বিশৃঙ্খলায় সৌন্দর্যের খোঁজ বাংলাদেশি বিজ্ঞানীর

বিজ্ঞানী ফজলে হোসেন

তরুণ বয়সে ফজলে হোসেনের সেনা কর্মকর্তা হওয়ার ছিল। কিন্তু উচ্চতা কম হওয়ায় তাঁর সেই শখ পূরণ হয়নি। এতে খুব মন খারাপ হয়েছিল তাঁর। কিন্তু সে সময় তিনি সেনা কর্মকর্তা হলে বিজ্ঞান ও সভ্যতা দারুণভাবে বঞ্চিত হতো। কারণ জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বাঙালি অধ্যাপক ফজলে হোসেনকে ফ্লুইড ডায়নামিকস বিশেষজ্ঞ হিসেবে সারা পৃথিবীর মানুষ এখন একনামে চেনে।

ফ্লুইড ডায়নামিকস এবং টার্বুলেন্সে অধ্যাপক ফজলে হোসেন একমাত্র বিজ্ঞানী, যিনি এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মর্যাদার চারটি পুরস্কারের সবগুলো অর্জন করেছেন।

ফ্লুইড ডাইনামিকস অ্যান্ড টার্বুলেন্স হলো ফলিত পদার্থ বিজ্ঞান ও ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অত্যন্ত জটিল একটি শাখা। ফ্লুইড ডাইনামিকসকে সোজা বাংলায় বলা যায়, তরল ও গ্যাসীয় পদার্থের চলাচল প্রবাহ অধ্যয়ন বিদ্যা। ফ্লুইড ডাইনামিকসের সাহায্যে মহাকাশের নক্ষত্রের বিবর্তন, সমুদ্রের স্রোত, আবহাওয়া থেকে শুরু করে

রক্ত সংবহন প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব। এর প্রযুক্তিগত ব্যবহারের কয়েকটি উদাহরণ হলো রকেট ও উড়োজাহাজের ইঞ্জিন, বায়ু কল, তেলের পাইপলাইন ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা।

আর টার্বুলেন্সের সাধারণ অর্থ কোলাহল। তবে বিজ্ঞানে এর অর্থ সুনির্দিষ্ট এবং সংজ্ঞায়িত। সেটি হলো তরল বা বায়বীয় পদার্থের গতিপথের আকস্মিক পরিবর্তন, যার ফলে পদার্থটি এক ধরনের ঘূর্ণাবর্ত এবং স্রোত আকারে প্রবাহিত হতে থাকে। টার্বুলেন্স কতটা শক্তিশালী তা নির্ভর করে তার লক্ষ্যবস্তুর আকারের ওপর। টার্বুলেন্সের কারণেই বিমান ওড়ার সময় যাত্রীরা মাঝে মাঝে এক ধরনের ঝাঁকুনি অনুভব করেন।

বিজ্ঞানী ফজলে হোসেনের গবেষণা ও তত্ত্ব এই ক্ষেত্রের অগ্রগতিতে যুগান্তকারী ভূমিকা রেখেছে। তিনি টার্বুলেন্স নিয়ে প্রচলিত অনেক মতবাদের সীমাবদ্ধতা যেমন তুলে ধরেছেন, তেমনি এর বহুবিধ ব্যবহারিক প্রয়োগের সম্ভাবনাও দেখিয়েছেন। উড়োজাহাজের অধিকতর কার্যকরী ইঞ্জিন থেকে শুরু করে পেট্রোলিয়াম ইঞ্জিনিয়ারিং, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ক্যানসার থেরাপিসহ বহু ক্ষেত্রে বিজ্ঞানী ফজলে হোসেনের আবিষ্কার ও তত্ত্ব গবেষকদের মধ্যে নতুন উদ্দীপনার সঞ্চার করেছে।

ফ্লুইড ডায়নামিকস আর টার্বুলেন্স ফিল্ডে ফজলে হোসেনের যুগান্তকারী গবেষণা, আবিষ্কার আর গাণিতিক সমীকরণগুলো ‘বিশৃঙ্খলার মাঝে শৃঙ্খলা বা order within disorder’ এর তত্ত্বকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। তাঁর আবিষ্কার জটিল হলেও মানুষটি নিজে সরল, অনাড়ম্বর ও প্রচারবিমুখ।

