মেয়েটি এখন কী করবে
সামি একটি প্রাইভেট ফার্মে জব করে, আর শিলা একটি কলসেন্টারে; ফেসবুকে তাদের পরিচয়। সামি ঢাকায় একটি বাসায় সাবলেটে ভাড়া থাকে। বেশ স্বাধীনচেতা মানুষ। অন্যদিকে শিলা ঢাকায় তার রক্ষণশীল পরিবারের সঙ্গে অনেকটাই পরাধীনতার শিকল পরে থাকতে হয়। সামি সব সময়ই উড়ু উড়ু মনের কল্পনাপ্রবণ ছেলে, আর শিলা খুবই শান্ত-শিষ্ট বাস্তববাদী মেয়ে। ওদের মাঝে অনেক অমিল থাকলেও কীভাবে যেন ওরা দুজন দুজনকে ভালোবাসতে শুরু করল। কিন্তু দুজনেই ভালোবাসি কথাটা বলছি বলছি করেও যেন বলছে না।
হঠাৎ একদিন সামি প্রস্তাব করল, আগামীকাল সাপ্তাহিক ছুটির দিন আমরা দেখা করছি। শিলা এড়িয়ে যেতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত না করতে পারল না। যথারীতি ঠিক করা সময়ে ঠিক জায়গাতে ওরা দুজন এসে হাজির হলো। শিলা আজ নীল রঙের শাড়ি পরে খুবই সুন্দর করে সেজেগুজে এসেছে। নীল রঙের শাড়ি পরার কারণ সামি। তার পছন্দের রং নীল। অসম্ভব সুন্দর লাগছে ওকে, যেন ডানাকাটা নীল পরি। সামি গাঢ় নেভি-ব্লু রঙের জিন্স পেন্টের সঙ্গে একটি সাদা রঙের শার্ট পরে এসেছে। এখানেও কারণ হলো সাদা রং শিলার পছন্দ।
আজ দুজনকে দেখতে লাগছে বেশ। এক সাথে বেশ কিছু পথ হেঁটে তারা একটি রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসল। তখন ওরা দুজন দুজনার চোখের দিকে তাকিয়ে কথাই বলতে পারছিল না। দুজনই দুজনকে ভালোবাসি বলার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিল। সব সময় লেডিস ফার্স্ট হলেও ভালোবাসা প্রকাশের ক্ষেত্রে মেয়েদের বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না। সামিও বলি বলি করে বলতে পারছে না। খানিকটা সময় বসে রেস্টুরেন্টে অল্প কিছু খাবার পেটে গুঁজে বেরিয়ে পড়ল দুজন। মন না চাইলেও সন্ধ্যা হয়ে আসছে বলে শিলা বিদায় নিতে চাইল। কিন্তু সামি কী করে অসম্পূর্ণ কথা রেখে বিদায় দিতে পারে? সামি বাসা অবধি পৌঁছে দেওয়ার প্রস্তাব করলে, মুখে না করলেও শিলা বাধা দিল না। এই প্রথম ওরা দুজন দুজনার গা ঘেঁষে রিকশায় বসল। মনের সব জড়তা ধীরে ধীরে দূর হতে লাগল।
আলো-আঁধারি পরিবেশ যেন ওদের মনে একটা অদ্ভুত আকর্ষণ সৃষ্টি করল, অনেকটা চুম্বকের মতো। হঠাৎ করে সামি শিলার হাত চেপে ধরল। শিলা প্রথমে অবাক হয়ে কেঁপে উঠল। কিন্তু সামির হাত সরিয়ে দিতে পারল না। শিলা যেন পাথরের মূর্তির মতো হয়ে গেল। দুজনের হৃৎকম্পন এতটাই বেড়ে গেছে, যেন বুক ছিঁড়ে তা বেরিয়ে আসবে। আস্তে আস্তে দুজনেই স্বাভাবিক হতে লাগল। কিন্তু ইতিমধ্যেই রাস্তা ফুরিয়ে গেছে। শিলার বাসার সামনে আসতেই সে স্বাভাবিকভাবে সামির হাত সরিয়ে বলল, ‘সামনে আমার বাসা। আমি এখানেই নেমে যাব। তুমি রিকশা নিয়ে চলে যাও।’ সামি আচমকা কল্পরাজ্য থেকে বাস্তবে ফিরে এল। শিলা রিকশা থেকে নেমে দু কদম হাঁটতেই সামি বলে উঠল, ‘শিলা আমি তোমাকে ভালোবাসি।’ কথাটি শিলা শুনতেই চাচ্ছিল; কিন্তু তার মনের আনন্দের অনুভূতি বুঝতে দিল না। শিলা পেছনে একবার তাকিয়ে এক দৌড়ে বাসায় চলে গেল। বলতে গেলে এই দিন থেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে ওদের প্রেমের যাত্রা শুরু...।
