বাংলার আরেক সংস্কৃতি 'মালজোড়া গান'

শৈশবে যখন বাউলা গান দেখতাম, তখন মনে হতো বাউলরা আকাশের দিকে তাকিয়ে গান ধরেন বলেই আকাশ থেকে বৃষ্টি ঝরে পড়ে। বাউলদের গায়কি ও একতারা বা দোতারার বোলে আকৃষ্ট হতাম গানের চেয়ে বেশি। চড়া গলায় গানের সঙ্গে যে বাউল সুন্দর তালে দোতারা বাজাতেন, আমাদের কাছে তাঁর কদরটাই বেশি হতো। যাত্রাপালার কদরটা যখন কমতে শুরু করল, তখনই বাউলা গানের সংস্কৃতি বাংলার গ্রামে গঞ্জে জনপ্রিয়তা লাভ করে। বাউলা গানের আর এক প্রচলিত উপনাম ছিল পীর-মুরশিদি গান। পীর বা মুরশিদের কাছ থেকে দীক্ষা নিয়ে বাউল সাধনায় মনোনিবেশ করেন অনেকেই।
উপমহাদেশের যত বাউল শিল্পীর নাম জানতে পেরেছি, তার মধ্যে একজন অন্যতম বাউল ছিলেন ময়মনসিংহের নেত্রকোনা অঞ্চলের রশীদ উদ্দিন বাউল। নবম শ্রেণিতে থাকতে তাঁকে পেয়ে বসে আধ্যাত্মিক ভাবধারায়। তখন থেকে তিনি তৎকালীন বাউল গানের প্রতি আকৃষ্ট হন। তিনি ঘুরতে থাকেন বাউল গানের পেছনে। এক সময় তিনি নিজেই হয়ে ওঠেন বাউল শিল্পী। ময়মনসিংহ অঞ্চলে তখন বাউল গানই ছিল মানুষের সুখ-দুঃখ-বেদনা ও আত্মোপলব্ধির একমাত্র মাধ্যম। বাংলার ভাটি অঞ্চল খ্যাত ময়মনসিংহ ছিল দেশের অবহেলিত একটা অঞ্চল। সেখানকার অধিকাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমায় বসবাস করত। তখনকার মানুষের সুখ-দুঃখের সঙ্গে ধর্মীয় ভাবধারার সংগতি রেখে রচিত হয়েছে বাউল গান। গান ছিল তখনকার সার্বজনীন বিষয়। এক সময় রশীদ উদ্দিনের বাড়ি বাউল গানের আখড়ায় পরিণত হয়। কবিগান, জারিগানসহ মালজোড়া গানের চর্চা হতো। কবিগান সাধারণত হিন্দু শাস্ত্রের রামায়ণ, মহাভারত, গীতাকেন্দ্রিক দুই কবির মধ্যে কাব্যিক ছন্দে প্রশ্ন উত্তর হতো।
ইসলামিক ভাবধারা থেকে জারিগান, জঙ্গনামার পুথি ও কারবালার ঘটনা নিয়ে দুই বয়াতির মধ্যে তর্কাতর্কির মাধ্যমে দলবদ্ধ গানে অনুষ্ঠান মুখরিত হতো। তারই ধারাবাহিকতায় মালজোড়া গানের প্রচলন ঘটে। রশীদ উদ্দিনের বাড়িতে বাউল গানের প্রশিক্ষণ হতো। তখন ময়মনসিংহের খাইল্লাজুরি থানার বাউল সাধক উকিল মুনশী এ সময় যোগদান করেন। রশীদ উদ্দিনের নেতৃত্বে মালজোড়া গানের চর্চা হতে থাকে। স্থানকাল ভেদে সে গানের বিষয়বস্তু নির্ধারিত হতো। যেমন দেহতত্ত্ব, শরিয়ত ও মারফত, পুরুষ ও নারী, এমনকি দার্শনিক, রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি কামনা করে গানের ভাব রচিত হতো।
সে সময়ে বাউল গানকে রাষ্ট্রীয়ভাবে এতটা ভালো চোখে দেখা হয়নি। তখন বাউলদের পাগল হিসেবে গণ্য করা হতো। সেই সমাজ ও পরিবেশে সম্ভবত রশীদ উদ্দিন তাঁর নামের আগে ‘বাউল’ শব্দটি যোগ করেন। পূর্বসুরী লালন শাহ যেভাবে সাঁইজি হলেন, ঠিক সেভাবেই রশীদ উদ্দিন হলেন বাউল। পরে তাঁর ঘনিষ্ঠ সহচর জালাল খাঁ, উকিল মুনশী, শাহ আব্দুল করিম প্রমুখ বাউল শিল্পীও নিজেদের নামের আগে এ বাউল শব্দটি জুড়ে দেন।
