ভিন্ন বর্ণের বলেই কি এত প্রশ্ন

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ক্ষমতায় এসে ইতিহাসে এই প্রথম মন্ত্রিপরিষদে বর্ণবৈচিত্র্যময় একটি পরিবেশ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। নির্বাচনী প্রচারণায়ও তিনি এমন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তবে মন্ত্রিপরিষদের শীর্ষস্থানীয় কিছু ব্যক্তিকে নিয়ে দলের উদারনৈতিক মহলেই প্রশ্ন উঠেছে।

বাইডেনের বাছাই করা ভিন্ন বর্ণের মনোনীত প্রার্থীরা সাবেক ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তাদের চেয়ে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারবে কি না বা বেশি তদন্তের মুখোমুখি হচ্ছে কিনা, এ নিয়ে হতাশাও বিরাজ করছে কিছু ডেমোক্র্যাটের মধ্যে। অফিস অফ ম্যানেজমেন্ট ও বাজেট ডিরেক্টর হিসেবে মনোনীত নীরা টান্ডেনের মতো কয়েকজন প্রার্থী উচ্চতর তদন্তের মধ্যে রয়েছেন। তাঁদের তদন্তে বিলম্বের কারণে বাইডেন প্রশাসনের কাজকর্ম এগিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা ব্যাহত হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

সিনেটে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের শীর্ষস্থানীয় দুজন কৃষ্ণাঙ্গ প্রার্থীর মনোনয়ন এর মধ্যেই নিশ্চিত হয়েছে। এঁরা হলেন জেনারেল লয়েড অস্টিন (প্রতিরক্ষা সচিব) ও লিন্ডা থমাস গ্রিনফিল্ড (জাতিসংঘে মার্কিন রাষ্ট্রদূত)। আরেকজন হলেন হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগের প্রথম ল্যাটিনো মন্ত্রী আলেজান্দ্রো মায়োরকাস। তবে এখনো সিনেটে বর্ণভিত্তিক অন্যান্য মনোনীতপ্রার্থী নিশ্চিত নিয়োগের অপেক্ষায় রয়েছেন। তারা আগের চেয়ে কঠিন সময়ের মুখোমুখি।

প্রেসিডেন্ট বাইডেনের কৃষ্ণাঙ্গসহ বর্ণবৈচিত্র্যের অন্যান্য সদস্যের মনোনীত করার ব্যাপারে বিভিন্ন রাজনীতিবিদ ও সমালোচকেরা প্রশ্ন তুলছেন। ন্যাশনাল আরবান লীগের সভাপতি ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মার্ক মরিয়েল বলেন, ‘আমি এটিকে বাইডেন প্রশাসনের মূলনীতি বলব না। তবে বিভিন্ন মহল থেকে বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।’

গত বছর পুলিশ হেফাজতে জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর পর বর্ণবাদবিরোধী বিক্ষোভের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে আরও বৈচিত্র্যময় নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তার প্রতি আলোকপাত করেছিলেন বাইডেন। সমালোচকেরা ধারণা করছেন, সে কারণেই বাইডেনের মনোনীত বর্ণবৈচিত্র্যের প্রার্থীরা বেশি সুবিধা পাচ্ছেন। কিছুদিন আগে ক্যাপিটল হিলে হামলার হিংস্রতা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অভিশংসনের ব্যাপারে যে সব সমস্যার সূত্রপাত হয়েছিল, বাইডেনের প্রার্থী মনোনয়নের বেলায় সে সব সামনে চলে আসতে পারে।

রিপাবলিকান দলের সিনেটররা বাইডেন মনোনীত প্রার্থীদের বিষয়ে এমন সব আদর্শিক ও নীতিগত উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, যা তাদের মনোনয়নের ব্যাপারটি নিশ্চিত করতে জটিল প্রশ্ন তুলছে। বলা হচ্ছে, তাদের সমালোচনামূলক ভাষার ব্যবহার ও বর্ণবাদী আচরণের ওপর নির্ভর করে, ব্যক্তিগত দিকে টেনে এনেছিল।

মনোনীত ব্যক্তিদের মধ্যে ক্যালিফোর্নিয়ার প্রথম ল্যাটিনো অ্যাটর্নি জেনারেল হয়ে যাওয়া ম্যাক্সিকান অভিবাসীর ছেলে এক্সজাভিয়ার বেকেরাকে নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বলা হচ্ছে, তিনি চিকিৎসক না হয়েও স্বাস্থ্য ও মানবসেবা বিভাগের নেতৃত্বে যাচ্ছেন। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অধীনে আগের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন অ্যালেক্স আজার, তিনিও চিকিৎসক ছিলেন না। হেরিটেজ অ্যাকশন ফর আমেরিকা তাদের একটি বিজ্ঞাপনে বলেছে, বেকেরা চিকিৎসক নন। তবে, তিনি রাজনৈতিকভাবে সংযুক্ত মাদক ব্যবসায়ীকে বিল ক্লিনটনের কাছ থেকে সুবিধা আদায় করে দিয়েছিলেন।

