যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা দিবসের ইতিহাস

আমেরিকানদের মতো আমরা, নতুন আমেরিকানরাও প্রতি বছর ৪ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা দিবস পালন করি। শীতকালের হাইবারনেশনের পর হাঁপ ছাড়তে সদ্য আরম্ভ হওয়া এই গ্রীষ্মের সময়টা উপভোগ করার জন্য উদ্‌গ্রীব হয়ে পড়ি। এই লং উইকএন্ডের সঙ্গে আরও এক সপ্তাহ থেকে এক মাস ছুটি জুড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে আমরা পুরো ফ্যামিলি নিয়ে বড় গাড়ি বা ভ্যানে করে দূরের স্টেটের দর্শনীয় স্থান যেমন—নায়াগ্রা ফলস, ডিজনি ওয়ার্ল্ড, ইয়েলোস্টোন ন্যাশনাল পার্ক, সানদিয়েগো জু, হাওয়াই দ্বীপ, আলাস্কা ইত্যাদি দেখতে বের হই। কেউ কেউ যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে অন্য দেশও যেমন কানাডা, মেক্সিকো বা ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করি। বাচ্চাদের স্কুলের ছুটি থাকায় এ সময় অনেকে সপরিবারে তাঁদের নিজেদের দেশ থেকেও বেড়িয়ে আসেন। সারা বছরের সবচেয়ে কাম্য ছুটিগুলোর মধ্যে গ্রীষ্ম মৌসুমের এই ৪ জুলাইয়ের স্বাধীনতা দিবসের ছুটিটা সবচেয়ে আদরের।

আমরা যে মনে করি ১৭৭৬ সালের ৪ জুলাইতে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল এবং তখন এক সার্বভৌম আমেরিকান যুক্তরাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল, সেটা কি ঠিক? তা নয় কিন্তু। কন্টিনেন্টাল কংগ্রেস আসলে যে দিনটিতে স্বাধীনতা ঘোষণার সিদ্ধান্ত নেয় সেটা ৪ জুলাই নয়, বরং তার দুদিন আগে ২ জুলাই। এই দিনে আমেরিকান গণ-অভ্যুত্থান শুরু হয়নি। সেটা শুরু হয়েছিল আরও এক বছরেরও কয়েক মাস আগে, ১৭৭৫ সালের এপ্রিলে। এমনকি টমাস জেফারসন স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য তাঁর প্রথম খসড়াও এই দিনে লেখেননি। লেখা হয়েছিল কিছুদিন আগে, ১৭৭৬ সালের জুন মাসে। এই দিনটি স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে আনুষ্ঠানিকভাবে সই করার দিনও ছিল না, সেটা হয়েছিল ওই বছরের ২ আগস্ট। এমনকি সই করার শেষে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি গ্রেট ব্রিটেনের কাছে জমাও দেওয়া হয়নি সেদিন। সেটা সম্পন্ন হয়েছিল ১৭৭৬ সালের নভেম্বরে। তাহলে ৪ জুলাই স্বাধীনতা পালন নিয়ে এত মাতামাতি কেন? আসলে কী হয়েছিল ৪ জুলাই?

২ জুলাই লেখা সেই স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের প্রথম খসড়া লেখার পর তার প্রতিটি অক্ষর, শব্দ ও বাক্য পরবর্তী দুদিন ধরে সম্পাদনা করা হয়। এরপর ৪ জুলাই আমেরিকান কন্টিনেন্টাল কংগ্রেস এই খসড়ার প্রতিটি শব্দ চূড়ান্ত অনুমোদন করে। সংশোধিত ও পরিমার্জিত এই খসড়াটি সঠিক ও চূড়ান্ত বলে গৃহীত হয় এই ৪ জুলাই। এভাবে এই দিনটিকেই ‘ডিক্লারেশন অব ইনডিপেনডেন্স’ এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

এরপর ১৭৭৬ সালের আগস্টে হাতে লেখা এই ঘোষণাপত্রের একটি কপিতে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা সই করেন। এই দলিলটি এখন ওয়াশিংটন ডিসির জাতীয় সংরক্ষণশালায় সাধারণের প্রদর্শনের জন্য রক্ষিত আছে। আবার এই ৪ জুলাই ফিলাডেলফিয়ার জন ডানল্যাপ ‘ডিক্লারেশন অব ইনডিপেনডেন্স’ প্রথমবারের মতো তাঁর ‘ডানল্যাপ ব্রডসাইড’-এ প্রকাশ করেন। ব্রডসাইড হলো সংবাদপত্রের মতো চওড়া কাগজ, যার এক পৃষ্ঠায় ছাপা হয়। অন্য পৃষ্ঠা খালি থাকে, যাতে এটাকে দেওয়ালে আঠা দিয়ে লাগানো যায়। এই অরিজিনাল প্রিন্টেড কপির এক একটা তখনকার ১৩টি স্টেটেই পাঠানো হয়, যাতে তারা সবাই পুরো কথাগুলো সরাসরি ও নিখুঁতভাবে জানতে পারে। এসব কারণে মানুষ যখন ডিক্লারেশন অব ইনডিপেনডেন্সের কথা ভাবে, তখন ১৭৭৬ সালের ৪ জুলাইয়ের কথাই তাদের মনের মধ্যে জাগে।

