রঞ্জুর ডায়েরি
(পর্ব এক)
প্রায় মাস খানিক পরে রঞ্জু নিজেকে সম্পূর্ণ সুস্থ দাবি করলেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে ছাড় দিতে রাজি নয়। কারণ, সে কারও সঙ্গে কোনো কথা বলে না, সারা দিন ডায়েরিতে নিজের ভাষায় লেখালেখি করে, যা হাসপাতালের কেউ পড়তে পারে না। শুধু যখন শায়ের হাসপাতালে ওকে দেখতে আসে, তখন সে খুব সাবলীলভাবে গল্প করে। এমনকি খাওয়া–দাওয়াও করে, ওষুধও খায়। কিন্তু অন্য যেকোনো সময় খাবার কথা বললে সে সব সময় একই উত্তর দেয়, ‘খিদে নেই বা এখন খেতে ইচ্ছা করছে না।’
সারা দিন বসে বসে ডায়েরিতে লেখা ছাড়া আর কোনো কাজই করে না রঞ্জু। তার মাঝে কোনো উদ্দীপনা নেই, উত্তেজনা নেই, এমনকি ভবিষ্যতে সে কী করতে চায়, সেটার কোনো পরিকল্পনা বা স্বপ্ন, ভাবনা নেই। ডাক্তারের অনুরোধে ও বন্ধুত্বের টান থেকে শায়ের প্রতিদিনই অফিস শেষ করে রঞ্জুকে দেখতে হাসপাতালে আসে। প্রতিদিনই শায়ের ডাক্তারের সঙ্গে আলাপ করে, তার অবস্থা সম্পর্কে জানতে চায় এবং তার অবস্থা অনুধাবনে ও পর্যবেক্ষণে ডাক্তারকে সাহায্য করে। শারীরিকভাবে সুস্থ হলেও রঞ্জুর মানসিক অবস্থা এখনো স্থিতিশীল নয় বলেই মনে করেন ডাক্তার। এখনো সে ঘুমের ভেতরে ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠে, স্বদেশি-বিদেশি ভাষার মিশ্রণে ঘুমের মধ্যে কী সব জানি বলে। কিন্তু যতক্ষণ জেগে থাকে, ততক্ষণ খুব সুবোধ বালকের মতোই আচরণ করে। ডাক্তারের ভাষায় এই অবস্থাকে ‘প্যারা ডিস্ফাংশন্যাল ট্রমা’ বলে। এই অবস্থায় মানুষ যখন জেগে থাকে তখন কোনো বিষয়কেই পরোয়া করতে চায় না। কিন্তু তন্দ্রা বা ঘুমন্ত অবস্থায় মানুষের কল্পনায় অতীতে ঘটে যাওয়া এক বা একাধিক বিভীষিকাময় স্মৃতি ভেসে উঠে।
সাইকোলজিক্যাল গবেষণায় দেখা গেছে, যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকায় ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া মানুষের মধ্যে এই ধরনের ‘ডিস্ফাংশন্যাল ট্রমা’ বেশি দেখা যায়। এমনকি বিধ্বংসী আক্রমণ পরিচালনাকারী সৈন্যরাও যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে কখনো কখনো এ ধরনের সাইকোলজিক্যাল ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত হয়ে থাকে। রঞ্জুর মানসিক অবস্থা পুরোপুরি নিরূপণের জন্য ডাক্তাররা মনে করছেন, ডায়েরিতে লেখা তার কথাগুলোর বিশ্লেষণ খুবই জরুরি। কারণ এ ধরনের রোগীরা জাগ্রত অবস্থায় খুবই সচেতন থাকে, প্রায় সব ব্যাপারে নির্মোহ আচরণ করে এবং নিজের ভেতরে কথাগুলো খুব সন্তর্পণে চেপে রাখে। ডাক্তারের ভরসা এখন শায়ের, কারণ রঞ্জু শায়েরের কথা ঠিকঠাক শোনে।
ডাক্তারের অনুরোধে শায়ের রঞ্জুর সঙ্গে তার ডায়েরির প্রসঙ্গ তোলে কথা বলতে শুরু করে এবং লেখাগুলো পড়ে দেখার আগ্রহ দেখায়। রঞ্জু কোনো বাক্য ব্যয় ছাড়াই শায়েরকে তার ডায়েরি পড়ার অনুমতি দেয়। পৃথিবীতে একমাত্র শায়েরকেই রঞ্জু বিনা দ্বিধায় ভরসা করে। শায়ের রঞ্জুর সঙ্গে কথা বলে ঠিক করে, পরদিন সে নতুন একটা ডায়েরি এনে রঞ্জুকে দেবে, যাতে সে তার মনের কথাগুলোর লেখা চালিয়ে যেতে পারে, আর শায়ের পুরোনো ডায়েরি নিয়ে গিয়ে লেখাগুলো পড়তে পারবে। এই বোঝাপড়ায় রঞ্জুর কোনো আবেগের প্রকাশ দেখতে পায়নি শায়ের। তবুও রঞ্জুর কাছ থেকে ডায়েরিটা নিয়ে সে পড়বে এবং এর তর্জমা করে ডাক্তারের সঙ্গে শেয়ার করবে।
