বিল-মেলিন্ডার বিচ্ছেদ তত্ত্ব

বিল গেটস ও মেলিন্ডা গেটসছবি: এএফপি

পৃথিবীর অন্যতম শীর্ষ ধনী বিল গেটসের জীবনে এক ঘনঘোর ছায়া নেমে এসেছে। দীর্ঘ ২৭ বছরের দাম্পত্য জীবনে বিয়ে বিচ্ছেদের যে ঝড় নেমে এসেছে, তা অপ্রতিরোধ্য বলে প্রমাণিত হতে চলেছে। পুরো জগতের কাছে খবরটি একেবারে হতবাক করে দেওয়ার মতো। এর কারণ খুঁজে পেতে রেডিও, টিভি, পত্রপত্রিকার সাংবাদিকেরা অনেক কাঠখড় পোড়াচ্ছেন। তবে এ পর্যন্ত যতটুকু জানা গেছে, সেটা যথেষ্ট কি না বলা শক্ত। পরে একে ‘টিপ অন দ্য আইসবার্গ’ বলেও মনে হতে পারে।

এ পর্যন্ত মোটা দাগে যেগুলো ধরা যায়, তা হলো—১. শিশু-কিশোরীদের পাচার ও জোর করে যৌনদাসীর কাজ করানোর মতো গুরুতর অভিযোগে কারাবাসে থাকা অবস্থায় আত্মহত্যা করা মার্কিন ধনকুবের জেফরি এপস্টেইন। ২. অর্থ ম্যানেজার মাইকেল লারসন ও ৩. বৈবাহিক জীবনে সমস্যা, বাংলায় হয়তো একে ভীমরতি বলে।

জেফরি এপস্টেইনের সঙ্গে বছরের পর বছর ধরে বিল গেটসের সম্পর্কটা কেউ ভালো চোখে দেখেনি। অপ্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েদের যৌন নির্যাতনের অভিযোগে এপস্টেইনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ২০০৮ সালে ফ্লোরিডায় নাবালিকাকে শারীরিক সম্পর্ক করতে চাওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। পরে তাঁর দণ্ড হয়। ২০১৯ সালের আগস্ট মাসে নিউইয়র্কের কারাগারে তাঁকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়, তিনি আত্মহত্যা করেছেন বলে জানানো হয়।

জানা গেছে, গেটস এপস্টেইনের নিউইয়র্কের ম্যানশনে অনেকবার যাতায়াত করেছেন। সেখানে নাকি তাঁরা বিল ও মেলিন্ডার বিবাহিত জীবন বিষিয়ে ওঠার কথা এবং এপস্টেইনকে বিল ও মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনে যোগদানের সম্ভাব্যতার ব্যাপারে আলোচনা করেছেন। অন্যদিকে, ওখানে যাওয়াটা নাকি মেলিন্ডার কাছ থেকে দূরে থাকার ও মনের কষ্ট থেকে কিছুটা অবকাশ পাওয়ার একটা উপায় ছিল। অবশ্য বিল গেটসের এক প্রতিনিধির পক্ষ থেকে ওই খবরটি ‘ভুল” বলে বিতর্ক তোলা হয়।

তবে টাইমসের বিবরণ অনুযায়ী, ২০১১ সালে গেটস তাঁর সহকর্মীদের কাছে ইমেইলে নাকি এপস্টেইনের বিষয়ে জানিয়েছিলেন, ‘তাঁর জীবনযাত্রা আলাদা রকমের এবং সেটা আমার জন্য কাজ করবে না। এপস্টেইনের বাড়িটি খুব সুন্দর করে সাজানো’।

