বড় হওয়ার উপায়
বর্তমানে সারা দেশে বিভিন্ন ধর্মীয় সভা থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলছে একই বিতর্ক—কার বয়ান/বক্তব্য সঠিক। শুধু যে এক বক্তা আরেক বক্তাকে কটাক্ষ করছেন তা কিন্তু নয় । তাঁরা অন্য ধর্মের মানুষ ও আচার-অনুষ্ঠানকেও নিকৃষ্ট বলে গালি দিচ্ছেন। এ যেন কার চেয়ে কে বড়, তারই এক অসুস্থ প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে সবাই। এ নিয়ে লিখতে গিয়েই মনে পড়ল ছাত্রজীবনে পড়া হরিশচন্দ্র মিত্রের ‘বড় কে’ কবিতার কথা—
‘আপনারে বড় বলে, বড় সেই নয়
লোকে যারে বড় বলে বড় সেই হয়।
বড় হওয়া সংসারেতে কঠিন ব্যাপার
সংসারে সে বড় হয়, বড় গুণ যার।
গুণেতে হইলে বড়, বড় বলে সবে
বড় যদি হতে চাও, ছোট হও তবে।’
তাই, আজ স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগে যাঁরা চিৎকার করে, অন্যকে কটাক্ষ করে নিজেদের বড় বলে জাহির করছেন, তাঁরা কি বড়? নিশ্চয়ই না। কারণ, যে নিজেকে বড় বলে, সে কখনোই বড় হতে পারে না। বড় হওয়ার উপায়ও এই কবিতায় স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। আর, তা হলো বড় হতে হলে ছোট হতে হবে, বিনয়ী হতে হবে।
নিজেকে ছোট ও সবার সমান মনে করলে যে বড় ও মহান হওয়া যায়, তার প্রমাণ পাওয়া যায় হজরত উমর ফারুকের (রা.) জেরুসালেম যাওয়ার বর্ণনায়। তিনি যখন প্রখর রোদে উটের পিঠে চড়ে জেরুসালেম যাচ্ছিলেন, তখন তিনি উপলব্ধি করলেন, যে ভৃত্য তাঁর উটের রশি ধরে টানছেন, তাঁরও একটু আরাম দরকার। তখন তিনি তাঁর ভৃত্যকে বলেছিলেন, ‘আপনি উটের পিঠে বসুন, আর আমি লাগাম ধরে টানি।’ তখন ভৃত্য বলেছিলেন, ‘হে আমিরুল মুমেনিন, আমাকে দয়া করে লজ্জা দেবেন না।’ উত্তরে হজরত উমর (রা.) বলেছিলেন, ‘তুমি আল্লাহর কাছে আমাকে লজ্জিত করো না।’ শেষ পর্যন্ত ভৃত্য উটের পিঠে বসেন। সেই উটের লাগাম ধরে টেনে নিয়ে যান খলিফা হজরত উমর (রা.)। এই অবস্থা বর্ণনা করতে আমাদের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘উমর ফারুক’ কবিতায় লেখেন—
‘ভৃত্য চড়িল উটের পৃষ্টে, উমর ধরিল রশি
মানুষে স্বর্গে তুলিয়া ধরিয়া, ধুলায় নামিল শশী।’
কিন্তু দেখা যায়, অনেক মানুষ তাঁর নিজ স্বার্থ হাসিল করার ধান্দায় ছোট না হয়ে ছোট সাজে, ভালো মানুষ না হয়ে ভালো মানুষ সাজে। তার প্রমাণ পাওয়া যায়, সাধারণ জনগণের কথাতেই। তাঁরা বলেন, ‘ভোট এলে প্রার্থীরা এমন ব্যবহার করেন যে, মনে হয় তাঁরা জনগণের বন্ধু এবং তাঁদের চেয়ে ভালো মানুষ আর নাই। কিন্তু ভোট শেষে বিজয়ী প্রার্থীদের আর দেখাই পাওয়া যায় না।’ তার আরও বড় প্রমাণ পাওয়া যায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া এক ক্ষুধার্ত মানুষকে একটি কলা দানের ঘটনায়। ছবিতে দেখা যায় কয়েকজন মানুষ এক ক্ষুধার্ত বৃদ্ধকে একটি কলা দিচ্ছেন। প্রশ্ন হচ্ছে এভাবে কি সত্যিই বড় হওয়া যায়? মোটেই না। কারণ, বড় হতে ভালো মানুষ হতে হয়, ভালো মানুষ সাজতে হয় না। আর ভালো মানুষ হতে হলে দান-খয়রাতের সময় ক্যামেরা বাসায় রেখে আসতে হয়। এ প্রসঙ্গে শ্রী শ্রী অনুকূল ঠাকুর বলেন, ‘সাধু সেজ না, সাধু হও।’
যারা নিজেকে অনেক জ্ঞানী বলে জাহির করে, তারা কখনোই জ্ঞানী ও বড় হতে পারে না। বরং ইতিহাস বলে তারা ঘৃণার পাত্রই হয়। চরিত্রগুণে যেসব মহান ব্যক্তি পৃথিবীতে বড় হয়ে অমরত্ব লাভ করেছেন, তাঁদের জীবনী পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তাঁরা কেউই অন্যকে ছোট করে দেখেননি, অন্যের সমালোচনা করেননি। বরং তাঁরা ছিলেন বিনয়ী। তাঁরা সবাই ভালো মানুষ ছিলেন, কেউই ভালো সাজেননি। হজরত মুহাম্মদ (স.) বিনয় দ্বারাই মানুষের মন জয় করেছিলেন। বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক শ্রী গৌতম বুদ্ধ থেকে শুরু করে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বা হাজি মুহম্মদ মহসীন—তাঁরা সবাই বিনয় দিয়েই মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসা পেয়েছিলেন। অন্যদিকে, অনেক প্রতাপশালী অহংকারী রাজাও হয় সময়ের স্রোতে বিলীন হয়ে গেছেন, নয়তো ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন। মানুষ তাঁদের ঘৃণা করেছে; মনে রাখেনি। তাই, বড় হতে হলে আগে নিজেকে ছোট ভাবতে হবে এবং অন্যকে বড় বলে সম্মান করতে হবে। মনে রাখতে হবে, চিৎকার করে, অন্যকে কটাক্ষ করে কখনো বড় হওয়া যায় না।