যন্ত্রণার জীবন

করোনাভাইরাস অনেকের জীবন বদলে দিয়েছে। ভালোবাসার সংসারে থাবা বসিয়েছে, অনেক সন্তানকে করেছে পিতৃহারা, মাতৃহারা। কত স্ত্রী হারিয়েছে স্বামী, আর স্বামী তার স্ত্রীকে। পরিচিত অনেকেই আছেন যাদের জীবন ছিল আলোকিত, এখন তাদের জীবনে নেমে এসেছে অন্ধকার। আপনজন হারানোর বেদনায় তারা বিমর্ষ। নাম বলছি না, এমন অনেককে চিনি, তাদের কথাই আজ লিখব।

অল্প বয়স্ক সদ্যবিধবা মেয়েটি তার স্বামীর হাত ধরে এসেছিল আমেরিকা। প্রথমবার দেশের বাইরে যখন আসে আপনজন ছেড়ে মন খারাপ ছিল ভীষণ। কিন্তু প্লেন আকাশে উড়তেই নিচে তাকিয়ে রাতের নিস্তব্ধ শহরটাকে দেখে ভুলে গিয়েছিল সবকিছু। অদ্ভুত সুন্দর সে দৃশ্য। স্বামীকে বলেছিল দেখো কী সুন্দর! ওর স্বামী হাসতে হাসতে বলেছিল, আমি অনেকবার দেখেছি। তবে এবার বেশি সুন্দর লাগছে, তুমি পাশে আছ তাই। জেএফকে এয়ারপোর্টে নেমে মেয়েটি যা দেখে তার কাছে সবকিছুই অন্যরকম লাগে। নতুন দেশ, নতুন জীবন যেন।

সবচেয়ে ভালো লাগে পাশে থাকা মানুষটির কারণে। লম্বা জার্নিতে মানুষটিকে অনেক বিরক্ত করেছে। অথচ সে তাকে আগলে রেখেছে বলা চলে। সংসার করার জন্য এমন মানুষ চেয়েছিল। শুকরিয়া জানায় সৃষ্টিকর্তার কাছে। দুজনের ছোট কামরায় জীবন শুরু হয়। একেকদিন একেকরকম পছন্দের রান্না করে, স্বামী দিন শেষে কাজ থেকে ফিরে। বিকেলে বের হয়ে ঘুরতে, গুন গুন করে গান করে ‘তুমি আমার জীবন, আমি তোর জীবন, দুজন দুজনার কত যে আপন...’। যেন প্রজাপতির ডানায় ভর করে চলছিল জীবন। চোখে ছিল রংধনুর সাত রঙের স্বপ্ন।

যা দেখে অতি সুন্দর! অবাক হয়ে দেখে।

না, এত সুখ কপালে সইল না। করোনাভাইরাস তার স্বামীকে কেড়ে নিয়েছে। স্বামীকে হারিয়ে দিশেহারা মেয়েটি। বুঝতেই পারেনি করোনার থাবায় তার সংসার উলটপালট হয়ে যাবে। সংসারের একমাত্র উপার্জনকারী স্বামী ছিল তার সবকিছু। কত আবদার, না বলা কথা, অভিমান যেন মিশে আছে তার বেদনা গাঁথায়। কেন এমন হল, ভাবতেই ভাবতেই অশ্রু ঝরে নীরবে। জীবন এখন তার কাছে এক বিভীষিকা, দুঃসহ যন্ত্রণার নাম।

আবার দেখেছি—স্বামী স্ত্রী দুজনেই করোনায় আক্রান্ত। তাদের আদরের সন্তানকে দিলেন এক আত্মীয়ের কাছে যাতে নিরাপদে থাকে। অবুঝ শিশুটি আত্মীয়ের মুখের দিকে তাকিয়েই কেঁদে উঠে। খুঁজে ফিরে মায়ের মুখ। আর মা, বাচ্চাটিকে দূরে রেখে হাহাকারের নিশ্বাস ফেলে। বুকের ধন বাচ্চাটির জন্য মায়ের একবুক কান্না চাপা পড়ে যায় অসুস্থতার কাছে। নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দেয় এই বলে, সুস্থ হয়ে ফিরে এলেই কাছে পাব। অবস্থা এমন হয়েছে যে, একটু ছুঁয়ে দেখবে সে উপায়ও নেই। ভিডিও ক্লিপে দেখেছেন কয়েকবার। যতবার দেখেছেন চিৎকার করে কেঁদেছেন। তার সে কান্না চার দেয়ালের মধ্যে চাপা পড়ে গেছে।

বাবা চুপ করে থাকেন, পুরুষেরা সাধারণত কাঁদে না, কিন্তু ভেতরে-ভেতরে ক্ষয়ে যায়। বাবাটি সন্তানের জন্য সেভাবে অন্তর দহনে পুড়ছিলেন, একটু কোলে নেওয়ার জন্য, কাছে পাওয়ার জন্য। খেলনাগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছিলেন। ভেবেছিলেন, কিছুদিন তো সুস্থ হলেই তো কাছে পাবেন। নিজের মনকে নিজেই বুঝিয়েছেন এই বলে। না কাছে যাবেন না, যত কষ্ট হোক। সন্তানের ভালোর দিক চিন্তা করেই দূরে ছিলেন। তাদের এই দূরত্ব চিরদিনের জন্য দূরত্বের ব্যবধান তৈরি হয়ে যাবে, কে জানত? প্রথমে বাচ্চাটির মা মারা যায় করোনাভাইরাসে, কিছুদিন পর বাবাও মারা যান। মাতৃহারা শিশুটি এখনো আত্মীয়ের কাছেই আছে। তারাই নাকি তাকে মানুষ করবে এমন বলছে। এই শিশুটি আর কোনো দিন পাবে না মায়ের আদর, কখনো বাবার সঙ্গে খেলবে না। জানবে না এই একজীবনে মা-বাবার আদর। বড় হতে হতে অবুঝ শিশুটি বুঝে যাবে, এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে আসলে সে একা। তার এই হাহাকার থেকেই যাবে আজীবন। বুকের গভীরে লুকায়িত এই যন্ত্রণা নিয়ে সে বেঁচে থাকবে।