মাইকেল লারসন ছিলেন ‘ক্যাসকেড ইনভেস্টমেন্ট’ নামে গেটসের একটি গোপন সংস্থার অর্থ ব্যবস্থাপক। মেলিন্ডা ২০১৭ সালে বিলকে মাইকেল লারসনের বিরুদ্ধে নানা যৌন হয়রানির অভিযোগ শুনে তা তদন্তের জন্য বাইরের কোম্পানিকে নিয়োগ করার কথা বলে আসছিলেন। অভিযোগ এসেছিল একটি সাইকেল স্টোর চেইনের ম্যানেজারের কাছ থেকে। এই কোম্পানির আংশিক মালিক ছিল ক্যাসকেডের অধীনের এক ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফার্ম। তখন এই অভিযোগ চাপা দিতে বিল গেটস একটি অজ্ঞাত পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে মামলাটি মিটিয়ে ফেলতে এগিয়ে যান। কিন্তু মেলিন্ডা সেটা না মেনে এ ব্যাপারে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকেন। কিন্তু বিল কিছুতেই বাইরের তদন্তকারী নিয়োগ করেননি এবং লারসন এখনো তাঁর আগের দায়িত্বে রয়েছেন।

দ্য টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিল গেটস তাঁর মাইক্রোসফট কোম্পানির এবং বিল ও মেলিন্ডার বিলিয়ন ডলারের দাতব্য প্রতিষ্ঠানে কর্মরত নারীর সঙ্গে সম্পর্ক করার উদ্দেশ্যে যে খোঁজখবর করতেন, এটা সবাই মোটামুটি জানত। ২০০৬ সালে তিনি এক নারী সহকর্মীকে ডিনারে যাওয়ার জন্য ইমেইলে আমন্ত্রণ পাঠান। সেখানে তিনি লেখেন, ‘যদি এতে আপনি অস্বস্তি বোধ করেন, তাহলে ভান করবেন যেন ব্যাপারটি কোনো দিন ঘটেনি।’

ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী গেটস ফাউন্ডেশনের এক নারী কর্মচারীও নাকি এক ককটেল পার্টিতে বিলের কাছ থেকে প্রস্তাব পেয়েছিলেন। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ সালে মাইক্রোসফটের একজন সাবেক কর্মচারীর সঙ্গে গেটসের সম্পর্কের পরিণতি শেষ পর্যন্ত তাঁকে কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ থেকে সরে যেতে বাধ্য করে। ২০১৯ সালে ওই নারীর কাছ থেকে একটি চিঠি পাওয়ার পর বোর্ডের তদন্ত শুরু হয়। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে তা শেষ হওয়ার আগেই গেটস পদত্যাগ করেন।

বিল গেটসের একজন মুখপাত্র জার্নালকে জানিয়েছেন, ২০ বছর আগের ওই সম্পর্কটি সৌহার্দ্যপূর্ণভাবে শেষ হয়েছিল। বিলের পদত্যাগের আসল কারণ নাকি ওটা নয়, মানুষের উপকারের ওপর যাতে আরও বেশি নজর দেওয়া যায়। কিন্তু জার্নালের প্রতিবেদন অনুযায়ী বোর্ড সদস্যরা নারীর সঙ্গে বিলের ওই ধরনের সম্পর্ক উপযুক্ত বলে মনে করেননি। বোর্ড থেকে প্রস্থানের তিন মাস পরে বিল গেটস তাঁর পদে পুনর্নির্বাচিত হয়েছিলেন।

দ্য টাইমসের অভিমত, বিল ও মেলিন্ডার মধ্যে মতবিরোধের প্রধান কারণ হচ্ছে, মেলিন্ডা বিশ্বব্যাপী নারী ক্ষমতায়নের প্রচার ও প্রসারের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। বিল হয়তো প্রকাশ্যে সভায় তাঁর স্ত্রীর কিছু পয়েন্টে দ্বিমত প্রকাশ করতে পারেন। এতে ফাউন্ডেশনের কর্মচারীরা বিব্রত বোধ করতে পারেন। এ ছাড়া মেলিন্ডা গেটস গোড়া থেকেই বিল গেটস এবং এপস্টেইনের সম্পর্কের বিরোধিতা ও অভিযোগ করে আসছিলেন।

ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৯ সালে যখন গেটস ও এপস্টেইনের সম্পর্ক জনসমক্ষে আসে, তখন সেই অক্টোবরের প্রথম দিকে মেলিন্ডা গেটস শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে বিয়ে বিচ্ছেদের আইনজীবীদের খোঁজ করতে শুরু করেন।