শায়ের খুব করে চায়, রঞ্জু আবার সেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসুক, গল্প করুক, আড্ডা দিক তার সঙ্গে। এই পরবাসে রঞ্জুই শায়েরের একমাত্র আপনজন। কথামত পরের দিন শায়ের রঞ্জুর ডায়েরি নিয়ে গিয়ে পড়তে শুরু করে। প্রথমেই শায়েরের নজরে আসে ডায়েরির বুকমার্ক দেওয়া পাতায়। ১২৭ নম্বর পৃষ্ঠায় নীল কালিতে রঞ্জু লিখেছে—‘... মাঝে মাঝে সূর্যাস্ত দেখে খুব বেশি অসহায় লাগে। মনে হয়, যদি সোনালি সূর্যের আলো দেখার সুযোগ আর না হয়। ঘুমাতে যাওয়ায় সময় ভীষণ কষ্ট হয়। মনে হয় যদি কখনো ঘুম আর না ভাঙে, তাহলে আমার না বলা কথাগুলো আর কখনো এই পৃথিবীতে উচ্চারিত হবে না। ঘুম ভাঙলে আগামীকাল, নয়তো পরকাল। শুভরাত্রি...’
রঞ্জুর লেখাগুলোতে সুনির্দিষ্ট কোনো ধারাবাহিকতা নেই, বেশ এলোমেলো ভাবনা, এমনকি খুব কম জায়গায় তারিখ বা স্থান উল্লেখ করেছে। লেখার কৌশলে ভাবের সপ্তমী ব্যবহার করেছে এবং পারতপক্ষে কারও নাম উল্লেখ করেনি। তবে একটা নাম তার লেখার বেশ কয়েকটা জায়গাজুড়ে বারবার এসেছে, ফাতেমা। কে এই ফাতেমা, তা ভালোভাবে বুঝতে শায়ের নিজের অনুমান শক্তি দিয়ে গল্পগুলোর একটা ক্রমিক ধারাবাহিকতা খুঁজে বের করে। প্রথমত, ফাতেমা ছিল রঞ্জুর ইউনিভার্সিটি জীবনের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। রঞ্জুর স্মৃতিপটে ফাতেমার বিচরণ বেশ প্রখর। রঞ্জু ও ফাতেমা একে অন্যকে খুব বেশি পছন্দ করত এবং ক্লাসের সব বন্ধুরা তাদের ঠাট্টা করে মানিকজোড় বলত। বন্ধুত্ব, টান, ভালোলাগা, ভালোবাসা সবকিছু পেরিয়ে তাদের সম্পর্কটা প্রেম পর্যন্ত গড়ায় চতুর্থ বর্ষে থাকাকালে।
রঞ্জুর ভেতরে সব সময় ভয় কাজ করত, মনে মনে ভাবত, সে তো আর অন্য যেকোনো ছেলে-মেয়ের মত পরিবারের আদুরে সন্তান নয়। সমাজে টিকে থাকার তাগিদেই পড়াশোনা করার নিদারুণ চেষ্টা নিয়ে সে ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে, পাশ করে কোনোমতে একটা চাকরি জোগাড় করতে পারলেই সে বেঁচে যায়। প্রেম-ভালোবাসার রঙিন স্বপ্ন তার জীবনধারায় খুবই বেমানান, সত্যি বলতে অতটা সাধ করা তার সাহসে কুলায় না। কিন্তু রঞ্জুর ভয়ার্ত বিচরণ, নির্মোহ জীবনযাপন, সততা আর সরলতা ফাতেমাকে প্রবলভাবে আকৃষ্ট করে। অন্যদিকে ফাতেমার আগ্রহ, সহায়তা, সমর্থন আর যত্নশীল আচরণ থেকে রঞ্জুর ভেতরে একধরনের দায়বদ্ধতার জন্ম নেয়।
জীবনের অনেকটা পথ দুজনে মিলে শুধু বন্ধু বলেই পাশাপাশি হেঁটে এসেছে। শেষ বর্ষে এসে দুজনেরই মনের ভেতর চিন্তা আসে, আর তো মাত্র একটা বছর, তারপর বন্ধুত্বের সমান্তরাল পথ বাঁক নিতে শুরু করবে। মনের উদ্বেগ চেপে রাখতে না পেরে ফাতেমা রঞ্জুকে বলতে শুরু করে, ‘এ বছরটা শেষ হলেই তো তুই আর আমি আলাদা হয়ে যাব, এখনকার মত আর প্রতিদিন দেখা হবে না, প্রতিদিন কথা হবে না, পাশাপাশি থাকা হবে না। তোর কী তাতে খারাপ লাগবে না রঞ্জু?’
