যুদ্ধ করে গ্রিন কার্ড পেলেন তাঁরা তিনজন

যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিন কার্ড হাতে তিন বাংলাদেশি মুনির হোসেন, নাজমুল আলম ও বোরহান উদ্দিন

কত দিন পর মার সঙ্গে দেখা হবে। ভাই-বোন, ছোটবেলার বন্ধু-স্বজনদের সঙ্গে দেখা হবে। ভাই-বোনদের সন্তানেরা বড় হয়েছে, পরিবারে সদস্য বেড়েছে। যাদের অনেকের সঙ্গেই এবার প্রথম দেখা হবে। আইনি লড়াইয়ে জেতার পরও চার বছর পেরিয়ে গেছে নানা প্রক্রিয়ায়। এখন অপেক্ষার পালা কখন কখন দেশে যাব!

যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাসের স্বীকৃত প্রমাণপত্র ‘গ্রিন কার্ড’ হাতে পেয়ে এভাবেই উচ্ছ্বসিত ক্রীড়াপ্রেমী মুনির হোসেন (২৮)।

যুক্তরাষ্ট্রে বৈধভাবে অভিবাসী হিসেবে যারা আসেন তাঁদের কাছে গ্রিন কার্ড প্রাপ্তি একটি দাপ্তরিক প্রক্রিয়া মাত্র। সোনালি স্বপ্নের জাল বুনে কিংবা নিপীড়নের শিকার হয়ে দেশে হাঁটা পথে (বাই রোডে) যারা যুক্তরাষ্ট্রে আসেন, তাঁরা জানেন এই পথ কতটা কষ্টের। কেউ কেউ সর্বোচ্চ ১৩টি দেশ ঘুরে, জঙ্গল, পাহাড় আর উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আসেন যুক্তরাষ্ট্রে।

এরপর শুরু হয় নতুন লড়াই। আটক হন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে। শুরু হয় জেল জীবন, ব্যতিক্রমী কেউ কেউ জেল থেকেই মামলা লড়ে জিতে বেরিয়ে আসেন। ভাগ্য খারাপ হলে জেল থেকেই কাউকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়। এ ছাড়া প্রায় সবাই আইনজীবীর মাধ্যমে আদালত থেকে বন্ড দিয়ে জামিনে মুক্ত হন। এই মুক্ত জীবনে শুরু হয় আরেক অধ্যায়ের। নিয়মিত আদালতে হাজিরা প্রদান করা, আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়া। মুক্ত অবস্থায় মামলায় হেরে গেলেও চলতে থাকে আইনি লড়াই। বিপরীত দিকে মামলার লড়াইয়েই কেউ পার করছেন দুই-তিন দশকও। গ্রিন কার্ড তাঁদের কাছে সুদূরপরাহত।

সাধারণত মামলা জেতার এক বছর পর গ্রিন কার্ডের জন্য আবেদন করা হয়। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতা পাওয়ার পর থেকে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় গ্রিন কার্ড প্রাপ্তিতে বিলম্ব ঘটে। দুই বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও কার্ড না পেয়ে আপিল করতে দ্বারস্থ হতে হয় আইনজীবীর। প্রতি ঘাটে ডলারে পরিশোধ করতে হয় খরচাপাতি। একই সঙ্গে আইনি লড়াই, নিজের যাবতীয় ব্যয় মেটানো, দেশে দেনা পরিশোধ এবং দেশে পরিবারের খরচ মেটাতে চলে কঠোর খাটুনি। তারপরও জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণের সেই হাঁটা পথের কথা মনে রাখতে চান না কেউই।

আর এই দীর্ঘ প্রক্রিয়ার পরতে পরতে থাকে চরম অনিশ্চয়তা। যার আপাত স্বস্তির পরশ বুলিয়ে যায় গ্রিন কার্ড। গ্রিন কার্ড প্রাপ্তি যেন যুদ্ধ জয়ের অনুভূতি জাগায় মনে।

