মরুকন্যা দুবাই দর্শন

মধ্যপ্রাচ্যের দেশ আরব আমিরাতের রাজধানী দুবাই। দুদিনের ট্রানজিটে দুবাই শহর দেখার প্রত্যয়ে পরিবারের পাঁচ সদস্যের দল নিয়ে হাজির হলাম বিখ্যাত এ শহরে। নিউইয়র্ক থেকে এমিরাটসের বোয়িং ৭৭৭ এয়ারবাসের যাত্রী হলাম আমরা। ডাবল ডেকের বিমানের সিটগুলো মুহূর্তেই পরিপূর্ণ হয়ে গেল। তারপর শুরু হলো যার যার সিটের ওপরের বাঙ্কারগুলোতে হাতব্যাগ রাখার প্রতিযোগিতা। ব্যাগ ও বাঙ্কারের সংযোগে এক ধরনের ঘষামাজার শব্দ, আর বিমানে শো শো আওয়াজ বিরক্তির কারণ হলেও সবাই যেন মেনে নিচ্ছে তা আপন তাগিদে।
প্রায় অর্ধ দিবস আকাশ ও মেঘের সমান্তরালে ভাসতে ভাসতে দুবাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাগালে আসতেই গালফের সৈকত ও অত্যাধুনিক বৈদ্যুতিক বাতির ঝালর আমাকে এক রূপকথার রাজ্যে বিচরণের সুযোগ করে দিল। পাশের সিটে বসা আমার সাত বছরের নাতি সিয়াম ভোর রাতের ঘুমে তখনো বিভোর। আমি তাকে আলতো ধাক্কা দিয়ে বললাম, ‘তাকিয়ে দেখ বাইরের দৃশ্য।’ রাতভর গেম খেলে খেলে ভোর রাতে ঘুমের রেশ যেন কাটছে না তার। অতি কষ্টে বিমানের ডিম্বাকৃতি জানলা দিয়ে তাকিয়ে বলল, ‘ওয়াও।’ তারপর আবার ঘুম।
ইতিমধ্যে যাত্রীদের মধ্যে মৃদু প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল। কেউবা শৌচাগারে যেতে উদ্যত, কেউ তল্পিতল্পা গোছাতে ব্যস্ত। মনে হলো কিছুক্ষণের মধ্যেই বিমান ত্যাগের ঘোষণা আসবে। বিমানবালারা তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাকের সঙ্গে মানানসই পাগড়ি পরে লাইন করে দাঁড়িয়ে গেল নিজেদের জাতীয় ভাষায় বিমানযাত্রীদের শুভ বিদায় জানাতে। ইতিমধ্যে ঘোষণা এল, ‘আমরা দুবাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সুন্দরভাবে অবতরণ করেছি।’ স্থানীয় আবহাওয়া ও সময় জানিয়ে তাদের ঐতিহ্যবাহী বিমানে আবার যাত্রী হওয়ার আমন্ত্রণ জানাল তারা।
সবাই উঠে দাঁড়িয়ে বিমান ত্যাগে উদ্যত হলো। আমরাও বাংকারের ব্যাগগুলো যার যার হাতে নিয়ে ধীর পায়ে এগোতে লাগলাম। অভিবাসন আইনের পাঠ চুকিয়ে দুটো স্টলারে বাক্সপেটরা টানতে টানতে বাইরে এলাম। ওমা এ তো দেখি আমেরিকার অঙ্গরাজ্য ফ্লোরিডার কোনো এক বিমানবন্দর। একই তাপমাত্রা, সেই একই দৃশ্য। শুধু পাম আর খেজুর গাছ—এই যা পার্থক্য। বড় একটি গাড়ি নিয়ে হোটেলে পৌঁছালাম। তখন স্থানীয় সময় সকাল ৯টা। আমাদের চেকইনের সময় বেলা ১২টা। তিন ঘণ্টা কাটাতে হবে হোটেল লবিতে বসে। লবির সোফাগুলো দখল হয়ে গেছে অনেক আগেই। আমাদের মতো বহিরাগতরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে সেখানে। আমাদের সহযাত্রী ছোট ছেলে তামিম বলল, ‘এতক্ষণ বসে না থেকে দেখি আশপাশের কী অবস্থা।’ আমি বললাম, ‘কাউন্টারে জিজ্ঞেস করে জেনে নাও কাছে কোনো রেস্তোরাঁ আছে কি না। থাকলে ঘুরতে ঘুরতে সকালের নাশতাটা সেরে নেব।’ হোটেলের আঙিনায় রেস্তোরাঁ পাওয়া গেল। বিরাট হল ঘরে চেয়ার টেবিল সাজানো, কিন্তু একদম জনশূন্য। আমাদেরে দেখে এক নিগ্রো যুবক হাতে কয়েকটা মেনু নিয়ে এগিয়ে এল। মেনু দেখে খাবার চাহিদা একেবারেই ম্লান হয়ে গেল। শুধু শিশুতোষ কিছু খাবার নাতি সিয়ামের জন্য নেওয়ার সিদ্ধান্ত হলো। কিছু পাস্তা ও আইসক্রিম পেয়ে সিয়াম খুবই খুশি।
