যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ভয়ংকর এক মাস

যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় মঙ্গলবার টেক্সাসের একটি স্কুলে গুলিতে ২১ জন নিহত হয়েছে
ছবি: রয়টার্স

এ যেন ভয়ংকর এক মাস! চলতি বছরের মে মাসের সর্বশেষ ১৫ দিনে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থানে গুলিতে ৮০০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্রে অহরহ গুলির ঘটনা ঘটছে। এতে প্রাণহানিও বাড়ছে। সর্বশেষ যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় গতকাল মঙ্গলবার টেক্সাসের একটি স্কুলে গুলির ঘটনা ঘটে। এতে এখন ২১ জনের নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। প্রাণহানির সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

শুধু গতকাল দিনের শুরু থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত দেশটির বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের ৩৩টি স্থানে গুলির ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় মোট ২৮ জন নিহত হয়েছেন। আহত ৩১ জন।

আগের দিন সোমবার গুলিতে নিহত হয়েছেন ২৯ জন। আহত ৮৩ জন। এদিন দেশটির ৯০টির বেশি স্থানে গুলির ঘটনা ঘটে।

গত রোববার গুলির ঘটনা ঘটে ১৫৮টি স্থানে। এতে নিহত হন ৭২ জন। আহত ১৩৩ জন।

যুক্তরাষ্ট্রের অলাভজনক প্রতিষ্ঠান গান ভায়োলেন্স আর্কাইভের নথি থেকে গত কয়েক দিনে দেশটিতে গুলির ঘটনার এসব তথ্য পাওয়া যায়। প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন সূত্র থেকে এ-সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করে।

পরে সেগুলো যাচাই-বাছাই করে তা প্রকাশ করে। প্রতিষ্ঠানটির বরাত দিয়ে বিভিন্ন সময় যুক্তরাষ্ট্রে আগ্নেয়াস্ত্র সহিংসতার প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো। এমন একটি প্রতিবেদন গতকাল প্রকাশ করেছে বিবিসি অনলাইন।

বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৩ মে উইসকনসিনের মিলওয়াকিতে গুলিতে ১৬ জন আহত হন। তবে এতে কেউ নিহত হননি।

আরও পড়ুন

এ ঘটনায় পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ১৪ মে নিউইয়র্কের বাফেলোয় গুলি চালান এক বন্দুকধারী। ১৮ বছর বয়সী এই বন্দুকধারীর গুলিতে ১০ নিহত হন। পরে বন্দুকধারীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

১৫ মে ক্যালিফোর্নিয়ার লেগুনা উডস এলাকায় গুলিতে একজন নিহত হন। আহত হন চারজন।

একই দিন আরেকটি গুলির ঘটনা ঘটে টেক্সাসের হিউস্টনে। হিউস্টনের একটি মার্কেটে এই গুলির ঘটনা ঘটে। পাঁচ ব্যক্তির মধ্যে মারামারির জেরে এই গুলির ঘটনা ঘটে। গুলিতে দুজন নিহত ও তিনজন আহত হন।

গান ভায়োলেন্স আর্কাইভের নথির তথ্য অনুযায়ী, ৯ মে থেকে গতকাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের দুই হাজার স্থানে গুলির ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছেন আট শতাধিক মানুষ। আহত হয়েছেন ১ হাজার ৭০০–র বেশি মানুষ।

যুক্তরাষ্ট্রে বছরজুড়েই গুলির ঘটনা ঘটে আসছে। ২০২২ সালের প্রথম পাঁচ মাসে এমন ঘটনার সংখ্যা দুই হাজারের বেশি। এসব ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২ হাজার ২০০ জনের বেশি মানুষ। আহত হয়েছেন ৫০০ জনের বেশি। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে শিশু রয়েছে দুই শতাধিক। কিশোর-কিশোরীর সংখ্যা প্রায় ৬০০। আর দুর্ঘটনাবশত গুলিতে নিহত হয়েছেন ৮০০ জনের বেশি মানুষ। আহত হয়েছেন ১ হাজার ৭০০ জন।

যা বলছেন প্রেসিডেন্ট-ভাইস প্রেসিডেন্ট

টেক্সাসে স্কুলে গুলির ঘটনার প্রেক্ষাপটে গতকাল হোয়াইট হাউস থেকে আবেগঘন বক্তব্য দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।