দেব হালান্ড, স্বরাষ্ট্র বিভাগের নেতৃত্ব দেওয়া নিশ্চিত হলে প্রথম নেটিভ আমেরিকান হিসেবে মন্ত্রিপরিষদে স্থান পাবেন তিনি। তিনি উগ্রবাদী বলে প্রশ্ন উঠেছে। তাঁর অভিজ্ঞতা নিয়েও কিছু রিপাবলিকান সিনেটর প্রশ্ন তুলেছেন। এই সপ্তাহে নিউ মেক্সিকোকে উপস্থাপন করার সময় আগের কয়েকটি উগ্র বক্তব্য ও আচরণ নিয়ে হালান্ডকে জোরালোভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল।

বাইডেন তাঁর বিচার বিভাগের শীর্ষ পদে মনোনয়ন দিয়েছেন এমন দুই বর্ণের নারীকে, যারা তদন্তের মুখে পড়েছেন। ভারতীয় মার্কিন ভিনিটা গুপ্ত প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সহযোগী অ্যাটর্নি জেনারেল পদে মনোনয়ন পেয়েছেন। জুডিশিয়াল ক্রাইসিস নেটওয়ার্কের একটি বিজ্ঞাপনে তাঁকে ‘বিপজ্জনক নিয়োগ’ হিসেবে দেখানো হয়েছে। চিত্রগুলোতে দেখা যায়, ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনে বেশ কিছু বিক্ষোভের সময় তাঁকে গুলি-বুলেট, লুটপাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে আগুন লাগানোর ছবিতে তাঁকে দেখা গিয়েছিল।

ভিনিটা গুপ্তসহ সিভিল রাইটসের সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল পদে বাইডেন মনোনীত কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিস্টিন ক্লার্কের বিরুদ্ধেও আপত্তি তুলেছেন রিপাবলিকান সিনেটর মাইক লি। তিনি সমালোচনা করে বলেন, ক্লার্ক এমন একজন লেখককে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আমন্ত্রিত করেছিলেন, যাকে একটি গোষ্ঠীর প্রতি বিদ্বেষী হিসেবে দেখা গিয়েছিল বক্তৃতার সময়। তাঁর ওই সময়কার অনভিজ্ঞ সিদ্ধান্তকে অবশ্য পরে তিনি ভুল হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন।

নীরা টেনডেন প্রথম দক্ষিণ এশীয় মার্কিন যিনি অফিস অফ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড বাজেট বিভাগের দায়িত্ব পাবেন, তিনি ‘কম্বেটিভ টুইট’–এর সমালোচনায় পড়েছেন। পশ্চিম ভার্জিনিয়ার ডেমোক্র্যাট সিনেটর জো মানচিন গত সপ্তাহে ঘোষণা করেছেন, সিনেটের কোনো রিপাবলিকান টেনডেনকে ভোট না দিলে তিনি তাঁকে সমর্থন করবেন না।

ইউনিডোস ইউএসএর সভাপতি ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জেনেট মার্গুয়া বলেন, বেকেরা বা দেব হালান্ডের মতো ব্যক্তিদের মনোনয়ন দেখার পর তিনি তাদের সঠিক অভিজ্ঞতা আছে কিনা, এ নিয়ে দ্বিধায় পড়েছেন।

প্রেসিডেন্ট বাইডেনের মনোনীত ব্যক্তিদের যেভাবে মাইক্রোস্কোপের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে, তা নিয়ে মন্তব্য করেছেন ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের প্রশাসনিক গবেষণার সিনিয়র সহযোগী নিকল টার্নার লি। তিনি সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ, বারাক ওবামা ও ট্রাম্প প্রশাসনে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের জাতিগত ও নৈতিক পটভূমি নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। মনোনীত ব্যক্তিদের প্রগতিশীল মূল্যবোধগুলো নির্ধারণ করে নিবিড়ভাবে তদন্ত করা হচ্ছে কিনা এবং নীতি সম্পর্কে কথোপকথনের ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার পরীক্ষায় নাগরিক অধিকারকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন নিকল লি।

এমরি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন রাজনীতি বিশেষজ্ঞ আন্ড্রা গিলস্পি বলেন, ‘আমরা জানি, ভিন্ন বর্ণ ও নারীদের সঙ্গে অন্যরকম আচরণ করা হয়। তাই, এ ব্যাপারে বিশ্লেষণের একটি বিকল্প পরীক্ষা করা দরকার।

ট্রাম্প প্রশাসনের বেপরোয়া অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে জনগণ বাইডেনকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত করেছে। জনগণের আশা অনুযায়ী বাইডেন প্রতিশ্রুতি রক্ষার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ইতিহাসে এই প্রথম সিনেটে বর্ণবৈচিত্র্য মনোনীত প্রার্থীদের বেশ দেখা যাচ্ছে। তবে সেটা যেমন একদিকে বাইডেনকে ভিন্ন বর্ণের মানুষের কাছে নায়ক হিসেবে উপস্থাপন করছে, তেমনি আবার শ্বেতাঙ্গ লোকজনের কাছে বাইডেন সমালোচিতও হচ্ছেন।