মাঙ্কিপক্স কী ও যেভাবে ছড়ায় এটি

মাঙ্কিপক্স
ছবি: রয়টার্স

করোনা মহামারির প্রাদুর্ভাব কমতে শুরু করলেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এখন মাঙ্কিপক্স নামের বিরল একটি রোগ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। উত্তর আমেরিকা, ইউরোপসহ বেশ কয়েকটি দেশে মাঙ্কিপক্সের এক উল্লেখযোগ্যসংখ্যক রোগী শনাক্ত হয়েছেন। চলতি মাসের শুরু থেকে এ সংক্রমণ বাড়ছে। এরই মধ্যে এ রোগ আফ্রিকার কিছু অংশে উদ্বেগজনকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। এ প্রেক্ষাপটে আজ শুক্রবার বিবিসি মাঙ্কিপক্স কী ও কীভাবে এ রোগ সংক্রমিত হয়, এক প্রতিবেদনে তা তুলে ধরেছে।          

মাঙ্কিপক্স বিরল ও স্বল্পপরিচিত একটি রোগ। এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনাগুলো নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশ, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া।

যুক্তরাজ্য আজ নিশ্চিত করেছে, দেশটিতে মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। এখন পর্যন্ত রোগী শনাক্ত হয়েছেন মোট ২০ জন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী সাজিদ জাভেদ বলেছেন, নতুন করে ১১ জন আক্রান্ত হয়েছেন। তবে আক্রান্ত ব্যক্তিদের অধিকাংশের উপসর্গ মৃদু।

মাঙ্কিপক্স মোকাবিলায় যুক্তরাজ্যের সরকার স্মলপক্স বা গুটিবসন্তের টিকা কিনে মজুত বাড়াচ্ছে।

মাঙ্কিপক্স কতটা সাধারণ

মাঙ্কিপক্স সংক্রমণের পেছনে রয়েছে মাঙ্কিপক্স নামের ভাইরাস। এটি স্মলপক্স ভাইরাস শ্রেণির। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাঙ্কিপক্স এখন পর্যন্ত কম গুরুতর ও এটির সংক্রমণের সক্ষমতা তুলনামূলক কম বলেই ধারণা করছেন তাঁরা।

নতুন রোগটি ক্রান্তীয় রেইনফরেস্ট অঞ্চলের কাছাকাছি মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকার প্রত্যন্ত অংশে বেশি দেখা যাচ্ছে।

মাঙ্কিপক্স ভাইরাসের প্রধান দুটি ধরন—পশ্চিম আফ্রিকান ও মধ্য আফ্রিকান।

মাঙ্কিপক্সের প্রাথমিক লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে জ্বর, মাথাব্যথা, ঘেমে যাওয়া, পিঠে ব্যথা, মাংসপেশির টান ও অবসাদ। জ্বর কমলে শরীরে দেখা দেয় ফুসকুড়ি। অধিকাংশ ঘটনায় শুরুতে মুখে ফুসকুড়ি দেখা দেয়। পরে অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে; বিশেষ করে হাতের তালু ও পায়ের তলায়।

যুক্তরাজ্যে এ ভাইরাসে আক্রান্ত দুই ব্যক্তি আফ্রিকার দেশ নাইজেরিয়া ভ্রমণ করে এসেছেন। তাই ধারণা করা হচ্ছে, তাঁরা ভাইরাসটির পশ্চিম আফ্রিকান ধরনে আক্রান্ত হয়েছেন। এই ধরনে আক্রান্ত ব্যক্তির উপসর্গ সাধারণভাবে মৃদু বলে ধরা হলেও তা এখনো নিশ্চিত নয়।

আক্রান্ত ব্যক্তিদের আরেকজন, একজন স্বাস্থ্যকর্মী। তিনি মাঙ্কিপক্স রোগীদের সংস্পর্শে আক্রান্ত হয়েছেন।
সম্প্রতি সংক্রমণের যেসব ঘটনা শনাক্ত হয়েছে, সেগুলোর একটির সঙ্গে অপরটির কোনো যোগসূত্র থাকা বা সংশ্লিষ্ট রোগীদের বিদেশ ভ্রমণের ইতিহাস নেই। দৃশ্যত, তাঁরা যুক্তরাজ্যের ভেতর সামাজিক সংক্রমণের শিকার হয়েছেন।

যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা সংস্থা বলছে, যদি কেউ মনে করে থাকেন, তিনি মাঙ্কিপক্সে সংক্রমিত হয়েছেন, তাঁর উচিত চিকিৎসককে দেখানো। তবে হাসপাতাল বা ক্লিনিকে যাওয়ার আগেই এ বিষয়ে জানাতে হবে।

মাঙ্কিপক্সের প্রাথমিক লক্ষণসমূহ

প্রাথমিক লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে জ্বর, মাথাব্যথা, ঘেমে যাওয়া, পিঠে ব্যথা, মাংসপেশির টান ও অবসাদ। জ্বর কমলে শরীরে দেখা দেয় ফুসকুড়ি। অধিকাংশ ঘটনায় শুরুতে মুখে ফুসকুড়ি দেখা দেয়। পরে শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে; বিশেষ করে হাতের তালু ও পায়ের তলায়।