স্বজনদের সাক্ষাৎ পেতে ব্যাকুল প্রবাসীদের অনেকেই গ্রিন কার্ড প্রাপ্তিতে বিলম্বের কারণে ট্রাভেল ডকুমেন্ট ব্যবহার করে তৃতীয় কোনো দেশে মা-বাবা কিংবা স্ত্রী সন্তানদের সঙ্গে কিছুদিন থেকে আসেন। গ্রিন কার্ড হাতে পেয়েই স্বজনদের দেখা করা আর বিয়ে সেরে এসেছেন অনেকেই। তবে এখনো প্রতীক্ষার কথাও জানিয়েছেন অনেকে।

গ্রিন কার্ডের সেই যুদ্ধ জয়ীদের একজন মুনির হোসেন বলেন, ২০১৩ সালের জুনে জেলে যাওয়ার পর নতুন জীবনের সন্ধান পেয়েছেন তিনি। জেল হলেও তো আমেরিকা! এটুকুই ছিল তাঁর সান্ত্বনা। তিন মাস পর জামিনে মুক্ত হয়ে শুরু হয় আইনি লড়াই। রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে আইনি লড়াই শেষে ২০১৭ সালের মে মাসে মামলায় জেতেন তিনি। এক বছর পর গ্রিন কার্ডের আবেদন করেন। কিন্তু আড়াই বছর কেটে যাওয়ার পরও কার্ড না আসায় আপিল করেন তিনি। গত মার্চে হাতে পেয়েছেন কাঙ্ক্ষিত গ্রিন কার্ড। প্রতিটি পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিয়মকানুন এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার কথা জানিয়ে তিনি এ ক্ষেত্রে সহযোগিতার জন্য সবার প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান।

একইভাবে আইনি লড়াইয়ে জয়ের পর নিয়মতান্ত্রিকভাবে গ্রিন কার্ডের জন্য দীর্ঘ তিন বছর অপেক্ষা করেন নাজমুল আলম (২৯)। বিলম্বের কারণে বাবার মৃত্যুর সময় দেশে যেতে পারেননি। ট্রাভেল ডকুমেন্ট সংগ্রহ করে মা, স্ত্রী ও ছোট ভাইবোনদের সঙ্গে কিছুদিন থেকে আসেন তৃতীয় দেশে। কিন্তু দেশের প্রতি টান যেন বাড়তেই থাকে। শেষ পর্যন্ত আইনজীবীর মাধ্যমে আপিল করে গ্রিন কার্ড পেয়েছেন গত এপ্রিলে। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা, করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই দেশে যাওয়ার ইচ্ছা এই যুব কমিউনিটি অ্যাকটিভিস্টের।

আপিল করে গ্রিন কার্ড প্রাপ্তির পর দেশে গিয়ে বিয়ে করে ফিরেছেন সম্প্রতি এমন একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, কারাগারে অনেক সুযোগ-সুবিধা। তারপরও মনে হয়েছে জেল থেকেই দেশে পাঠিয়ে দেয় কিনা। প্রতিটি ধাপেই অনিশ্চয়তায় ভরা, যেন যুদ্ধ জয়ের শামিল। আর এসব ধাপ অতিক্রমে লেগেছে ডলার। তবে একই সময়ে আপিল করে প্রায় দুই বছরেও গ্রিন কার্ড পাননি তাঁর এক আত্মীয়।

এ ক্ষেত্রে সৌভাগ্যবান হচ্ছেন বোরহান উদ্দিন (২৭)। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর এক বছরের মধ্যে আইনি লড়াইয়ে জিতে যান তিনি। নিয়ম মেনে এক বছর পর আবেদন করেন এবং তিন মাসের মধ্যেই হাতে পান গ্রিন কার্ড। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর স্বজনদের সঙ্গে দেখার অপেক্ষায় তিনি।