মাদারিং সানডে

আজকের সকালটি যে আর দশটা অন্য সকাল থেকে ব্যতিক্রমী হতে পারে, তা জানা ছিল না শিরিনের। ঘুম থেকে উঠে নিত্যদিনের মতোই সকালের নাশতা তৈরি করতে রান্না ঘরে গেল সে। যদিও তারা সপরিবারে আমেরিকার বিখ্যাত রাজ্য নিউইয়র্কে বসবাস করে। কিন্তু তাদের এই আমেরিকান জীবন বাংলাদেশের অন্য কোনো শহরের আর দশটা পরিবার থেকে মোটেও ব্যতিক্রম নয়। শিরিনের স্বামী রিপনের আয়-রোজগার খুব ভালো হলেও সে এখানে কোনো বাড়ি-ঘর কেনেনি। কারণ রিপন ও তার বাবার ধারণা আমেরিকান আইন-কানুন খুবই খতরনাক। এখানকার সরকার মেয়েদের নানা রকম বিশেষ আইনি সুযোগ-সুবিধা দিয়ে একেবারে মাথায় তুলে দিয়েছে। এ কারণেই এখানকার মেয়ে-বউগুলো একেবারে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তারা কথায় কথায় আইনের ভয় দেখায়, পান থেকে চুন খসলেই ৯১১ নম্বরে কল করে পুলিশ ডাকে। তারপর কোর্টে গিয়ে ডিভোর্সের মামলা ঠুকে নগদ টাকা-পয়সা, বাড়ি-ঘর, সহায়-সম্পত্তি সব হাতিয়ে নেয়।
যদিও এখানে রাস্তাঘাট খুব সুন্দর, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। হাটবাজার পরিপাটি। বাচ্চাদের পাবলিক স্কুলে পড়াশোনা ফ্রি। শিক্ষকদের ব্যবহার অমায়িক। তারা কথায় কথায় ছাত্রদের বেত দিয়ে, ডাস্টার দিয়ে মারে না। আজেবাজে কথা বলে বকাঝকা করে না। এখানকার ডাক্তাররা রোগীদের সঙ্গে মধুর ব্যবহার করে। হাসপাতালগুলো তকতকে-ঝকঝকে। কিন্তু বাড়ির ভেতরে অধিকাংশ বাঙালিই সেই টিপিক্যাল বাঙালির মতোই জীবনযাপন করে। আমেরিকান সরকারের দেওয়া সমস্ত সুযোগ-সুবিধা উপভোগ করে তারা। অঢেল ডলার উপার্জন করে এখানে কাজকর্ম করে। সম্পত্তি কেনে দেশে এবং তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে তুলতে বলে, ‘এই ম্লেচ্ছদের দেশে কী আছে, বলেন? মানুষ যে ক্যান এই দ্যাশে পইড়্যা থাকে বুঝি না। আরে দ্যাশে তো এক্কেরে রাজার হালে ছিলাম। এইখানে আইস্যা কী খাডাখাডনিডাই করতে হয়।’ কিন্তু দেখা যায় তারা বছরে একবারও দেশে যায় না। আর গেলেও দু-এক সপ্তাহ থেকেই পেট খারাপ, যানজটের নানা রকম দোহাই দিয়ে পড়িমরি করে ফিরে এসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।
শিরিনদের ঘরের জীবনও সেই গতানুগতিক বাঙালি ধাঁচের। তারা সকালে দেশি স্টাইলে হাতে-গড়া রুটি, সঙ্গে আলু বা কাঁচা পেঁপের ভাজি দিয়ে নাশতা করে। সঙ্গে থাকে ডিম পোচ এবং ঘন দুধের চা। সেই চা চা-পাতা দিয়ে পাতিলে জ্বাল দিয়ে, ঘন করে দুধ জ্বাল দিয়ে বানাতে হয়। দুধ জ্বাল করতে গিয়ে পুড়ে যাওয়া পাতিলটি ধুতে যে সময় ও পরিশ্রম হয়, সেটা লক্ষ্য করার মতো মানসিকতা বা মায়া কারও নেই। বরং শিরিনের