এই শিশুটির মত অনেকেই এতিম হয়েছে। তবুও তার একটা আশ্রয় মিলেছে। অনেকের সেটাও মেলেনি।

করোনার প্রথম থাবা নিউজার্সিতে কেড়ে নিয়েছিল একই পরিবারের চারজনকে, তারা ছিল আমেরিকান। প্রথমে মেয়ে আক্রান্ত হয়, সে নিজেই বুঝতে পারেনি সে আক্রান্ত। বাবা–মা–বোনের সঙ্গে বাসায় ডিনার করে, আনন্দ করে। সময় কাটায়। লক্ষণ দেখা দিলে হাসপাতালে ভর্তি হয়। ডাক্তার বলে সে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। পরিবারের সবার টেস্ট করা হয়, রেজাল্ট আসে পজিটিভ। মেয়েটির অবস্থা দ্রুতই অবনতির দিকে যেতে থাকে। মেয়েটি ডাক্তারকে অনুরোধ করে, সে ভিডিও কলের মাধ্যমে তার পরিবারের কাছে ক্ষমা চায়। কিছুই বলতে পারেনি শুধু ইশারায় বুঝিয়েছিল তাকে যেন ক্ষমা করে দেয়। তার মা কান্নায় ভেঙে পড়ে, মেয়েটি মারা যায় একদিন পরেই।

এদিকে মাও অসুস্থ হয়ে পড়ে, পরে বাবা ও আরেক বোন, একে একে হারিয়ে যায় পরিবারের চারজন। যেন সমুদ্রের বিরাট একটা ঢেউ এসে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। বাড়িটা এখন বিরানভূমি। সবকিছুই আছে শুধু নেই মানুষগুলো।

গতকাল দেখলাম, এক পুত্র সন্তান রেখে মা মারা গেছে করোনাভাইরাসে। বাবা বাচ্চাটিকে আগলে রাখার চেষ্টা করছেন। বাচ্চার অবস্থা দেখে তিনি নিজেই ভুলে গেছেন স্ত্রী বিয়োগের কথা।

বাচ্চাটি কাঁদছে তো কাঁদছে, কিছুতেই কান্না থামাতে পারছেন না। অ্যালবামে মায়ের ছবি দেখিয়ে বলে, আমি মায়ের কাছে যাবে। আম্মু কই? নিয়ে আসো। এমন যদি হতো, কোন কিছুর বিনিময়ে মাকে ফিরে আনা যাবে হয়তো তিনি তাই করতেন। এই যন্ত্রণা থেকে শুধু বাচ্চাটি কেন, তার নিজেরও মুক্তি নেই। বাস্তবতার নিরিখে হয়তো নতুন জীবন শুরু হবে একদিন, কিন্তু যে সংসার ছিল আনন্দের, সেটা কি আর ফিরে আসবে? আসবে না।

পিছুটান থেকে যাবে। বুকের মধ্যে কাটা হয়ে বিঁধবে, যা কাউকে দেখানো যাবে না।
দুজন ডাক্তারও দেখলাম রোগীদের চিকিৎসা দিতে দিতে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। অনেক রোগী চোখের সামনে মরে যেতে দেখেছেন। নিজেরাই কান্নায় ভেঙে পড়েছেন, মানুষের এমন মৃত্যু দেখে পরে সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন নিজেরাই।

এখনো সারি সারি লাশের স্তূপ। আমিতো কয়েকজনের কথা বললাম মাত্র। এমন হাজার হাজার পরিবার আছে। করোনা ভাইরাস যাদের জীবনকে করেছে দুর্বিষহ। আপনজন হারিয়ে তারা যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এই মুহূর্তে। এই যন্ত্রণা শুধু একদিনের নয়। এই হাহাকার থেকে যাবে আজীবন। সবচেয়ে কষ্টের দিক হল, মৃত মানুষটির কবরে একমুঠো মাটি দিতে না পারা। একটু লাশ ছুঁয়ে কাঁদবে, সেই অবস্থা না থাকা। অনেকে অর্থের অভাবে, আইনি জটিলতার কারণে লাশও আনতে যায়নি। ভবিষ্যতে ভ্যাকসিন বাজারে না আসা পর্যন্ত কেউ নিরাপদ নয়। তত দিন পর্যন্ত আরও কত পরিবার নিঃস্ব হবে, কে জানে? যারা হারিয়ে গেছে, তারা তো গেছেই। কিন্তু যারা ইমারজেন্সিতে আছে, মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে। কেই হয়তো ফিরে আসবে, কেউ আসবে না। কে জানত এই ২০২০ সাল করোনার বিষে ভরে যাবে অনেকের জীবন।