বেঁচে থাকব, কিন্তু কেন?
মার্ক টোয়েন বলেছিলেন, ‘The two most important days in your life are the day you are born and the day you find out why’। জন্মদিনের কথা জানি কিন্তু কেন, সেই ‘purpose’ বোধ হয় আত্মোপলব্ধির ব্যাপার। এক সাধু বলেছিলেন, শুধু বেঁচে থাকার মধ্যে সার্থকতা নেই বরং কেন বেঁচে থাকব, সেটা খুঁজতে হবে। আমিতো আর সাধু সন্ন্যাসী নই, জানি না এই খোঁজার পর্ব কোনদিন শেষ হবে কিনা।
ছোট বেলায় স্কুলে বাংলায় রচনা পড়তাম ‘আমার জীবনের লক্ষ্য’। আমাদের মনে আকাঙ্ক্ষা যাই থাক, রচনা বইয়ের লেখা বারবার পড়তাম পরীক্ষায় প্রস্তুতির জন্য। ওই বইয়ে লেখা থাকত, বড় হয়ে চিকিৎসক হব, গরিব রোগীদের বিনা পয়সায় চিকিৎসা করব, আর্তমানবতার সেবা করব ইত্যাদি। বর্ণনাটা হতো অনেকটা অর্থ সম্পদ আর ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের মিশ্রণ। বাংলা রচনা আমার জীবনে খুব প্রভাব ফেলেনি। আমার চিকিৎসক হওয়া হয়নি।
স্কুলে আমার এক বন্ধু ভালো হাত দেখত, অন্তত আমরা তাই মনে করতাম। আমরা তখন ক্লাস টেনে পড়ি। আমরা সেই বন্ধুকে ডাকতাম হস্ত রেখা বিশারদ বলে। এ কাজের জন্য তার যে লুক দরকার, কোথাও তার ঘাটতি ছিল না। চোখে ছিল চশমা আর খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারত। হাতের ভাগ্য রেখা শুধু বড় হলেই যে সম্পদ বেশি হবে, এ ব্যাপারে কেউ তার চেয়ে বেশি জানত না। হাত দেখার খুব সুন্দর একটা পাওয়ারফুল লেন্স ছিল তার। এলাকার সব বয়সের লোকের মধ্যেই তার জনপ্রিয়তা ছিল ঈর্ষণীয়।
বলতে দ্বিধা নেই, রচনা বইয়ে যাই লেখা থাক না কেন বড় হয়ে কী হব, সে নিয়ে আমার বা আমাদের বন্ধু মহলে সবারই আগ্রহের কমতি ছিল না। তাই আমরা সেই হস্তরেখাবিদ বন্ধুর কাছে হাত দেখানোর জন্য সুযোগের অপেক্ষায় থাকতাম। তার কাছে সেই সুযোগ খুব সহজে পাওয়া যেত এমন নয়। তাকে বারবার অনুরোধ করতে হবে, এই ব্যাপারটাও ভালো লাগত না। হয়তো প্রাইভেট পড়তে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলাম, সে এমনভাবে তাকাত যেন বিশাল কোন অন্যায় করে ফেলেছি।
তারপরও সেই বন্ধুর কাছে হাত দেখিয়েছিলাম। একবার নয়, বহু বার। কখনো ঠাট্টাচ্ছলে, কখনো সময় নিয়ে। হাতের তালুর ওপর ল্যান্সটা আস্তে আস্তে ঘুরাত কখনো হাতের সামনে, কখনো পেছনে। হাত কখনো ঘুরিয়ে, কখনো চাপ দিয়ে। যে রেখাটা হালকা তা দৃশ্যমান করার অনেক কসরত থাকত তার। ব্যাপারটা এমন যে, ভবিষ্যৎ বলায় আবার ভুল না হয়ে যায়। সে শুরু করত এভাবে—তোর লাইফ লাইনটা এখানে কেমন যেন কেটে গেছে, দেখ হালকা রেখাটা একদম মাঝখান দিয়ে চলে গেছে। এখানে একটা ফারা। আর এই দেখ আরেকটু নিচে এইখানে আরেকটা ফারা। এই দুটো ফারা যদি কেটে যায়, মোটামুটি তোর আয়ু নিয়ে ভাবতে হবে না…।
আয়ু নিয়ে যে খুব ভাবতাম না এমন নয়, কিন্তু আসল ভাবনা ছিল অন্য জায়গায়। বন্ধুও সেটা বুঝত। আড় চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করতাম, দোস্ত, ভালোবাসার কী অবস্থা। প্রেম–ট্রেম হবে তো। হাতের তালু ঘুরিয়ে একদম অন্যপাশে চলে যেত। যেখানে কোনো রেখা নেই। তালু চাপ দিয়ে কিছু ভাঁজ তৈরি করে বলত সম্ভাবনা আছে, তবে লেগে থাকতে হবে।
তারপর জিজ্ঞেস করতাম টাকা পয়সার কথা, পড়াশোনার কথাসহ আরও অনেক কিছু। জিজ্ঞেস করতাম, দোস্ত, জীবনে বিদেশ যাত্রা আছে নাকি? মনের সুপ্ত খায়েশ, বিদেশে একবার গেলে কি ভালোই না হতো! সে বন্ধু অনেক সময় নিয়ে তালুতে কী যেন খুঁজত। তারপর এক সময় বলত, নারে, তোর মনে হয় বিদেশ যাওয়া হবে না কখনো। মন খারাপ হতো। খুবই খারাপ হতো। সেই প্রশ্ন তাকে আরও অনেকবার করেছি। জিজ্ঞেস করেছি, বন্ধু, ভালো করে দেখত, বিদেশ যাত্রা আছে কিনা। কখনো সে ‘হ্যাঁ’ বলেনি।
আমার বাবা সরকারি চাকরি করতেন। সেই জন্য দেশের বিভিন্ন জায়গায় আমাদের থাকতে হয়েছে। আমার সেই বন্ধুর সঙ্গে পরে আর কোনো যোগাযোগ থাকেনি।
প্রায় এক যুগ পূর্ণ হতে চলল। ২০০৮ সালের কোন একদিন দেশ ছেড়ে চলে আসি। আমার স্থায়ী ঠিকানা এখন প্রবাস। দেশের মানুষের কথা খুব মনে হয়। মনে হয় সে বন্ধুর কথা। বন্ধুর ভবিষ্যৎ বাণী সত্য হলেও খুব মন্দ হতো কি?
শুরু করেছিলাম জীবনের উদ্দেশ্য নিয়ে। তবে অসম্ভব সুন্দর এই পৃথিবীতে শুধু বেঁচে থাকাটাও কম কিছু নয়। যেখানেই থাকি, দেশে বা প্রবাসে, চারপাশটাকে আরেকটু ভালো করার চেষ্টা থাকবেই। দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্তের পর এক যুগ পার হয়ে গেল। কখন যে এতটা সময় চলে গেল টেরও পেলাম না।