কিছুক্ষণ হেঁটেই মোড়ে ফাস্ট ফুডের একটা রেস্তোরাঁয় গিয়ে দেখি চিকেন কাবাবের সঙ্গে নানরুটি দিয়ে লোকজন দেদারসে খাচ্ছে। আমরাও খেলাম আরবি খানা। সবার নাশতা ও দুপুরের খাবার একসঙ্গে হয়ে গেল। হোটেলের পথে হাঁটতে হাঁটতে সময় গড়িয়ে বেলা প্রায় ২টা। ভাবলাম এখন নিশ্চয়ই আমাদের জন্য বরাদ্দকৃত কামরা তৈরি হয়ে গেছে। বিছানায় গা এলিয়ে একটু বিশ্রাম করে আবার ঘুরতে বের হব। কিন্তু হোটেলে ফিরেই মনটা আবার খারাপ হয়ে গেল। কাউন্টারে কর্মরত ভারতীয় লোকটা আমতা-আমতা করে বলল, ‘আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে।’ মনে হলো লোকটাকে কিছু কড়া কথা শুনিয়ে দিই। পরক্ষণেই ভাবলাম, ‘না তো করছে না যে, কামরা দেবে না।’ দশ-পনেরো মিনিটের মধ্যেই একটা সুরাহা হলো। লোকটার ইঙ্গিতে আমরা একটা চার চাকাবিশিষ্ট খোলা গাড়িতে বসলাম। ড্রাইভার মূল হোটেল থেকে পাঁচ মিনিট গাড়ি চালিয়ে এক বারান্দার সামনে এসে থামল। আমরা ভেতরে যেতেই এক লোক হাতে কার্ড ধরিয়ে দিয়ে ছয়তলায় ওঠার লিফট দেখিয়ে দিল।
মূল দরজায় কার্ড পুশ করতেই দরজা খোলার শব্দ পেলাম। বিশাল ডুপ্লেক্সের তিন বেড ও চার বাথরুমবিশিষ্ট অত্যাধুনিক এক অ্যাপার্টমেন্ট। দু-তিন ঘণ্টা বিশ্রাম নিয়ে আবার ঘুরতে বের হব ঠিক করলাম। নিচে নেমে সামনে তাকিয়ে দেখি দুবাই মল। পাশেই দণ্ডায়মান আকাশছোঁয়া অট্টালিকা বুর্জ খলিফা। রকমারি আলোকসজ্জায় মনে হচ্ছে বিশেষ কোনো দিনের স্মৃতি বহন করে চলেছে। কাছে পেয়ে এক লোককে জিজ্ঞেস করলাম হেঁটে যেতে কতক্ষণ লাগতে পারে। লোকটা জানাল, পাঁচ সাত মিনিট। চিহ্নিত কোনো ফুটপাত না দেখে অবাক হলাম। ভাবলাম পাঁচ-সাত মিনিট—এ আর এমন কী! লাইট ফলো করে আমরা হেঁটে চলেছি। আধা ঘণ্টা হেঁটে যখন গন্তব্যে পৌঁছালাম, তখন বুঝলাম বউয়ের অবস্থা খুব কাহিল, যেন আর চলতে পারবে না। একই অবস্থা নাতি সিয়ামের।
ছেলে তামিম সবাইকে মলের এক জাগায় বসিয়ে রেখে কিছুক্ষণ পরই ফিরে এল তার মায়ের জন্য একটি হুইলচেয়ার ও ছেলের জন্য স্ট্রলার নিয়ে। তারপর শুরু হলো ম্যারাথন চলা। কিছু কেনার উদ্দেশ্যে নয়, শুধু দেখা আর মধ্যপ্রাচ্যের প্রাচীন শিল্প ও সংস্কৃতিকে ধারণ করা। একসময় চলে এলাম বুর্জ খলিফা—সেই পৃথিবী বিখ্যাত সুউচ্চ স্থাপনার পাদদেশে। সে রাতের আলোকসজ্জায় সজ্জিত হয়েছিল সারা দুবাই। পাশের ঝিলে জলকেলির ফোয়ারা ও বুর্জ খলিফার রকমারি আলোর ঝলকানি মাতিয়ে দিয়েছিল দর্শনার্থীদের।
