বাফার বৈঠকে কবি শহীদ কাদরীকে স্মরণ

বৈঠকে বাফার সদস্যরা

বাংলাদেশ একাডেমি অব ফাইন আর্টসের (বাফা) আয়োজনে গত ২৯ আগস্ট নিজস্ব কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল বাফার নিয়মিত আয়োজন ‘শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি’। এবারে পর্বটি সাজানো হয়েছিল বাংলা কবিতার বরপুত্র কবি শহীদ কাদরীকে নিয়ে।

অনুষ্ঠানের শুরুতেই শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন বাফার প্রধান ফরিদা ইয়াসমিন। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া আদর্শ বুকে ধারণ করে বাংলা শিল্প ও সাহিত্য চর্চার মধ্য দিয়ে আমরা তা বাঁচিয়ে রাখব এবং নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেব।

সঞ্চালক ক্লারা রোজারিও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবি মহাদেব সাহার লেখা কবিতা পাঠের মাধ্যমে তাঁর সঞ্চালনা শুরু করেন। অনুষ্ঠানে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হয় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, কবি শামসুর রাহমান, কবি হুমায়ুন আজাদসহ বাংলা সাহিত্যের যেসব কবি-সাহিত্যিক আগস্ট মাসে মৃত্যুবরণ করেছেন তাঁদেরও।

এ সময় বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বাফার গিটার শিক্ষক এ এফ এম আফতাবুজ্জামান পরিবেশন করেন “শোনো একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি’ গানটি।

এরপর শুরু হয় বাফার নিয়মিত আয়োজন মাসান্তের বৈঠক। এই পর্বটি নিবেদন করা হয় কবি শহীদ কাদরী স্মরণে। স্মরণ পর্বের শুরুতে আবৃত্তি শিল্পী নজরুল কবির কবি শহীদ কাদরীর লেখা ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’ কবিতাটি আবৃত্তি করেন। অনুষ্ঠানের শেষের দিকে তিনি আবারও আবৃত্তি করেন কবির ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’ কবিতাটি। একই সঙ্গে মোহাম্মদ নাসির উল্লাহ উক্ত কবিতার ইংরেজি অনুবাদ পাঠ করে শোনান।

সাহিত্য একাডেমির পরিচালক মোশাররফ হোসেন বঙ্গবন্ধুর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানানোর পাশাপাশি কবি শহীদ কাদরী সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, কবি শহীদ কাদরী ছিলেন সাহিত্য একাডেমি নিউইয়র্কের একমাত্র উপদেষ্টা। কবি শহীদ কাদরী এই শহরে থাকার জন্য আমরা যারা তাঁর কাছাকাছি গিয়েছি; তাঁরা প্রত্যেকেই নিজেদের ভাগ্যবান মনে করি। এমন একজন প্রাজ্ঞ মানুষের সংস্পর্শে আমাদের মানসিকতায়, চিন্তায় এবং এই শহরে শিল্প-সাহিত্য কার্যক্রমে অভিনব এক পরিবর্তনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। শহীদ কাদরীর প্রতি সম্মান জানানোর এ আয়োজনের জন্য তিনি বাফাকে সাধুবাদ জানান।

কবি শামস আল মমীন বলেন, আমার সঙ্গে কবির পরিচয় ১৯৮৫ সালে। এরপর থেকে ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। তিনি আরও বলেন, তাঁর কবিতার যে ভাষা এটা সত্যিই অদ্ভুত ব্যাপার! তিনি কবি শহীদ কাদরীর সঙ্গে তাঁর বেশ কিছু স্মৃতিকথা তুলে ধরেন।

বাফাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে বিশিষ্ট নাট্যশিল্পী শিরিন বকুল শহীদ কাদরীর লেখা ‘রবীন্দ্রনাথ’ ও ‘একটি উত্থান-পতনের গল্প’ কবিতা দুটি আবৃত্তি করেন।

কবির কাব্য ও কবিতা বিষয়ক আলোচনায় লেখক আহমাদ মাযহার বলেন, আবদুল মান্নান সৈয়দ মাত্র তিনটি শব্দ দিয়ে কবি শহীদ কাদরীর বৈশিষ্ট্য চিনিয়েছিলেন। তা হচ্ছে—১. প্রতিতুলনা; ২. প্রতিষঙ্গ এবং ৩. প্রতিসাম্য। তাঁর মতে, এই তিনটি শব্দের যে তাৎপর্য; তা অর্জন করতে গেলে একটা মানুষের মধ্যে বৈচিত্র্যময় পরস্পর বিরোধিতা থাকতে হবে। আর সেই বৈচিত্র্যময় পরস্পর বিরোধিতাকে একটি মালা গেঁথে নাটকীয় পরিচর্যা করতে হলে যে প্রতিভা দরকার; তা শহীদ কাদরীর ছিল। শহীদ কাদরীর কবিতার যে বাকভঙ্গি, যে ভাষা, তুলনা প্রতি-তুলনা; তা আমাদের পূর্ববাংলার অন্যান্য কবিদের থেকে আলাদা। অর্থাৎ তাঁর অনুভূত-উপলব্ধ যে চেতনা; তার মূল ছিল দেশে। তিনি উল্লেখ করেন, পাঠকেরা তাঁদের কাব্য তৃষ্ণা দিয়ে শহীদ কাদরীকে আবিষ্কার করেছেন।