বাউলদের প্রতি যে সময়ে এক ধরনের অবজ্ঞার ভাব সমাজে জারি ছিল, সেই সময়ে নিজের নামের আগে বাউল শব্দটি জুড়ে দিয়ে রশীদ উদ্দিন এক ধরনের বিদ্রোহ করেছিলেন। সেই বিদ্রোহের পথ ধরে রশীদ উদ্দিন সৃষ্টি করেন নতুন ধারার তর্কধর্মী তথ্যবহুল মালজোড়া বাউল গান। তাঁর উল্লেখযোগ্য কিছু মালজোড়া গান—
১. মানুষ ধর মানুষ ভজ
শুন বলিরে পাগল মন
মানুষের ভিতরে মানুষ
করিতেছে বিরাজন।
২. এই বিশ্ব হইতেছে দৃশ্য
অবশ্যই কে তারে করেছে সৃজন
৩. আমার সোনার চান পাখী
আমি ডাকি তাতে তুমি ঘুমাইছ নাকি
তুমি আমি জনম ভরা ছিলাম মাখামাখি
আজ কেন তুমি হইলে নীরব
খুল দুটি আঁখিরে পাখি।
শেষ গানটি প্রয়াত বাউল শিল্পী বারী সিদ্দিকীর কণ্ঠে বহুবার শুনেছি। বাংলার গ্রামে-গঞ্জে মালজোড়া গানের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাউল শিল্পীর সংখ্যাও বাড়তে লাগল। বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে মালজোড়া গান বাণিজ্যিক আকারে প্রসার লাভ করতে লাগল। বিত্তশালী গৃহস্থ বাড়িতে হ্যাজাক লাইটের আলোতে রাতভর চলত মালজোড়া গানের আসর। বর্তমানে যান্ত্রিকতার বদৌলতে তার ধরন কিছুটা পাল্টেছে। বাউলদের মধ্যে যারা ছিলেন প্রথিতযশা তাঁদের মধ্যে রাধারমণ দত্ত, দুরবিন শাহ, কামাল উদ্দিন, শফিকুন নুর, শাহ আবদুল করিম, কারী আমির উদ্দিন, রুহী ঠাকুর, সফিকুন নূর উল্লেখযোগ্য। রয়েছেন আরও নাম না জানান অনেকে।
বড়দের মুখে আমরা মালজোড়া গানের অনেক কাহিনি শুনেছি, যা রূপকথার কাহিনিকেও হার মানায়। একবার নাকি দুরবিন শাহ ও কামাল উদ্দিনের মধ্যে মালজোড়া গানের প্রতিযোগিতা হচ্ছে। তুমুল বাগ্‌যুদ্ধে যখন দুরবিন শাহ হেরে যাওয়ার উপক্রম, তখন দুরবিন শাহের মা একটা পানপড়া কামালকে খাইয়ে দিলেন, অমনি কামালের গলা ফেটে রক্ত ঝরতে লাগল। কামালের কণ্ঠ গেল স্তব্ধ হয়ে। দুরবিন শাহের মা নাকি কামিল পিরানী ছিলেন। দুরবিন শাহের বাউল গানের মধ্যে এই মুহূর্তে মনে পড়ছে, ‘তোমার মতো দরদি আর নাই ওগো দয়াময়/ তোমার মতো দরদি আর নাই/ নাম স্মরণে ঘোর নিদানে তোমার চরণ ভিক্ষা চাই।’ কিংবা ‘আরে ও সাধের দোতারা/ অল্প বয়েসে করলে মোরে ঘর ছাড়া’ গানটির কথা উল্লেখ করা যায় এখানে।
কারী আমির উদ্দিনের অনেক সাড়া জাগানো বাউল গানের মধ্যে একটি বিখ্যাত গান হচ্ছে—
১. লোকে বলে আমার ঘরে নাকি চাঁদ উঠেছে
নাগো না না গো না আমার বন্ধু এসেছে।
আর শাহ আবদুল করিমের হাজারো বাউল গানের মধ্যে কত গান যে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠেছে, তা বলে শেষ করা যাবে না। তাঁর দেহতত্ত্বের দুটি গানের উল্লেখ না করলেই নয়—
১. গাড়ি চলে না চলে না চলে না রে
২. বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ
আমার বাড়ি আসে
সই গো বসন্ত বাতাসে।
আজকাল বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই মালজোড়া গান গেয়ে নাম কুড়িয়েছেন। দেহতত্ত্বের মালজোড়া গাইতে গাইতে দেহ দোলাচ্ছেন। এটা আসল মালজোড়া নয়। এটা পূর্বসুরীদের অনুরণন মাত্র।