ভোট দেননি অসংখ্য তরুণ

যতটা উৎসাহ দেখা গিয়েছিল, ভোট কেন্দ্রে সে তুলনায় তরুণ ভোটারদের দেখা যা্য়নি
ছবি: রয়টার্স

যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের মধ্যে নির্বাচন বা ভোট নিয়ে আগ্রহ তুলনামূলক কম। জনসংখ্যার অনুপাতে ভোটদানে আগ্রহী মানুষের সংখ্যার বিচারে এ দেশের অবস্থান ৩১তম। অতীতের নির্বাচনের পরিসংখ্যান বিচার করলে দেখা যায়, বেশির ভাগ নির্বাচনে ৫০ শতাংশ বা তার চেয়েও কম মানুষ ভোট দিয়েছেন। ২০১২ সালে রেকর্ড পরিমাণ ৫৩ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষ ভোট দেন। ইউরোপের কোনো কোনো দেশে যেমন বেলজিয়াম ও সুইডেনে প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ ভোট দিয়ে থাকেন।

যুক্তরাষ্ট্রে আরও বেশিসংখ্যক মানুষকে ভোটে উৎসাহিত করতে সাপ্তাহিক ছুটির দিন শনি বা রোববার ভোট গ্রহণ করা হোক—এমন একটি প্রস্তাব এই মুহূর্তে কংগ্রেসের বিবেচনায় রয়েছে। তবে এ নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে কোনো পক্ষেরই তাগাদা লক্ষ্য করা যায় না। এ দেশের মানুষের মধ্যেও এ নিয়ে কোনো তাড়া নেই।

১৮৪৫ সালে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, নভেম্বরের প্রথম সোমবারের পরের মঙ্গলবার সারা দেশে একসঙ্গে ভোট হবে। রোববার এই দিন নির্ধারণ করা হোক, এমন এক প্রস্তাব তাৎক্ষণিকভাবে বাতিল হয়। কারণ, রোববার সবাই সাপ্তাহিক প্রার্থনায় যোগ দিতে গির্জায় যায়।

যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৩৩ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় ১৫ কোটি ৩ লাখ মানুষ নিবন্ধিত ভোটার। করোনাভাইরাসের কারণে এবার ডাকোযোগে ও আগাম ভোট দিয়েছেন প্রায় ৯ কোটি ৭০ লাখ ভোটার।

গত কয়েক দশক ধরে অনেক রাজ্যেই ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে নতুন নতুন সুবিধা দিচ্ছে। এর মধ্যে আছে একদিনে ভোটার নিবন্ধনের সুযোগ, বেশি সময়ের জন্য ভোটকেন্দ্র খোলা রাখা, আগাম ভোট দেওয়া বা ডাকযোগে ভোট দেওয়ার মতো বিকল্প ব্যবস্থা।

এবার প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে ভোটারদের ব্যাপক আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়। ৫ নভেম্বর পর্যন্ত সিএনএনের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ১৪ কোটির কাছাকাছি মানুষ দিয়েছে। এখনো গণনার বাকি আছে বিপুল সংখ্যক ভোট। এরপরও অনেক তরুণ ভোট দিতে যাননি। এদের মধ্যে কয়েকজনের কথা প্রথম আলোর এই প্রতিবেদকের।

তরুণ মার্কিন মারিয়া কার্লোস এবার ভোট দেননি। কেন দেননি প্রশ্নে তিনি বলেন, তাঁর দাদা ডাক্তার ছিলেন। এখনো তার দাদা শিক্ষাঋণ শেষ করতে পারেননি। মারিয়ারও শিক্ষাঋণ নেওয়া আছে। রাজনীতিবিদরা শিক্ষাঋণ নিয়ে কোনো পরিষ্কার ধারণা দিতে পারেননি। যে দলই জয়ী হোক না কেন, এসব ব্যবস্থার কোনো পরিবর্তন হবে না। সব মিলিয়ে এবার কোনো প্রার্থীর প্রতি তাদের পরিবারের কোনো আগ্রহ নেই বলে ভোট দেননি।

টেং কিয়া চীন থেকে পড়তে এসে মার্কিন বিয়ে করে নাগরিক হয়েছেন। তিনি বলছেন, রাজনীতি তার পছন্দ নয়। ভোট হবে, যার ইচ্ছা ভোট দেবে। তিনি প্রশ্ন করেন, এসব নিয়ে কেন এত প্রচার। রাজনীতি নিয়ে কেন এত ভালো আর মন্দের যুদ্ধ? যে দেশে করোনায় দুই লাখের বেশি মানুষ মারা যায়, সে দেশে দুই দলই শুধু নির্বাচনী প্রচারের পেছনে বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে, আমি তাদের ভোট দিতে পারি না। তাই দিইনি।