আমেরিকার একজন বিখ্যাত ডিজাইনার এডরিয়ান স্মিথের নকশায় ২০০৪ সালের ৬ জানুয়ারিতে শুরু হয় ১৬৩তলাবিশিষ্ট এ টাওয়ারের কাজ। প্রথমে যার নাম ছিল বুর্জ দুবাই। পরে দেশের প্রেসিডেন্টের নামানুসারে টাওয়ারের নাম রাখা হয় বুর্জ আল খলিফা। পৃথিবী বিখ্যাত বুর্জ আল খলিফার ১৫৪ তলায় গড়ে উঠেছে অ্যাকুরিয়াম। কেউ যদি একদিনের মধ্যে পরিদর্শন করতে চান, তবে জনপ্রতি ১৪৫ ডলার খরচ করতে হবে। তবে সময় হাতে নিয়ে অনলাইনে টিকিট সংগ্রহ করতে পারেন কম খরচে।

বুর্জ আল আরব জুমাইরা পৃথিবীবিখ্যাত এক অভিজাত হোটেলের নাম, যা দুবাইয়ের সমুদ্রসীমায় অবস্থিত। এর কামরা সংখ্যা ২০২। এক রাতের জন্য স্যুটের ভাড়া গুনতে হয় ২ হাজার মার্কিন ডলার। সাত তারাবিশিষ্ট এই হোটেলে নয়টি সুসজ্জিত রেস্তোরাঁ রয়েছে। পৃথিবীর বিখ্যাত ধনাঢ্য ব্যক্তিবর্গ তাঁদের ব্যক্তিগত হেলিকপ্টারে করে হোটেলের টপ ফ্লোরে অবস্থান করতে পারেন। গালফ সাগরের অনেক দূরে থেকে সাগরের ওপর ভাসমান হোটেলের দৃশ্য দেখা যায়। আমরা যখন ছবি তুলতে গেলাম, তখন সন্ধ্যা রাতের নীলাভ আলোতে ভাসছিল বুর্জ আল আরব জুমাইরা হোটেল। ফেরার পথে মনে হলো মধ্যপ্রাচ্যের বিখ্যাত সুইট বাকলাবার কথা, যা দুবাই মলের শোভা বৃদ্ধি করে। তামিম অনলাইনে খুঁজে নিল দোকানের অবস্থান। কেনা হলো এক কিলো মিষ্টি, যা বিভিন্ন ধরনের বাদাম ও মধু দিয়ে তৈরি। তারপর কিছু কৌতূহল ও কিছু স্বপ্ন নিয়ে চলে এলাম আমাদের হোটেল আলমোরজ কমপ্লেক্সে।
পরদিন হোটেল চেকআউটের সময় ছিল বেলা ১২টা। আমরা দাবি করলাম যেহেতু চেকইনে তিন ঘণ্টা দেরি হয়েছে, সেহেতু আমাদের চেকআউটের সময় বর্ধিত করতে হবে। কর্তৃপক্ষ রাজি হলো। দুবাই থেকে ঢাকার বিমান ছাড়ার স্থানীয় সময় রাত সোয়া ১টা। সুতরাং রাত দশটায় দুবাই বিমানবন্দরে পৌঁছাতে হবে। দিনের অতিরিক্ত সময়টা পার করতে সিটির অন্য কোনো বিখ্যাত স্থাপনা খুঁজতে হবে। বাক্সপেটরা হোটেলের জিম্মায় রেখে আমরা চলে এলাম দুবাই ওল্ড মার্কেটে, যেখানে মধ্যপ্রাচ্যের মসলা থেকে সোনা জহরত সবকিছু পাওয়া যায়। এক বড় সোনার দোকানের সামনে প্রচণ্ড ভিড় দেখে আমরাও এগিয়ে গেলাম। দেখি বিদেশি পর্যটকেরা লাইন ধরে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে। আমি এক ইউরোপীয়কে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এখানে কী হচ্ছে।’ সে বলল, ‘পৃথিবীর বিখ্যাত ডায়মন্ড রিং দোকানের কাচের ভেতরে শোভা পাচ্ছে। তাই সবাই এর ছবি তুলতে ব্যস্ত।’
পরে আমরাও ডায়মন্ড রিংয়ের পাশে দাঁড়িয়ে কিছু ছবি তুললাম। ওল্ড আর গোল্ড দেখে দেখে প্রচণ্ড ক্ষুধা লেগে গেল। খাবার দোকান খুঁজে খুঁজে হাজির হলাম এক ডেরায়। মনে হলো পুরান ঢাকার কোন গলির রেস্তোরাঁয় হাজির হয়েছি। তন্দুরি রুটি ও কড়াই চিকেন দিয়ে পেটপুরে ভোজন শেষে বিদায় হলাম। তারপর হোটেল থেকে সবকিছু নিয়ে সোজা বিমানবন্দর।