বাইডেন বলেন, অনেক মা-বাবাই আর তাঁদের সন্তানকে দেখতে পাবেন না। নিহত শিশু কখনোই আর তাঁদের মা-বাবাকে জড়িয়ে ধরবে না। সন্তান হারানো এই মা-বাবার আর আগের মতো থাকবেন না।

গুলির ঘটনা প্রসঙ্গে বাইডেন বলেন, ‘এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে যেতে যেতে আমি ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত। আমাদের এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। আমাকে কেউ এটা বলবেন না যে এই হত্যাকাণ্ড বন্ধে আমরা কোনো কিছু করতে পারছি না।’

মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস বলেছেন, ‘এটা একজন রাজনীতিকের জন্য বলা সহজ যে এ ঘটনায় আমাদের হৃদয় ভেঙে গেছে। কিন্তু এমন ঘটনা তো একের পর এক ঘটছে। অনেক হয়েছে।’

আগ্নেয়াস্ত্র সহিংসতার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন কমলা হ্যারিস।

বিভক্ত সমাজ-রাজনীতি

মার্কিন সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনীতে নাগরিকদের অস্ত্র রাখার অধিকার নিশ্চিত করা আছে। এ অধিকার নিয়ে মার্কিন সমাজ-রাজনীতি ব্যাপকভাবে বিভক্ত।

গতকালের গুলির ঘটনার পর এ নিয়ে কথা বলেছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। আগ্নেয়াস্ত্র সহিংসতা বন্ধ করতে না পারার জন্য বিরোধী দল রিপাবলিকান পার্টির দিকে আঙুল তুলেছেন তিনি।

ওবামা বলেছেন, এমন গুলির ঘটনা বন্ধের পদক্ষেপ নিতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র একটি জায়গায় গিয়ে থমকে আছে। এটা ভয় থেকে নয়, একটি রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি একদল লবিস্টের কারণে এমনটা হচ্ছে। এমন বিয়োগান্ত ঘটনা যাতে আর না ঘটে, সে জন্য পদক্ষেপ নিতে চায় না তারা।

গত বছর প্রেসিডেন্ট বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্নেয়াস্ত্র সহিংসতাকে মহামারির সঙ্গে তুলনা করেন। তিনি বলেছিলেন, বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে বিব্রতকর হয়ে উঠেছে।

যুক্তরাষ্ট্রে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণে আইন প্রণয়নে কংগ্রেসের প্রতি বারবার আহ্বান জানিয়ে আসছেন বাইডেন। কিন্তু রিপাবলিকান পার্টি আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণের বিপক্ষে।

গতকালও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে কথা বলেছেন রিপাবলিকান পার্টির প্রভাবশালী সিনেটর টেড ক্রুজ। তিনি বলেছেন, টেক্সাসের স্কুলে গুলির ঘটনা ভয়ংকর। কিন্তু আইন সংস্কার করে এ ধরনের ঘটনা এড়ানো সম্ভব নয়।

আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণে গত বছর একাধিক নির্বাহী আদেশ জারি করেছিলেন বাইডেন। এর প্রতিক্রিয়ায় রিপাবলিকান নেতা কেভিন ম্যাকার্থি আগে বলেছিলেন, বাইডেন অপরাধীদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করছেন না। উল্টো তিনি আইন মেনে চলা নাগরিকদের সাংবিধানিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করছেন।

যুক্তরাষ্ট্রে স্কুলে আগ্নেয়াস্ত্র সহিংসতা সম্পর্কে একবার ডেমোক্র্যাট সিনেটর ক্রিস মারফি বলেছিলেন, ‘এমন গুলির ঘটনা শুধু আমাদের দেশেই ঘটে। আমরা সিনেটে কী করছি? আমরা এখানে কেন এসেছি, যদি এমন সমস্যার সমাধানই না-ই করতে পারি? আসুন, আমরা একটা আইন পাস করি, যাতে এমন ঘটনা কমিয়ে আনা সম্ভব হয়।’

রাজনৈতিক বিরোধিতার কারণে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত কোনো আইন পাস করতে পারেনি। এ কারণে দেশটিতে আগ্নেয়াস্ত্র সহিংসতায় হাজারো মানুষের প্রাণ যাচ্ছে।

তথ্যসূত্র: সিএনএন, এএফপি, রয়টার্স