স্বামী বা শ্বশুর জ্বাল করা দুধ চা ছাড়া মুখে তুলতে পারে না। দুপুরে গরম-গরম সদ্য রান্না করা ভাত, ডাল, মাছ বা মাংসের সঙ্গে শাক, সবজি, করলা ভাজা বা যেকোনো একটা ভর্তা থাকতে হয়। শিরিনের শ্বশুর বা স্বামী একদিন আগের কোনো বাসি তরকারি ছুঁয়েও দেখেন না। যেহেতু এখানে কোনো কাজের বুয়া নেই, তাই এ-টু-জেড সব কাজই শিরিনকে নিজের হাতেই করতে হয়। কিন্তু শুধুমাত্র ‘হাউস ওয়াইফ’ বলে শিরিনের কোনো কাজেরই কোনো রকম মূল্যায়ন হয় না এই সংসারে।
রান্না করা, গ্রোসারি থেকে বাজার করা, সকালে বাচ্চাদের স্কুলে পৌঁছে দিয়ে আসা, আবার ছুটি হলে তাদের আনতে যাওয়া, বাথরুম, কিচেন, লিভিং রুম, বেডরুম পরিষ্কার করা, লন্ড্রোমেটে গিয়ে মেশিনে কাপড়-চোপড় ধোয়া, শুকানো এই সমস্ত কাজই তাকে একার হাতে সামলাতে হয়। তবুও শ্বশুরমশাই বাসায় মেহমান এলে সবাইকে বলবেন, ‘বাসায় কী আর এমন কাজ বলেন? বুড়ো মানুষ একটু ভালোমন্দ খেতে মন চায়; তা কী আর হয়, সেই গতানুগতিক রান্না, আর কোনো রকমে খাওয়া।’ বলে এমন করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন যে কারওই মনে হবে ছেলের বউটি তাকে নিতান্তই অবহেলা করে। শিরিনের স্বামী মেহমানদের সামনে শ্লেষমাখা হাসি হেসে বলবে, ‘আর বলবেন না ভাবি, সে কি ভালো করে ইংরেজি বলতে পারে যে, একা একা এখানে-সেখানে যাবে? বাচ্চাদের স্কুলের প্যারেন্টস মিটিংয়ে বা হাসপাতালের ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট তো আমাকে ছাড়া হয়ই না।’ অথচ শিরিন এমএ কমপ্লিট করেছে। প্রয়োজনে দু-চার লাইন ইংরেজি বলতেও পারে। সারা দিন ঘর-সংসার নিয়ে পড়ে না থাকলে বা বাইরে কাজ করলে তার ইংরেজির দুর্বলতা সে ঠিকই কাটিয়ে উঠতে পারত। আর কোনো কারণে বাইরে গেলে বা ফিরতে দেরি হলেই তাকে হাজারটা জবাবদিহি করতে হয় স্বামী ও শ্বশুরের কাছে। তাই তার ইংরেজি চর্চা আর হয় না। আর একটু ভুল করলে সেটা নিয়ে যে পরিমাণ তির্যক সমালোচনা শুনতে হয়, তারপর শিরিনের মুখে আর ইংরেজি আসে না। দেশে থাকতে যেটুকু ইংরেজি জ্ঞান তার ছিল, তাও সে আমেরিকায় এসে ভুলতে বসেছে। এখানে সে ফুলটাইম বুয়া।
শাজাহানপুরে শিরিনের স্বামী রিপন পাঁচতলা বাড়ি করেছে। দেশে তার দুই ছোট বোন রয়েছে। তারা ভাইয়ের সেই বাড়িতেই স্বামী-সন্তান নিয়ে বসবাস করছে। কিন্তু তার বাবা কিছুতেই ঢাকায় গিয়ে মেয়েদের কাছে থাকতে চান না। আমেরিকায় থেকে বিগত স্ত্রীর জন্য বিলাপ করবে এবং জোর করে হলেও পুত্রবধূর কাছে সেবা, আদর-আপ্যায়ন আদায় করার চেষ্টা করবে। কিন্তু যতই তাকে ভালোমন্দ রান্না করে খাওয়ানো হোক না কেন, কিছুতেই তা তার মনঃপূত হয় না কখনো। তার কাজ হলো সকাল-বিকেল ছেলের শোরুমে গিয়ে বসা এবং ছেলের কাছে তার নিজের নানা শারীরিক সমস্যা, ছেলের বউয়ের রান্নাবান্নায় অবহেলা, বুড়ো শ্বশুরের প্রতি অবহেলার বর্ণনা করা। ফলস্বরূপ বাপ-ছেলে যখন দুপুরে ঘরে খেতে আসে, দুজনেরই মুখ থাকে গুরুগম্ভীর। খেতে বসে তারা তরকারিতে লবণ কম পান, নয় তো ডালে পানি বেশি পান। তাদের কাছে ভাজি পোড়া পোড়া মনে হয় এবং ভর্তায় ঝাল কম থাকে।
কিন্তু প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার মুখে এবং স্কুল থেকে ফিরে এসে এই একই দৃশ্য দেখতে বা একই কথা শুনতে আর ভালো লাগে না রিয়ার। সেই সাতসকালে তার মা শিরিন ঘুম থেকে উঠে কাজ শুরু করে, আর রাতে ঘুমাতে যায় সবাই বিছানায় যাওয়ার পর। তবুও সারাক্ষণই উঠতে বসতে তার মাকে খোঁটা শুনতে হয় বেকার ঘরে বসে বসে খাওয়ার জন্য। অথচ ঘণ্টা হিসেবে তার মায়ের কাজ হিসেব করলে দেখা যাচ্ছে, সে সাত দিনে সপ্তাহ এবং চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ২০ ঘণ্টাই কাজ করে। সেই হিসেবে নিউইয়র্কের সর্বনিম্ন কাজের মজুরি হিসেব করলেও তার মা ঘণ্টায় ১১ দশমিক ৪০ ডলার আয় করতে পারে। তাহলে তার প্রতিদিনের আয় যদি ২২৮ ডলার হয়, মাসিক আয় হবে ৬ হাজার ৮৪০ ডলার। অথচ প্রতিদিন ২০ ঘণ্টা কাজ করেও তার মায়ের হাতে একটি ডলারও থাকে না। তাকে হয় গোপনে বাবার পকেট থেকে কিছু ডলার লুকিয়ে রাখতে হয় সামান্য হাত খরচের জন্য; অথবা হাত পাততে হয় বাবা অথবা দাদার কাছে।
রিয়া অনেক দিন ধরেই লক্ষ্য করছে তাদের এই সংসারের জন্য সারা দিন খাটাখাটনি করেও বাবার ব্যবসা-বাণিজ্যের আয়-ব্যয়ের কোনো তথ্য বা হিসাব মাকে জানানো হয় না। টাকাপয়সার সব আলোচনাই সীমাবদ্ধ থাকে তার বাবা ও দাদার মধ্যে। ব্যাংকে তার বাবার সঞ্চিত অর্থের পরিমাণ, জায়গা-সম্পত্তি, ব্যবসার আয়-ব্যয়, দেশে পাঠানো টাকার পরিমাণ সম্পর্কে কোনো কিছু শিরিনকে জানানো বা তার সঙ্গে কোনো আলোচনার প্রয়োজন অনুভব করে না তার বাবা। যেটা সে শেয়ার করে তার নিজের বাবার সঙ্গে। বেচারি মা সারা দিন শুধু কাজ করে যায়, অথচ এতটুকু প্রশংসা শোনার ভাগ্য হয় না তার। রিয়া তার অন্য বাঙালি বান্ধবীদের বাসায়ও দেখেছে তাদের মায়েদের অবস্থাও একই রকম প্রায়। কিছু কিছু পরিবার অবশ্য খুব আলাদা। তাদের মায়েরা অনেক স্বাধীন ও সুখী। বিশেষ করে যাদের মা বাইরে কাজ করে, তারা অনেক স্বাধীনভাবে চলাফেরা করে। তাদের বাবারা তাদের মাকে হেলাফেলা করার সাহস পায় না। সম্মান দিয়ে কথা বলে, যা সে তার বাবাকে কখনই করতে দেখেনি।
