ভালোবাসার নিবন্ধন

কোন ফেব্রুয়ারির হালকা শীতের খুব মিষ্টি একটা সকাল, কার্জন হলের পদার্থবিদ্যা বিভাগের মেইন ভবনের সামনের ঘাসে একটা আদুরে বিড়াল রোদ তাপাচ্ছিল। প্রথম দুটো ক্লাসেই মিডটার্মের অপটিকস পরীক্ষাটা শেষ হয়ে গেল। পরীক্ষা শেষে মেয়েটি তড়িঘড়ি করে অডিটোরিয়াম থেকে বেরিয়ে সরু করিডোর পার হয়ে রাস্তায় এসে পড়ল। উদ্দেশ্য বিজ্ঞান কারখানার সামনে মোস্তাফার চায়ের স্টল, পরীক্ষার টেনশনে সাত সকালে কিচ্ছু পেটে পড়েনি তার। ছেলেটিও কালো হ্যাভারস্যাক কাঁধে ঝুলিয়ে মেয়েটির পিছু পিছু আসছিল, সুযোগ বুঝে পেছন থেকে চাপা গলায় ডাকল,

‘এই ইরা, শোন? আজকে তোর অন্য কোন প্ল্যান আছে?’
‘নাহ, সেইতো দুপুর দেড়টায় আরেকটা ক্লাস, এখন কিছু খেয়ে কমনরুমে যাব।’
‘তোকে কিচ্ছু খেতে হবে না, আমার সঙ্গে এক জায়গায় যাবি চল। দুপুরের ক্লাস বাং মারতে হবে, পারবি তো?’
‘কি বলিস? ক্লাস ফাঁকি কেন দেব? তোর মতো ফাজিল নাকি আমি?’
‘চল না! সিনেমা দেখব একটা, পদ্মা নদীর মাঝি। অনেকেই দেখছে সিনেমাটা, খুব ভালো বানাইছে শুনলাম।’
‘সিনেমা দেখবি? তাইলে আমাদের গ্রুপের সবাইরে ডাকি, পরীক্ষা শেষে একটা ছোট্ট বিনোদন হয়ে যাক।’
এই কথায় খপ করে ইরার হাত চেপে ধরে মামুন, অযাচিতভাবে কাউকে এখন চায় না সে। কালকে রাতেই প্ল্যান করেছে মামুন, পরীক্ষা শেষে ইরাকে নিয়ে ক্যাম্পাস ছেড়ে চম্পট দেবে।
‘আরে নাহ, ওই গ্রুপ বাদ, কাউকে ডাকার দরকার নেই। শুধু তুই আর আমি যাব, এখন ভালো মেয়ের মতো চুপচাপ রিকশায় ওঠ।’
বাধ্য মেয়ের মতো ইরা দোয়েল চত্বর থেকে রিকশায় ওঠে। ক্লাস ফাঁকির কষ্টটা মনে কাঁটা বিঁধালেও মামুনকে পুরোপুরি না করে উঠতে পারে না। এখনো দুপুর হয়নি, কিন্তু অভিসার সিনেমা হলে লোক উপচে পড়ছে। আলো আঁধারিতে চমৎকার একটা সিনেমা দেখতে দেখতে ক্ষুধা ভুলে গিয়েছিল ইরা। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অসাধারণ এই উপন্যাসটা আগেই পড়া ছিল। তবুও সিনেমার ব্যাপারটা আলাদা। এভাবে বাসায় না জানিয়ে হুট করে সিনেমা হলে চলে আসার সূক্ষ্ম অপরাধবোধ ইরাকে মলিন করলেও মনটা ভরে ছিল অপার আনন্দে। ভিড় ঠেলে বের হওয়ার সময় ক্ষুধাটা আবার মাথা চাড়া দিল, এবারে কিছু খেতেই হবে ইরাকে।
‘এখন আমাকে কিছু একটা খাওয়া তুই, নইলে দেখবি মাথা ঘুরে এই রাস্তার মধ্যে পড়ে গেছি।’
‘তুই তো দেখি গাড়ির মতো, তেল শেষ হলেই ফুস, আর চলতে চাস না। দাঁড়া, কোথাও খাই তাহলে?’