দিনকয়েক পর শিলা ওর মনের সুপ্ত কথাটা প্রকাশ করল সামির কাছে। তারপর যত দিন যাচ্ছে, দুজন দুজনকে আরও কাছে পেতে চাইছে। অবসর পেলেই রঙিন প্রজাপতির মতো এদিক-ওদিক কত ঘোরাঘুরি। দিনে দিনে একটা রুটিন হয়ে গেল—শিলা প্রতি সাপ্তাহিক ছুটির দিন সামির বাসায় যাবে, ওর ঘর গুছিয়ে দেবে, ওর পছন্দের খাবার রান্না করবে এবং সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে আবার নিজের বাসায় ফিরে আসবে। এভাবেই একটি সুন্দর স্বপ্নের মাঝে কেটে যাচ্ছে ওদের রঙিন দিনগুলো। কিন্তু এই সুখ বেশি দিন সইল না। একদিন পার্কে হাতে হাত ধরে ঘোরার সময় শিলার বড় ভাইয়ের সামনে ধরা পড়ে গেল তারা। শিলার বাবা একজন ধার্মিক ও রক্ষণশীল মানসিকতার মানুষ। তিনি মেয়ের পার্কে বসে প্রেম করাটা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারলেন না। তিনি রেগেমেগে অগ্নিশর্মা হয়ে আছেন। এদিকে শিলা দুরুদুরু বুকে বাসায় ফেরার পর প্রচণ্ড রকম মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়। বাসা থেকে বের হতে নিষেধাজ্ঞা জারি হলো। শখের চাকরিটাও ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। এমনকি ওর মোবাইল-ল্যাপটপ সবকিছুই জব্দ করে রাখা হয়েছে।
সামির বিরহে বিছানার বালিশ ও চোখের জলই হলো শিলার অবলম্বন। ওদিকে সামির জীবনে এল আমূল পরিবর্তন। সেই সামি আর সামি নেই, পুরোপুরি বদলে গেছে। শিলার বিরহে কোনো কিছুতেই ওর মন বসে না। নিয়মিতভাবে অফিসেও যাচ্ছে না, গেলেও কাজে মন বসে না। দুজন দুজনার দেখা পাওয়ার অপেক্ষা করছিল। যেন তীর্থের কাকের মতো আকাশ পানে চেয়ে থাকা এক ফোঁটা বৃষ্টির আশায়। হঠাৎই একদিন শিলা সুযোগ পেয়ে ওর মোবাইল চুরি করে এনে সামিকে থেকে ফোন করে। দুজন কোনো কথা বলতে পারছিল না, যেন বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে। মনের আবেগে বেশ কিছু সময় ওরা কাঁদল। তারপর কিছু কথার ফাঁকে শিলা বলল, ‘তোমার জন্য একটি সারপ্রাইজ আছে। পরশু আমি আমার বান্ধবীর বিয়ের কথা বলে বেশ সময় নিয়ে বের হব। সেদিন তোমার বাসায় আসব, ঠিক ওই দিনই সারপ্রাইজের কথাটা বলব।’
সামির মন শুরু হয় জল্পনা-কল্পনা। কী হতে পারে সারপ্রাইজ? যথারীতি দু দিন পরে শিলা এসে হাজির। অনেক দিন পর দুজন দুজনাকে দেখে আবেগ ধরে রাখতে পারছে না। পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে আবারও কান্না জুড়ে দিল। প্রিয়তমা শিলার চোখের পানি মুছে দিতে লাগল সামি। তারপর শিলার কপালে চুমু দিয়ে সামি আদর করতে লাগল। সামির আদর পেয়ে শিলার মনে এত দিন কাছে না পাওয়ার বেদনা ভুলে গেল। একটু স্বাভাবিকভাবে দুজন কথা শুরু করতেই সামি অস্থির হয়ে সারপ্রাইজের কথা জানতে চাইল। কিন্তু শিলার মনে অনেক ভয়। তাই সে মুখে সারপ্রাইজের কথা বলতে পারছিল না।
ওর ব্যাগের চেইন খুলে একটি মেডিকেল রিপোর্ট সামির হাতে দিয়ে বলল, ‘এই দিকে বাবা-মা আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে।’ সামি রিপোর্টের দিকে এক নজরে তাকিয়ে আছে; এদিকে শিলার হৃৎকম্পন বেড়ে যাচ্ছে। হঠাৎ সামি শিলাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আজ যে সারপ্রাইজ তুমি আমাকে দিয়েছ, এর চেয়ে বড় কোনো সারপ্রাইজ হতে পারেন না। বাবা হতে পারার কী যে আনন্দ, আমি কোনোভাবেই তা প্রকাশ করতে পারব না।’ সামির কথাগুলো শুনে শিলার মনের সব ভয় দূর হয়ে গেল। খুশিতে ওর দুই চোখ থেকে অশ্রু ঝরতে লাগল। এ আনন্দের কান্না, যা সামি চেষ্টা করেও থামাতে পারছিল না। এক সময় শিলা শান্ত হলে সামি বাসা থেকে বের হয়ে যায় শিলার জন্য বিয়ের শাড়ি কিনতে। কারণ সামি আজই শিলাকে বিয়ে করতে চায়। শিলা ওর দু-একজন বান্ধবীকে সামির বাসায় আসতে বললে ওরাও ঝটপট চলে আসে। বান্ধবীদের সঙ্গে গল্পে-আড্ডায় বেশ ভালো সময় যাচ্ছে শিলার। আজ ওর বিয়ে বলে কথা।