বয়স আশি ছুঁই ছুঁই। এক চোখে একদম দেখেন না, আরেক চোখে দেখেন ৫০ শতাংশের কম। কিন্তু অফুরন্ত প্রাণ শক্তিতে ভরপুর এখনো। নিয়মিত যোগ ব্যায়াম করেন।

সরকারি কর্মকর্তা বাবার নয় সন্তানের মধ্যে ফজলে হোসেন ছিলেন চতুর্থ। টানাটানির সংসারে লেখাপড়া করা আর সংসারের কাজে বাবা-মাকে সাহায্য করতে হতো। ছোটবেলায় তাঁর নিয়মিত কাজের মধ্যে ছিল দুধেল গাভির খেয়াল রাখা আর বাড়ির পাশের আঙিনায় সবজি খেতের যত্ন নেওয়া। বহু পথ হেঁটে দূরের কুয়া থেকে বালতিতে করে পানি নিয়ে সবজি খেতে দিতে হতো তাঁকে। ফজলে হোসেন নিজেই বললেন, ‘দারিদ্র্যের মাঝে আমি বেড়ে উঠেছি।’

সীমিত আয়ের সংসারে বাবা-মায়ের সাধ্য ছিল না নামি স্কুলে ছেলে মেয়েদের পড়ালেখা করোনার।এ কারণে বাড়ির পাশের স্কুলে যেতেন ফজলে হোসেন। হাইস্কুলে পড়ার সময় ফজলে হোসেনের স্বপ্ন ছিল সীমিত পরিসরের টেকনিশিয়ান হওয়া। শৈশবে ফজলে হোসেন ছিলেন লাজুক প্রকৃতির। কথা বলতে আড়ষ্ট বোধ করতেন। কিন্তু হাইস্কুলের একটি বিশেষ ঘটনা তাঁর জীবনকে ভীষণ প্রভাবিত করেছিল।

অধ্যাপক ফজলে হোসেন বলেন, ‘হাইস্কুলে একবার হেড মাস্টারের বিদায় সংবর্ধনায় আমাকে বক্তৃতার দায়িত্ব দেওয়া হলো। কিন্তু মঞ্চে উঠে ভড়কে গেলাম। একটি বাক্যও মুখ দিয়ে বেরোল না। মঞ্চ থেকে নিঃশব্দে নেমে এলাম। নিজের ওপর রাগ হলো খুব। আমার কারণে ছাত্রদের মাথা নিচু হলো। লজ্জা আর গ্লানিতে চোখে জল চলে এল। সেদিন মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, যে করে হোক মঞ্চ ভীতি আমাকে কাটিয়ে উঠতেই হবে। এ রকম ঘটনা যেন আমার জীবনে আর না ঘটে।’

জীবনে আর সে রকম ঘটনা ঘটেনি ফজলে হোসেনের। পরে তিনি অনেকের প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। এর প্রমাণ মেলে ইপুয়েটে (ইস্ট পাকিস্তান ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি যা বর্তমান বুয়েট) দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সম্পাদক (১৯৬০), তৃতীয় বর্ষে সাধারণ সম্পাদক (১৯৬১) এবং চতুর্থ বর্ষে (১৯৬২) ভিপি নির্বাচিত হন।

এ সময় পাকিস্তান অবজারভারের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিরও দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ফজলে হোসেন বলেন, ছাত্রদের ন্যায্য দাবি নিয়ে আন্দোলন করতে গিয়ে একাধিকবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরাজভাজন হয়েছেন, কিন্তু পিছপা হননি।

ফজলে হোসেন বলেন, তৎকালীন ম্যাট্রিকুলেশন (এসএসসি) পরীক্ষার ১০ দিন আগে তাঁর ঘরে চুরি হয়। খোয়া যায় পরীক্ষার নোট। মন খারাপ হলেও পরীক্ষা দিলেন যথাসম্ভব প্রস্তুতি নিয়ে। সবাইকে তাক লাগিয়ে মেধা তালিকায় প্রথম হলেন তিনি। এরপর আইএসসি পরীক্ষার কিছুদিন আগে অসুস্থ হলেন। শয্যাশায়ী হয়ে পরীক্ষা দিলেন। রেজাল্ট বেরোলে দেখা গেল, বোর্ডে মেধা তালিকায় তৃতীয় স্থান অধিকার করেছেন তিনি।