ফুসকুড়িগুলো অত্যন্ত চুলকানি সৃষ্টি করতে পারে। চূড়ান্ত পর্যায়ে খোস-পাঁচড়ায় পরিণত হওয়ার আগে এগুলো পরিবর্তিত হয় ও কয়েকটি ধাপ অতিক্রম করে। পরে এগুলো পড়ে যায় এবং এসব স্থানে ক্ষতচিহ্ন তৈরি হতে পারে।

সাধারণত সংক্রমণ একপর্যায়ে নিজে থেকেই কেটে যায়। ১৪ থেকে ২১ দিনের মধ্যে সেরে ওঠেন রোগী।

যেভাবে সংক্রমিত হয়

কোনো সংক্রমিত ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এলে মাঙ্কিপক্স ছড়াতে পারে। ভাইরাসটি শরীরে প্রবেশ করে ভঙ্গুর ত্বক, শ্বাসনালি, চোখ, নাক বা মুখের মাধ্যমে।

যৌন সম্পর্কের মাধ্যমে এ রোগ ছড়াতে পারে—আগে এমনটা বলা না হলেও এখন ধারণা করা হচ্ছে, যৌন মিলনের সময় সরাসরি সংস্পর্শে এ ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটতে পারে।

সংক্রমিত বানর, ইঁদুর ও কাঠবিড়াল এবং ভাইরাসযুক্ত বস্তু যেমন বিছানাপত্র ও জামাকাপড়ের সংস্পর্শে এলেও ছড়াতে পারে ভাইরাসটি।

কতটা বিপজ্জনক এটি

এ পর্যন্ত মাঙ্কিপক্স সংক্রমণের যত ঘটনার কথা জানা গেছে, তাতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে উপসর্গ মৃদু হতে দেখা গেছে। কখনো কখনো লক্ষণগুলো ছিল চিকেনপক্স বা জলবসন্তের মতো। কয়েক সপ্তাহে তা নিজে থেকেই সেরে গেছে।

মাঙ্কিপক্স কখনো গুরুতর হয়ে উঠতে পারে। ঘটতে পারে মৃত্যুও। যেমনটা খবর পাওয়া গেছে পশ্চিম আফ্রিকায়।

একজন সংক্রমিত ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এলে মাঙ্কিপক্স ছড়াতে পারে। ভাইরাসটি শরীরে প্রবেশ করে ভঙ্গুর ত্বক, শ্বাসনালি, চোখ, নাক বা মুখের মাধ্যমে।

সংক্রমণ কতটা সাধারণ

এ ভাইরাস প্রথম শনাক্ত হয় একটি আবদ্ধ বানরের শরীরে। ১৯৭০ সাল থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন সময় আফ্রিকার ১০টি দেশে বিক্ষিপ্তভাবে এর সংক্রমণ ঘটতে দেখা গেছে।

আফ্রিকার বাইরে প্রথম ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে এ ভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়। সে সময় রোগীরা ভাইরাসটিতে সংক্রমিত হয়েছিলেন কিছু কুকুরের নিবিড় সংস্পর্শে। আর এসব কুকুরের শরীরে এ ভাইরাস ঢুকেছিল ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মাধ্যমে। ওই সময় মোট ৮১ জন এ রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন বলে জানা যায়। তবে কারও মৃত্যু হয়নি।

আরও পড়ুন

২০১৭ সালে নাইজেরিয়ায় মাঙ্কিপক্স কিছুটা ছড়িয়ে পড়ে। জানা যায়, সন্দেহভাজন ১৭২ জন রোগীর কথা। তাঁদের মধ্যে তিন-চতুর্থাংশ পুরুষের বয়স ছিল ২১ থেকে ৪০ বছর।

কী চিকিৎসা

মাঙ্কিপক্সের কোনো চিকিৎসা নেই, তবে সংক্রমণ প্রতিরোধের মাধ্যমে এটি ছড়িয়ে পড়া নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

মাঙ্কিপক্স প্রতিরোধে গুটিবসন্তের টিকা ৮৫ শতাংশ পর্যন্ত কার্যকর হতে পারে বলে প্রমাণিত। আগাম সতর্কতা হিসেবে যুক্তরাজ্য গুটিবসন্তের টিকা কিনে রেখেছে। তবে ঠিক কত টিকা সংগ্রহ করেছে, তা পরিষ্কার নয়। স্পেন কয়েক হাজার টিকা কেনার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানা গেছে।

কতটা উদ্বেগের

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমরা এখনই এ ভাইরাস দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ার মতো পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার দ্বারপ্রান্তে নেই। যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা সংস্থা (ইউকেএইচএসএ) বলছে, ঝুঁকি এখনো কম।

ইউনিভার্সিটি অব নটিংহ্যামের মলিকুলার ভাইরোলজির অধ্যাপক জোনাথন বল বলেন, প্রকৃত অবস্থা হলো প্রাথমিকভাবে মাঙ্কিপক্স রোগীর সংস্পর্শে এসেছেন এমন ৫০ ব্যক্তির মধ্যে মাত্র ১ জন এ ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছেন। এখনই দেশজুড়ে এ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার মতো পরিস্থিতিতে আমরা আছি—এমনটা মনে করা ভুল হবে।