সামি বিকেল সাড়ে চারটা নাগাদ বের হয়ে গিয়েছিল। যাওয়ার সময় বলেছিল একটা বিয়ের শাড়ি কিনেই চলে আসবে। তারপর সোজা কাজি অফিসে গিয়ে বিয়ের কাজটি সেরে নেবে। কিন্তু এখন সাতটা বাজে, সামির এখনো ফেরার নাম নেই। শিলা মোবাইল ফোনে কল দিতেই অন্য প্রান্ত থেকে বলছে, ‘আপনার ডায়াল করা নম্বরটি এখন বন্ধ আছে, একটু পরে আবার চেষ্টা করুন।’ শিলা বারবার চেষ্টা করছে; কিন্তু সেই একই কথা। তবে কী হলো সামির, অনেক প্রশ্ন এখন শিলার মনে। রাজ্যের সব ভাবনা শিলাকে ঘিরে ফেলেছে। অন্যদিকে বাসা থেকে মোবাইলে কলের পর কল আসছে। আর কত মিথ্যে কথা বলে বাসার মানুষগুলোকে বুঝিয়ে রাখা যায়। অবশেষে অনেকটাই বাধ্য হয়ে মোবাইল ফোনটা অফ করে দিল। শিলার বান্ধবীরা যতটা পারছিল, সাহস দিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু সময় যত বাড়ছে, সবাই তত নীরব হয়ে যাচ্ছে। একজন শিলাকে বলছে, চল বাড়ি ফিরে যাই। কাল আমরা এসে সামির সাথে দেখা করে সবকিছু জেনে নিব। কিন্তু শিলার মনে এক অজানা ভয়, সামির কোনো সমস্যা হলো না তো? তাই ওদের কথায় সায় দিল না।
তখন আরেক বান্ধবী বলেই ফেলল, দেখ তোর সামি পালিয়েছে কি না? শিলা এই কথাটা সহ্য করতে পারল না। তাই ওর বান্ধবীর গালে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিল। তারপর বলল, ‘তোরা সব চলে যা, আমি একাই সামির জন্য অপেক্ষা করব।’ এদিকে রাত বেড়ে যাচ্ছে, তাই বান্ধবীরা সবাই চলে গেল। এখন রাত দশটার কাছাকাছি, এখনো সামি ফিরছে না, তবুও শিলার অপেক্ষা...।
হঠাৎই পাশের ফ্ল্যাট থেকে টিভি চ্যানেলের সংবাদে শুনতে পেল, ‘সড়ক দুর্ঘটনায় বাসে চাপা পড়ে একজনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে।’ শিলা অজানা আশঙ্কায় তাড়াতাড়ি টিভি চালু করতেই সেই সংবাদটি ধরে ফেলল। টিভির পর্দায় সামির বিধ্বস্ত লাশের ছবি দেখেও চিনতে ভুল হলো না।
সামির গায়ে আজও সেই সাদা রঙের শার্ট; তবে রক্তের রঙে লাল হয়ে গেছে। শিলা এখন আর কাঁদতে পারছে না। সে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে। কোনো ভাবনাই তার মধ্যে কাজ করছে না। নির্বিকার দৃষ্টিতে এক অজানা ভবিষ্যতের দিকে সে তাকিয়ে আছে। যেন সব অনুভূতি আজ হারিয়ে ফেলেছে।
এদিকে সামির শেষ স্মৃতি তার গর্ভে; আর ওদিকে বাসায় বিয়ের চাপ। শিলা এটা স্পষ্ট বুঝতে পারছে, যদি সে বাসায় ফেরে, তবে সামির শেষ স্মৃতি অঙ্কুরেই মেরে ফেলা হবে। কিন্তু সে এটা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারবে না। তাদের ভালোবাসার ফসল কোনোভাবেই নষ্ট হতে দেওয়া যাবে না। কিন্তু শিলা যে বিবাহিত নয়, সামিও আর বেঁচে নেই। তার সামনে দীর্ঘ একটা জীবন পড়ে আছে। নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করছে, তার প্রিয় সাদা রঙের পোশাক পরে সামির স্মৃতি নিয়ে সারাটা জীবন কাটিয়ে দেবে, নাকি নীল রঙের কষ্ট বুকে নিয়ে আবার বাসায় ফিরে যাবে?