ক্যাথলিন ফেরারেল লং আইল্যান্ড নর্থ শোর হাসপাতালের একজন রেজিস্টার্ড নার্স। তিনি বলেন, তার হাতে ভোট দেওয়ার সময় ছিল না। আবারও করোনায় সংক্রমিত রোগী বাড়ছে। আর কাজ থেকে ছুটি নিয়ে ভোট দেওয়ার কোনো মানে হয় না।

শিক্ষার্থীরা বলেন, এবারের প্রেসিডেন্ট প্রার্থীদের কেউই তাদের পছন্দের না। এরা কেউই তরুণ প্রজন্ম নিয়ে ভাবছেন না। তরুণ সমাজের মেধা বিকাশের তেমন কোনো উদ্যোগ রাজনীতিতে থাকে না। হাইস্কুল শেষ করেই বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। উচ্চশিক্ষার অনেক খরচ

রুশ বংশোদ্ভূত স্টাচ গ্যালভোস্কি জব ভিসায় যুক্তরাষ্ট্রে কাজ করছেন। তিনি বলেন, নির্বাচন এখানে অনেকটাই খেলার মতো। কেউ জিতে, কেউ হারে। তবে মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন কমই চোখে পড়ে। যারা এটি পছন্দ করে, তারাই শুধু ভোট দিতে যায়। নির্বাচনে দেশের নেতা বদল হন, কিন্তু জাতীয় স্বার্থে এরা দলমত নির্বিশেষে এক থাকেন। এ দেশের সংবিধানে কোনো সরকারই হাত দেন না। এই নির্বাচন বেশির ভাগ তরুণের কাছে মনে হবে এটি একটা অদ্ভুত জগৎ, যা তাদের জন্য নয়। তাই তিনি ভোট দেননি।

লিচিট মেথিউ তরুণ ব্যবসায়ী। তিনি মনে করেন, ‘ভোট দিয়ে নেতা পরিবর্তন হয় ঠিকই। কিন্তু দেশের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না। ভোট দিয়ে মনে হয়, গণতন্ত্রকে উন্নত করতে হাত মিলিয়েছি, আসলে তা নয়। আমরা বর্তমানে ছোট ছোট জাতি–উপজাতি কিংবা বর্ণে বা দলে বিভক্ত। মানুষের মন দিনে দিনে সংকীর্ণ হয়ে উঠছে। তাই আমি ও আমার পরিবার কোনো সময়ই ভোটে আগ্রহ পাই না। এমনকি টিভি না চললে নির্বাচন সম্পর্কে জানাই হতো না।’

চেলসি, ভিক্টোরিয়া, রায়ান, সোফি, জামিল, অ্যালেক্স, জেরি, আন্দ্রেয়া—সবাই এবার প্রথমবার ভোটার এবং স্টুনিব্রুকের শিক্ষার্থী।

এই শিক্ষার্থীরা বলেন, এবারের প্রেসিডেন্ট প্রার্থীদের কেউই তাদের পছন্দের না। এরা কেউই তরুণ প্রজন্ম নিয়ে ভাবছেন না। তরুণ সমাজের মেধা বিকাশের তেমন কোনো উদ্যোগ রাজনীতিতে থাকে না। হাইস্কুল শেষ করেই বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। উচ্চশিক্ষার অনেক খরচ।

কেউ কেউ বলেন, পড়াশোনার পাশাপাশি তাদের কাজ করতে হয়। বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে মার্কিনদের পড়াশোনার সুযোগ কম। মার্কিনদের হাইস্কুল থেকে তুলে ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর কোনো পরিকল্পনা কোনো রাজনৈতিক দলের নেই। বরং অর্থ আর দলের ভেতরকার শক্তি দিয়ে তরুণদের দমনের চেষ্টা চোখে পড়ে। কেউ বলছেন, তার পরিবারে শুধু তিনিই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছেন। তাও খণ্ডকালীন জব করে।

অনেকেই বলছেন, এই দুই দল সব সময় নিজেরা প্রার্থী বাছাই করে। আমরা তাদের পছন্দের মানুষকে ভোট দিতে বাধ্য নই। এই দুটি দল মানুষের কথা ভাবে না। তরুণ ভোটার, যারা ক্রমবর্ধমান শিক্ষাঋণের মতো সমস্যার মধ্যে রয়েছে, তাদের গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। তাই তারা ভোট দিতে আগ্রহী হননি।

তরুণ ভোটারদের অনেকেই বলেন, বর্ণবাদের কারণে তাঁরা বিষণ্ন থাকেন। তারা স্পষ্ট দেখতে পান, তাদের পুরো দেশেই বন্ধুরা বর্ণবাদের শিকার হন। নির্বাচনের মাধ্যমে যতই নেতা বদল হোক না কেন, এ দেশে বর্ণবাদ বেড়েই চলছে।