিশবিরোধীদের প্রশ্রয় দিতেন। বারদির বাড়িতে বিপ্লবীরা অস্ত্রসহ আশ্রয় নিত। পুলিশের থানা তল্লাশির সময়ে বিশেষ ঘটনা ঘটে। মা হেমলতা বসু শাড়ির আঁচলে অস্ত্র লুকিয়ে রাখতেন। সেই দৃশ্য কিশোর জ্যোতিকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। দেশপ্রেম বা রাজনীতির প্রথম চিন্তা তখন থেকেই। পরে ব্রিটেনে আইন শাস্ত্র পড়তে গিয়ে ঘুরে দাঁড়ান। রাজনীতিকেই প্রাধান্য দিয়ে নির্ধারণ করেন জীবনের গতিপথ।
ক্ষমতায় থাকাকালে একাধিকবার সফর করেন বাংলাদেশ। নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁ উপজেলার বারদিতেও পদধূলি দিতেন। পৈতৃক বসত হিসেবে বাড়িটির মালিকানা তাঁদেরই ছিল। শৈশবের স্মৃতি কুড়োতে বাড়িটিতে পা রাখতেন। নিকটাত্মীয়কে রেখেছিলেন ‘কেয়ার টেকার’ হিসেবে। কলকাতা থেকে নিয়মিত তদারকি করতেন বাড়ি ও এলাকাবাসীর।
বাংলাদেশে জেনারেল এরশাদের শাসন চলে প্রায় নয় বছর; ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর। এই সময়কালে জ্যোতি বসুর সফর ছিল আলোচিত। ১৯৮৭ সালে ঢাকা সফরকালে ‘বাংলা একাডেমি’ পরিদর্শন করেন। কলকাতাস্থ ‘বাংলা আকাদেমি’ সাজাতে অভিজ্ঞতা নেন। কবি-গীতিকার ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল ছিলেন সে সময় মহাপরিচালক। পরিদর্শনকালে গুরুত্ব পায় ‘লোক-ঐতিহ্য সংগ্রহশালা’। তৎকালীন পরিচালক শামসুজ্জামান খান ও বশীর-আল-হেলাল তাঁকে সঙ্গ দেন। এরপরও জ্যোতি বসু বাংলাদেশ ঘুরে গিয়েছেন। এরশাদ শাসনামলে ওনার সহযোগিতা একান্ত প্রত্যাশিত ছিল। ১৯৮০ সালের প্রবল বন্যায় বাংলাদেশ অনেকাংশেই ডুবে যায়। ভারতের বাংলাদেশমুখী নদীগুলোর বাঁধ খুলে দেওয়া হয়। সবচে বড় সমস্যা ছিল ফারাক্কা বাঁধ নিয়ে। ১৯৮৫-৮৮ সাল পর্যন্ত জলবণ্টন চুক্তি বহাল ছিল। এরপর আর দীর্ঘমেয়াদি কোনো সমঝোতা সম্ভবপর হয়নি। ফলে, নদ-নদীর পানিপ্রবাহ নিয়ে সৃষ্টি হয় অচলাবস্থা। ব্যাপক বন্যার পরই আসে খরাযুক্ত শুষ্ক-মৌসুম। ১৯৮৯ সালে ভারত একতরফাভাবে গঙ্গার পানি প্রত্যাহার করে। ভগীরথী-হুগলি নদীতে স্থানান্তরিত হয় ফারাক্কার জলরাশি। ফলে বাংলাদেশের নদ-নদীতে পানি প্রবাহের অবনতি ঘটে।
জল প্রাপ্তির আকুলতা নিয়ে সে সময় দীর্ঘ কবিতা লিখেছিলাম আমি। সে কবিতা প্রথম প্রকাশিত হয় সর্বাধিক প্রচারিত সাপ্তাহিকী ‘সন্দ্বীপ’-এ। সম্ভবত ১৯৮৯ সালের জুলাই মাসের শুরুতে। ৮ জুলাই ছিল জ্যোতি বসুর ৭৫তম জন্মদিন। বিশেষ প্রতিবেদনের সঙ্গে ছিল ‘নিবেদিত পদ্য’টি। শিরোনাম ছিল ‘আয়রে আমার ছায়া-জ্যোতি’। বিশেষ আলোড়ন তোলে কল্যাণকামী পদাবলিটি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেটি সংগ্রহ করে কলকাতা পাঠায়। প্রেসিডেন্ট এরশাদের শ্যালক জাহাঙ্গীর মহিউদ্দিনও গুরুত্ব দেন বিষয়টিকে। তিনি তখন জাতিসংঘে রাষ্ট্রদূত, স্থায়ী প্রতিনিধি। কূটনৈতিক মেইলে ‘সন্দ্বীপ’-এর সংখ্যাটি সংগ্রহ করেন। কবিতাটির সূত্র ধরে নিভৃতে নানান উদ্যোগ চলে। মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে প্রভাবিত করার চেষ্টাও চলছিল। কিন্তু ভারত সরকার অনেকটা মুখ ফিরিয়ে রেখেছিল। ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করায় বিতর্ক ওঠে। মধ্যপ্রাচ্যে সৈন্য পাঠানো নিয়ে ঘটে কূটনৈতিক বিপর্যয়। এরশাদ সরকারকে আস্থায় নিতে পারছিল না ভারত। অবশেষে ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে রাজ-বিদায়।
১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে শেষ হাসি হাসলেন শেখ হাসিনা। ৩০ বছর মেয়াদি পানি চুক্তি হলো ভারতের সঙ্গে। আর তাতে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করলেন জ্যোতি বসু। যার ধারাবাহিকতা রাখতে পারেননি উত্তরসূরি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। অথবা পশ্চিমবঙ্গের আলোড়িত মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিও। তিস্তা নদীর জলবণ্টন চুক্তির আকাঙ্ক্ষা প্রত্যাশাপর্বেই থেকে গেল।
প্রয়াত জ্যোতি বসু বাংলাদেশের চির সুহৃদ হয়েই বেঁচে থাকলেন। বলেছিলেন, বাংলাদেশের প্রতি আমার অনেক ঋণ। তা এই এক জীবনে শোধ হবার নয়। প্রধানমন্ত্রী হতে পারলে হয়তো অন্য-ব্যবস্থা করা যেত। কিন্তু যতখানি করতে পেরেছি, তা মুখ্যমন্ত্রীরও অধিক। বাংলাদেশের জলকষ্ট নিয়ে আমার দায় আছে শুনি। কবিতা দিয়েও আমাকে আবেগ-আক্রান্ত করা হয়েছে। কিন্তু সীমাবদ্ধতার মধ্যেও তিন দশকের চুক্তি হলো। এতে শুধু বাংলাদেশ লাভবান হবে তা নয়। চুক্তি মোতাবেক জলপ্রবাহ রাখতে পশ্চিমবঙ্গও উপকৃত হবে। এ জন্য বাংলাদেশ যেন অঙ্গীকার আদায় করতে সচেষ্ট থাকে। আবার বলি, বাংলাদেশ পেলে পশ্চিমবঙ্গও পেতে পারবে। এমন একটি আয়োজনে আমি বেশ পরিতৃপ্ত। ‘তিস্তা’ নিয়েও সমঝোতার পথ খুলে গেল। এখন মৃত্যুদূত এলে প্রশান্তি নিয়েই চলে যাব।
সত্যিই চলে গিয়েছিলেন ৯৫ বছর বয়েসে। স্মৃতিস্মারক তারিখটি ২০১০ সালের ১৭ জানুয়ারি। জ্যোতিদা গেলেন সত্য, তবে স্মৃতিটা থাকল।