রিয়া এখন নাইন গ্রেডের ছাত্রী। তার ছোট বোন রাইমা পড়ে সিক্স গ্রেডে। তারা দু বোনই মাঝেমধ্যে নিজেদের বাসায় হাঁপিয়ে ওঠে। তাদের মনে হয় তাদের কাজিনদের বাসায় বা বন্ধুদের বাসায় কত আনন্দ হয়, কত ফান হয়। অথচ তাদের বাসায় সারাক্ষণ নানারকম রান্নায় ব্যস্ত তাদের মার মেজাজ সব সময়ই খারাপ থাকে। দাদা সারাক্ষণই এটা ঠিক হয়নি, ওটা ভালো হয়নি বলে অভিযোগ করতে থাকেন। বাবা সারা দিন তাঁর ব্যবসা নিয়ে বাইরে, আর বাসায় এলে ফোনে ব্যস্ত থাকেন। তারপর দাদার কাছ থেকে নানা অভিযোগ শুনে শুরু হয় মায়ের ওপর খবরদারি।
আজ কী তরকারি রান্না হবে, মাছ খেতে ইচ্ছে করছে না মাংস খেতে মন চাইছে, সে কথাটি তার বাবা কিংবা দাদা রান্নাঘরের দিকে ছুড়ে দিতে একটুও দ্বিধা করেন না। আজ ছুটির দিন, পোলাও বা বিরিয়ানি হবে বলার সময় একবারও রান্নাঘরের মানুষটির শরীর কেমন বা তার আজ কোথাও বেড়াতে যেতে বা ছুটি কাটাতে মন চাইছে কিনা জানতে চায় না কেউ। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে রিয়ার মনের গভীরে জমা হতে থাকে মায়ের জন্য গভীর এক মমতা ও ভালোবাসা।
রিয়া মাঝেমধ্যেই হঠাৎ কোনো কারণে তার মায়ের মুখে একটু হাসি দেখলে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। কী অদ্ভুত সুন্দর তার মায়ের মুখটি। আর কী মিষ্টি তার হাসি। অথচ সেই মানুষটি যেন দিনে দিনে হাসতেও ভুলে যাচ্ছে। একদিন রিয়া তার মাকে একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ওপেন করে দিল। তাতে আপলোড করল মায়ের ছোটবেলার, কিশোরী বেলার, তরুণীবেলার, বিয়ের সময়কার ও এখনকার নানা ছবি। তাকে যুক্ত করে দিল অন্য সব খালা, মামা, কাজিন ও মায়ের ছাত্রজীবনের বান্ধবীদের সঙ্গে। রিয়ার বান্ধবীরা তার মায়ের ছবি দেখলে অবাক হয়ে অকুণ্ঠ প্রশংসা করে। তার মায়ের নাম একসময় ছিল শিরিন খান। সে শুনেছে, তার মায়ের এই লাস্ট নেমটিও তার বাবা জবরদস্তি করে আমেরিকান সিটিজেনশিপ পরীক্ষার সময় বদলে দিয়ে নিজের লাস্ট নেম জুড়ে দিয়েছেন। শিরিনের অনুমতি নেওয়ার মতো আদবটুকুও তিনি দেখাননি।
রিয়া আর রাইমা দু বোন মিলে যুক্তি করল, এবারের মাদার্স ডে এলে তারা তার মাকে একটা সারপ্রাইজ দেবে। এত দিনে স্কুলের টিচারদের কাছ থেকে মাদার্স ডের অনেক গল্প শুনেছে তারা। মাদার্স ডে ও ফাদার্স ডেতে তারা দু বোন অনেক ছবি এঁকে বাবা-মাকে উপহার দিয়েছে। ঘুম থেকে উঠেই ‘হ্যাপি মাদার্স ডে’ বা ‘হ্যাপি ফাদার্স ডে’ বলে উইশ করেছে। কিন্তু এখন সত্যিকারের বড় হয়েছে রিয়া। সে এখন তার নিজের বুকের ভেতরে তার মায়ের দুঃখকে ধারণ করতে শিখেছে। সে বুঝতে শিখেছে এই সংসারে যতটুকু সম্মান তার মায়ের প্রাপ্য, সেটুকু সম্মান তিনি পাচ্ছেন না। তাই সে ঠিক করেছে, তারা দু বোন যেহেতু মেয়ে, তারাই দাঁড়াবে মায়ের পাশে এসে।