যে কথা সেই মোতাবেক কাজ, কিছুক্ষণের মধ্যে দুজন রদ্যেভুঁ রেস্টুরেন্টে। ধোঁয়া ওঠা স্যুপের বাটির সামনে বসে চারপাশটা খুব সাবধানে দেখে নিল ইরা, পরিচিত কেউ আছে কিনা। এই দুপুর তিনটায় কত অফিস করা মানুষ এসেছে খেতে, যদিও হালকা নীল আলো চারদিকে, কাউকে তেমন স্পষ্ট চেনা যায় না। তারপরও কে কখন দেখে ফেলে, এসব নিয়ে ইরা খুব তটস্থ থাকে। মামুনের কিন্তু এসব নিয়ে কোনই ভ্রুক্ষেপ নেই, সে ভীষণ বেপরোয়া স্টাইলে কথা বলে যাচ্ছে, হাসছে। আজকেও তাদের দুজনকে দেখে ফেললেও অপ্রস্তুত হওয়ার ভয় নেই মামুনের। মামুন চিরটাকালই এমন ধরনের, কোন কিছু গায়ে না মাখা গোঁয়ার স্বভাবের।
‘আচ্ছা, তোর কোন পছন্দের মেয়ে নাই?’
আচমকা প্রশ্ন করে বসে ইরা। মামুন এই প্রশ্নে অবাক না হয়ে কান পর্যন্ত হাসিটা টেনে উত্তর দেয়,
–‘কেন? কোটি কোটি সুন্দরী আছে আমার পছন্দের লিস্টে।’
একটা ছোট্ট বাঁকা হাসি ঠোঁটে ছড়িয়ে আবারও ইরা বলে,
–‘কোটি খানিক? তারা কই সব? এখানে এনে ট্রিট দিচ্ছিস না কেন?’
–‘তুই পাগল নাকি! ওদের দশজনকেও যদি এখানে ডাকি, তাহলে আমার মাসের টিউশনির পুরা টাকাটাই গায়েব হয়ে যাবে। কেন সুন্দরী, তোর দুঃখ কি? তোকে ট্রিট দিচ্ছি, এটা ভালো লাগছে না? ভালো না লাগলে বল আইসক্রিমের অর্ডারটা বাতিল করে দিই।’
ভিন্ন রকম একটা দিন কাটিয়ে বিকেলে যখন ইরা রিকশা করে বাড়ি ফিরছিল, তখন রাস্তায় ছিল বেশ ট্রাফিক জ্যাম। চারদিকে আজকে এত মানুষ কেন? কেমন যেন হই হই একটা ভাব। দিনটা শেষ হয়ে আসতে চাইলেও মানুষের আনন্দগুলো যেন ফিকে হতে চাইছে না। শাহবাগের মোড়ে এসে মামুন রিকশা থামাল, পাশের ফুটপাথ থেকে বেছে বেছে একটা রজনীগন্ধার তোড়া কিনল। রিকশায় বসে থাকা ইরার দিকে ফুলের তোড়াটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল—
–‘নে ধর, এই লোকের কাছে এর থেকে আর ভালো ফুল নেই। এগুলোই নে আপাতত, আমারে উদ্ধার কর।’
–‘আমি কি তোর কাছে ফুল চাইছি? ফ্রেশ ফুল না থাকলে কেনার দরকার নেই, চলে আয়।’
পান খাওয়া লাল লাল পুঁই বিচির মতো দাঁত বের করে ফুলওয়ালা বলল,
–‘আফামনি, আইজক্যা ভালোবাসা দিবস, বেবাগ মাইনষ্যে ফুল কিনছে। আমার বালতির সব ফুল বেচন শ্যাষ। ভাইজানের লগে ভ্যাজাল না কইরা লইয়া লন।’
হতবাক ইরা ভেবে পায় না, ওই শাহবাগী ফুলওয়ালা তাকে কোন দিবসের কথা বলল। বিস্মিত চোখে ভ্রু কুচকে থাকা ইরার মুখের দিকে তাকিয়ে মামুন বুঝেছিল, সত্যি ইরা হয়তো জানে না আজকের দিবসের মর্ম। ইরাটা এত্তো বোকা, ছয়-সাত ঘণ্টা একটা ছেলের সঙ্গে একান্তে কাটানোর পরও বুঝলোনা, এটি কোন সাধারণ ঘটনা নয়!
–‘তুই সাবধানে বাড়ি যা। আর একটা কথা, বাসায় যায় যায় দিন পত্রিকা থাকলে শফিক রেহমানের লেখা কলামটা একটু পড়ে নিস।’
সেদিন মনের মধ্যে রহস্যের কুয়াশা নিয়ে বাড়ি ফিরেছিল ইরা। অভিসার সিনেমা হল, পদ্মা নদীর মাঝি, রন্দ্যেভুঁ রেস্টুরেন্ট, রজনীগন্ধার তোড়া, ফুলওয়ালার হাসি, পরিশেষে শফিক রেহমানের কলাম। এরা সবাই ভালোবাসা দিবস চিনিয়েছিল। কিন্তু একজন সেদিন ইরাকে ভালোবাসার সন্ধান দিয়েছিল, সে অবশ্যই মামুন।