দিবসটি নিয়ে আবার আরেক পক্ষের কিছুটা তর্কাতর্কিও আছে। যেমন প্রতি বছর এখানে ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধান বার্ষিকী দিবস পালন করা হয়। আসলে এই দিনটিতে সংবিধান পত্রে সই করা হয়েছিল, সংবিধান অনুমোদিত হয়েছিল অন্যদিনে। তার মানে হলো ১৭ সেপ্টেম্বরে অনুমোদন বার্ষিকী উদ্‌যাপন না করে, এখানে সংবিধানপত্র সই করার বার্ষিকী পালন করা হচ্ছে। এখন সেদিক থেকে যদি তুলনা করা যায়, তাহলে ডিক্লারেশন অব ইনডিপেনডেন্সের তারিখ পড়ে ২ আগস্ট, যেদিন এটাতে সবাই সই করেছিলেন।

তাহলে ৪ জুলাই জাতীয় ছুটির দিন ঘোষিত হলো কীভাবে? ডিক্লারেশন লেখার পরবর্তী ১৫ থেকে ২০ বছর পর্যন্ত কেবল স্বাধীনতা দিবস কেন, বছরের কোনো একটা দিনও কোনো বিশেষ দিন হিসেবে উদ্‌যাপিত হয়নি। এর প্রধান কারণ ছিল, এই রাষ্ট্রের জন্য তখন প্রায় সবকিছুই নতুন। এর ওপর অজানা অচেনা নানা ঘটনা বা উপসর্গ একটার পর একটা লেগেই ছিল। এর ওপর ১৭৯০ সালের দিকে শুরু হয় দেশের মানুষদের মধ্যে দলাদলি। এমনকি স্বাধীনতার ঘোষণা আদৌ ঠিক ছিল কিনা, তা নিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠা শুরু হয়। একদিকে হলো ডেমোক্রেটিক-রিপাবলিকান গ্রুপ, যারা ডিক্লারেশন অব ইনডিপেনডেন্স ও তা লেখার জন্য টমাস জেফারসনের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করত। আবার অন্যদিকে ছিল সংযুক্ত রাষ্ট্রীয় পার্টি বা ফেডারেলিস্ট গ্রুপ, যারা ভাবত, ওই ডিক্লারেশন একতরফা, ব্রিটিশবিরোধী, ফ্রান্স ঘেঁষা একটা ডকুমেন্ট, যেটা দেশের সমসাময়িক কূটনীতিগত শাসন প্রণালির সম্পূর্ণ বিপরীত। এমনকি ১৮১৭ সালে জন অ্যাডামস তাঁর লেখা এক চিঠির মাধ্যমে অনুযোগ করে বসেন, আমেরিকানরা মনে হয় তাদের অতীত সম্পর্কে সব ধরনের কৌতূহলের কথা ভুলতে বসেছে।

অবশ্য সুখের বিষয় হলো, এই পরিবেশটা কিন্তু খুব বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। ১৮১২ সালের যুদ্ধের পর ফেডারেলিস্ট পার্টি আস্তে আস্তে ভেঙে পড়ে। ১৮২০ থেকে ১৮৩০ সালের দিকে যেসব নতুন নতুন পার্টি গঠিত হয়, তারা নিজেদের টমাস জেফারসনের উত্তরসূরি মনে করা শুরু করে এবং নিজেদের ডেমোক্রেটিক-রিপাবলিকান পার্টির সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে মনে করতে থাকে। আবার নতুন উদ্যোগে ডিক্লারেশন অব ইনডিপেনডেন্স ছাপা এবং সেগুলো সর্বত্র বিলি করা শুরু হয়। প্রতিটি ছাপা কাগজের শিরোনামে ৪ জুলাই, ১৭৭৬ তারিখটা উল্লেখ করা হয়। এ ছাড়া টমাস জেফারসন ও জন অ্যাডামস, দুই প্রেসিডেন্টই একই দিনে ১৮২৬ সালের ৪ জুলাই মারা যান। এই সব মিলিয়ে ৪ জুলাই সবার কাছে বেশ স্মরণীয় এবং গ্রহণযোগ্য একটি বিশেষ দিন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছে এবং আজও সেভাবে উদ্‌যাপিত হয়ে চলেছে।

ডিক্লারেশন অব ইনডিপেনডেন্স লেখার পর বেসরকারিভাবে ৪ জুলাই উদ্‌যাপন চলতে থাকে। তারপর ১৮৭০ সালে কংগ্রেস ৪ জুলাইকে জাতীয় ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা দিয়ে একটি বিল পাস করে। এই বিলে একই সঙ্গে দেশের অন্যান্য ছুটির দিনগুলোরও ঘোষণা দেওয়া হয়, যার মধ্যে ক্রিসমাস ডেও আছে। এর অনেক পরে ১৯৩৯ এবং ১৯৪১ সালে পার্লামেন্টে জাতীয় ছুটির দিন চিহ্নিত করে বিল পাস করা হয়।