গুগল ঘেঁটে ঘেঁটে রিয়া ও রাইমা বের করেছে সেই কবে আদিকাল থেকেই নানা দেশে দেশে মায়েদের নানাভাবে কত সম্মান দেখানো হতো। মাদার্স ডে শুধু হাল জমানার ক্রেজ বা ফ্যাশন নয়। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে, নরওয়েতে, এমনকি সৌদি আরব, বাহরাইন, মিসর, লেবাননেও সেই প্রাচীনকাল থেকে মাদার্স ডে পালন করে একটি বিশেষ দিনে মায়েদের সম্মান জানানো হতো। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময় ‘মা দিবস’ পালিত হতো বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে। কিন্তু বিশ্বজুড়ে এই যে বর্ণাঢ্য ‘মা দিবস’ উদ্‌যাপন, এটি আসে মূলত আমেরিকানদের থেকেই। আমেরিকান মেয়ে আনা মেরি জার্ভিসকেই মা দিবসের আসল প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়। ১৬০০ সালের দিকে ইংরেজরা ‘মাদারিং সানডে’ পালন করত মায়েদের সম্মানার্থে। কর্মক্লান্ত মায়েদের একদিন ছুটি দেওয়ার জন্যই ইংরেজরা ‘মাদারিং সানডে’ উদ্‌যাপন শুরু করেছিল।
রিয়া মনে মনে ভাবল, বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশে বসেও যেখানে মেয়েরা নারী স্বাধীনতা দিবস, মাদার্স ডে পালন করছে, সেখানে খোদ আমেরিকায় থেকেও আমাদের মা স্বাধীনতাহীনতায় ভুগছে। এবার সময় এসেছে দিন বদলে দেওয়ার। তারা দু বোন মিলেই শুরু করবে এই লড়াই এবং তা তাদের ঘর থেকেই শুরু হবে।
ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয় রান্নাঘরে ঢুকতে গিয়েই চমকে উঠল শিরিন। আরে, রান্নাঘরের দরজায় ফিতা বাঁধা কেন? তাতে কাগজ সেঁটে লেখা ‘টুডে ইজ মাদারিং সানডে; সো নো ওয়ার্ক ফর মম’। শিরিন অবাক হয়ে পেছনে তাকাল। তার বড় কন্যা ঘুম থেকে উঠে এসেছে। তার পিছু পিছু ছোট কন্যা। তারা দুজন তাঁকে দুহাত ধরে টেনে তাদের ঘরে নিয়ে চলল। এবং দুজনেই কোরাস শুরু করল, ‘মা, আজকে তুমি কোনো কাজ করবে না। সম্পূর্ণ বিশ্রাম করবে। আজ শুধু আমাদের সঙ্গে ফান করবে। আমরা আজ খুব মজা করব। বাইরে খাব, ঘুরব, হাসব, গল্প করব।’
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে খুব অবাক হলেন রিয়ার দাদা রাইসুল ইসলাম সাহেব। আরে এত বেলা হলো এখনো সকালের নাশতার জন্য টেবিলে ডাক পড়ল না। তিনি তাঁর রুম থেকে বের হয়ে এলেন। রান্নাঘর নীরব, সেখানে ‘নো ওয়ার্ক’ সাইন ঝুলছে। এসব কী? নাতনিদের রুম থেকে খিলখিল হাসির আওয়াজ ভেসে আসছে শুনে সে দরজায় উঁকি দিলেন। চেঁচিয়ে উঠে বললেন, ‘বউ, এসব কী হচ্ছে ঘরে? তুমি বাচ্চাদের সঙ্গে দল পাকিয়ে আড্ডা দিতেছ? বেলা কত হয়েছে খেয়াল আছে? বাচ্চাদের সঙ্গে সঙ্গে তুমিও বাচ্চা সাজছ?’