কবি তমিজ উদ্দিন লোদী বলেন, শহীদ কাদরী সবাইকে আপন করে নিতে পারতেন, এই গুণটি বিরল; যা সবার মধ্যে থাকে না। কবি শহীদ কাদরী যখন জন্মেছিলেন; তিনি বারুদের গন্ধ নিয়ে জন্মেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ উত্তরকাল এবং যুদ্ধের একটি আবহের মধ্যেই তিনি জন্মেছিলেন। আজীবন শুদ্ধ কবিতার অন্বেষণে তাঁর কবিতায় উপমা, নির্মাণ পঞ্চাশের ষাটের এবং তাঁর উত্তরসূরি চল্লিশের দশকের অনেক কবিদের চেয়ে তিনি আলাদা হয়েছেন শব্দ নির্মাণে, উপমায়, চিত্রকল্পে এবং বিষয় নির্মাণে।

স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লেখক সোনিয়া কাদির বলেন, কবি শহীদ কাদরীর ৭১তম জন্মদিনে কবিকে সংবর্ধনা দেওয়ার জন্য সাহিত্য একাডেমি এবং বাফাসহ অনেকগুলো সংগঠন আনুষ্ঠানিকভাবে জন্মোৎসবের আয়োজন করেছিল। সেই সময়ে সাহিত্য একাডেমির সুবাদেই কবির সংস্পর্শে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়। তিনি বলেন, মানুষ শহীদ কাদরী ক্ষণজন্মা; তাঁর কবিতায় তিনি টিকে থাকবেন অসংখ্য দিন পর্যন্ত। সবশেষে কবি শহীদ কাদরীকে শ্রদ্ধা জানাতে এই অনন্য আয়োজনের জন্য বাফার প্রতি বিশেষ ধন্যবাদ জানানোর পাশাপাশি সবাইকে আহ্বান জানান এভাবেই বাফার পাশে থাকতে।

কমিউনিটি অ্যাকটিভিস্ট সিরাজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ২০১০ সালে বাংলাদেশ সোসাইটির উদ্যোগে ১১৭টি সংগঠন মিলে সম্মিলিত একুশ উদ্‌যাপনের সময় এবং ২০১৪ সালে সর্বজনীনভাবে কবিকে সম্মাননা দিতে পারাটা আমাদের জন্য অত্যন্ত সৌভাগ্যের ছিল।

শহীদ কাদরীর অন্যতম তরুণ বন্ধু নাট্যব্যক্তিত্ব এজাজ আলম বলেন, শহীদ কাদরী সম্পর্কে স্মৃতিচারণ বলতে আমি মনে করি যে, শহীদ কাদরীর কবিতা পাঠ করাই সবচেয়ে ভালো, তাঁকে স্মরণ করার জন্য। তিনি শহীদ কাদরীর ‘সব নদী ঘরে ফেরে’ কবিতাটি পড়ে শোনান।

অনুষ্ঠানে লেখক এবং অভিনেত্রী লুতফুন নাহার কবি শহীদ কাদরীকে নিয়ে লেখা তাঁর স্মৃতিকথা পাঠ করে শোনান।

কবি শহীদ কাদরীকে নিয়ে লেখা স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন—কবি কাজী আতিক, কবি আহমেদ ছহুল, কবি পলি শাহীনা এবং বেনজির শিকদার। কবি ছন্দা বিনতে সুলতান পাঠ করেন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা কবিতা।

অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন—খায়রুল ইসলাম, মিশুক সেলিম, ইয়াকুব আলী, নাসির শিকদার, মাসুম আহমেদ, শম্পা রহমান, কানিজ ফাতিমা, প্রতিমা সুমি, সিসিলিয়া মরাল, শেলি সেমস, নুসরাত এলিন, শামীম আরা বেগম, ফারজানা ইয়াসমিন, মার্জিয়া স্মৃতি, সানজিদা ইসলাম ও নুজহাত ফাইজা।

অনুষ্ঠানের সর্বশেষ পরিবেশনায় আবৃত্তিশিল্পী জে এইচ আরজু বাফাকে বিশেষ ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, আগস্ট মাসটি বাঙালি জাতির জন্য ভীষণ দুর্ভাগ্যের। এই মাসে আমরা হারিয়েছি আমাদের জাতির জনককে। এই আগস্টে শহীদ কাদরীও চলে গেছেন। যার সান্নিধ্য আমি ২০ বছর ধরে পেয়েছি। তিনি শহীদ কাদরীর লেখা ‘আপনারা জানেন’ কবিতাটি আবৃত্তি করে শোনান।