পরে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক ডিগ্রি শেষে ফুলব্রাইট স্কলার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন তিনি। একই বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএস, পিএইচডি (১৯৬৯) সমাপ্ত করেন। অনন্য পিএইচডি অভিসন্দর্ভের কারণে স্ট্যানফোর্ডে একার্ট প্রাইজ লাভ করেন।

১৯৭৩ সালে টেক্সাসের ইউনিভার্সিটি অব হিউস্টনে যোগ দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন অ্যারোডায়নামিকস অ্যান্ড টার্বুলেন্স ল্যাব। একটানা ৪২ বছর সেখানে গবেষণা করেছেন, ছাত্র পড়িয়েছেন। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের গৌরবময় কিউলেন ডিস্টিংগুইসড প্রফেসর ছিলেন বহু বছর। যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে জাপান, চীন, ইংল্যান্ড, ইতালি, রাশিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি, ইসরায়েল, ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের বিভিন্ন ইনস্টিটিউট এবং ফোরামে বক্তৃতা দিয়েছেন।

অনারারি প্রফেসর হিসেবে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় ভিজিট করেছেন বহুবার। সেখানে ফজলে হোসেনের সহকর্মীর মধ্যে ছিলেন বিশ্বখ্যাত পদার্থবিদ স্টিফেন হকিং, জর্জ ব্যাচেলর, অ্যালেন টাউন্সেনড, কিথ মফোট ও বাঙালি নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। এক বছর বিশ্বখ্যাত ক্যালটেকে গবেষণা করেছেন গর্ডন ম্যুর ডিস্টিংগুইসড প্রফেসর হিসেবে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সম্মানজনক ন্যাশনাল একাডেমি অব ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের (এনএই) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চেয়ার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন বেশ কয়েক বছর।

ফ্লুইড ডায়নামিকস এবং টার্বুলেন্সে অধ্যাপক ফজলে হোসেন একমাত্র বিজ্ঞানী, যিনি এই ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মর্যাদার চারটি পুরস্কারের সবগুলো অর্জন করেছেন। এগুলো হলে—ফ্রিম্যান স্কলার অ্যাওয়ার্ড অব দ্য আমেরিকান সোসাইটি অব মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার্স (১৯৮৪); ফ্লুইড ডায়নামিকস প্রাইজ অব দ্য আমেরিকান ফিজিক্যাল সোসাইটি (১৯৯৮); ফ্লুইডস ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাওয়ার্ড অব দ্য আমেরিকান সোসাইটি অব মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার্স (২০০০) ও দ্য ফ্লুইড ডায়নামিকস অ্যাওয়ার্ড ফ্রম দ্য আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব অ্যারোনটিকস অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোনটিক্স (২০০২)।

অধ্যাপক ফজলে হোসেন বর্তমানে টেক্সাস টেক ইউনিভার্সিটির প্রেসিডেন্টস ডিস্টিংগুইসড চেয়ার ইন ইঞ্জিনিয়ারিং, সায়েন্স অ্যান্ড মেডিসিন। একই সময়ে ইউনিভার্সিটি প্রেসিডেন্টের সিনিয়র অ্যাডভাইজর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

বাংলাদেশের সাধারণ পরিবারের একজন সন্তান কঠিন পরিশ্রম, দৃঢ় সংকল্প আর সুশৃঙ্খল জ্ঞান চর্চাকে ভিত্তি করে পৃথিবীর সেরা গবেষক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, সুনাম কুড়িয়েছেন। এই শেষ জীবনে এসে বাংলাদেশে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, শিক্ষা এবং সমাজসেবার আরও সুদূরপ্রসারী প্রসার ঘটাতে তিনি নগদ অর্থ ও পুরস্কার প্রবর্তন করতে চান।

ফজলে হোসেন বলেন, পুরস্কার তাঁরা পাবেন, যারা দেশের অভ্যন্তরে থেকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে মৌলিক গবেষণা ও কাজ করেছেন। আর পুরস্কারগুলো হবে আলাদা আলাদা। যেমন—ফজলে হোসেন বাংলাদেশ অ্যাওয়ার্ড ফর আউটস্ট্যান্ডিং পিএইচডি; ফজলে হোসেন বাংলাদেশ অ্যাওয়ার্ড ফর আউটস্ট্যান্ডিং জার্নালিজম, ফজলে হোসেন বাংলাদেশ অ্যাওয়ার্ড ফর মেডিসিন।