-দাদা, আজকে মাদার্স ডে, তাই মায়ের আজকে ছুটি। সে কোনো রান্নাবান্না করবে না। তুমি তোমার নিজের নাশতা নিজে রেডি করে খাও।
রিয়ার উত্তর শুনে রাইসুল ইসলাম কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। মেয়েটা এভাবে বেয়াদবের মতো কথা বলার সাহস পেল কী করে? নিশ্চয়ই মায়ের কাছে শিখেছে। ‘বউ, এই পুঁচকে মেয়েটাকে এভাবে বেয়াদবি শিথাইতাছ?’ ছেলের বউকে ধমক দিয়েই তিনি এবার উচ্চ স্বরে ছেলেকে ডাকলেন, ‘রিপন, আস, দেইখ্যা যাও, তোমার বাসায় তোমার মেয়ে আর বউ মিলে কী পরিমাণ অপমান আমারে করতাছে। এখন নাকি আমার নিজের নাশতা আমার নিজে বানাইয়া খাওয়া লাগব।’
সদ্য ঘুম ভাঙা চোখে রিপন এসে মেয়েদের রুমের দরজায় দাঁড়াল। বলল, ‘কী হয়েছে? সকাল সকাল এত চেঁচামেচি কিসের? শিরিন বাবাকে এখনো নাশতা দাওনি? এসব কী হচ্ছে?’
-বাবা, কিছুই হয়নি। আমি দাদাকে বলেছি, আজ মাদার্স ডে, তাই মায়ের আজকে ছুটি। সে কোনো রান্নাবান্না করবে না। দাদার নাশতা দাদা নিজে রেডি করুক। তাতেই দাদা রাগ করেছে।
-রিয়া, তুমি দাদাকে এভাবে বলতে পার না। এভাবে কথা বলা কার কাছে শিখেছ? মার কাছে?
-মার কাছে শিখিনি। তোমার আর দাদার কাছে শিখেছি। কারণ তোমরা সব সময় মার সঙ্গে এভাবেই কথা বল।
-দেখলি তো এইবার, মেয়েদের কিভাবে শিক্ষা দিতেছে তোর বউ? নিজে চুপ থাইকা মেয়েরে দিয়া কথা বলাইতাছে। কিসের মাদার্স ডে? এই সব ফাইজলামি রাইখা সবার জন্য নাশতা বানাইতে বল বউরে।
-বাবা, আমাদের টিচার বলসে, তোমাদেরকে ঘরে কেউ যদি অ্যাবিউস করে, তাহলে স্কুলের টিচার বা সোশ্যাল ওয়ার্কারদের কাছে কমপ্লেইন করতে। আমরা এখনো কোনো কমপ্লেইন করিনি। কিন্তু আর কখনো এমন হলে আমি নিজেই কমপ্লেইন করব। তুমি আর দাদা মাকে সব সময় অ্যাবিউজ কর। আই মিন ইট।
ছোট্ট রাইমাও বোনের গলা ধরে বলল, ‘ইয়েস, আই মিন ইট ঠু! টুডে ইজ মাদার্স ডে, অ্যান্ড উই উইল সেলিব্রেট ইট উইথ মম।’
রিপন ও রাইসুল ইসলাম অবাক বিস্ময়ে বোবার মতো মেয়েদের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তাঁদের মুখে কোনো কথা ফুটল না। কিন্তু উভয়েই অনুভব করলেন, আজ থেকে ঘরে ‘মাদারিং সানডে’ শুরু হয়ে গেল।