লাইব্রেরির বারান্দায় এক কোনায় বসে, ফাতেমার জড়ানো গলায় আবেগী কথাগুলো শুনে রঞ্জুর ভেতরটা কেঁপে উঠে। মনের ভেতরে তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে দেখে রঞ্জু কিছু না বলে চুপ করে থাকে। ফাতেমা কিছু একটা আশ্বাসবাণী শোনার জন্য রঞ্জুর মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে।
মনের অবস্থা কিছুটা সামলে নিয়ে রঞ্জু সরল ভাষায় সত্য বলতে শুরু করে, ‘তুই আমার অতীত জীবন আর পারিবারিক অবস্থানটা খুব ভালো করেই জানিস ফাতেমা। আর আমি মুখে কোনো দিন তোকে না বললেও, তুই নিশ্চয়ই এটা ভালো করেই জানিস, আমি তোকে ভীষণ ভালোবাসি। আমার জীবনটা অন্য সবার মত হলে আমি অবশ্যই তোকে প্রেম নিবেদন করতাম, জুটি বেঁধে রঙিন ভুবনে ঘুরে বেড়াতাম। কিন্তু পারি না সাহস করতে, এটাই আমার আজন্ম অপরাধ।’
রঞ্জুর কথা শেষ হওয়ার আগেই ফাতেমা তার দুই হাত চেপে ধরে বলতে শুরু করে, ‘তুই আমাকে ভালোবাসিস, এ কথা তোর মুখ থেকে শুনতে পেরে আমি যেন স্বর্গীয় সুখ অনুভব করছি। আমি ব্যাপারটা অনেক আগে থেকে অনুভব করলেও তোর মুখ থেকে উচ্চারিত কথাগুলো শোনার জন্য হয়তো আজীবনই অপেক্ষা করতাম। মুখ ফুটে বলতে পেরেছিস, এটাও তো অনেক বড় সাহসের কথা রঞ্জু। আমিও চাই, তোর জীবনের সবগুলো না পাওয়ার আক্ষেপ যেন আমি আমার ভালোবাসা দিয়ে পূর্ণ করে দিতে পারি। তুই মনটাকে একটু শক্ত করে সামনের দিকে এগোতে চাইলে আমার সর্বাঙ্গীণ সমর্থন দিয়ে সব সময় তোর পাশেই থাকব। আমি তোকে চাপ দিতে চাই না রঞ্জু, তবে আমিও তোকে অনেক বেশি ভালোবেসে ফেলেছি। তোর আমার মাঝখানে কখনো দূরত্ব তৈরি হবে, তা মেনে নিতে আমার খুব বেশি কষ্ট হবে। তুই ভেবে দেখিস রঞ্জু, আমাদের নিষ্পাপ ভালোবাসাটুকু বাঁচিয়ে রাখতে হলে তোর মনোবল আর সাহসটা খুবই জরুরি।’
(পর্ব দুই)
পরিবারের ভয় আর ফাতেমার ভালোবাসার জটিল সমীকরণ মনের ভেতর চেপে রেখে মঞ্জু নিজের অজান্তেই প্রতিনিয়ত খুঁজে বেড়ায় একটা সহজ সমাধান। একটা উপায় কোথাও না কোথাও নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু সেটা কী? এবারও কী রঞ্জুকে পরিবারের ভয়ে তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অভিলাষটাকে জলাঞ্জলি দিতে হবে? নাকি বিধাতার তরফ থেকে কোন স্বর্গীয় সমাধান এসে স্বস্তি এনে দেবে জীবনে?
এদিকে রঞ্জুর মুখ থেকে উচ্চারিত ভালোবাসার কথাগুলো শোনার পর থেকে ফাতেমার মনের ভেতরে উত্তাল সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাস বইছিল। কিছুদিন পরে উপায়ান্তর না দেখে, ফাতেমা তাদের কথাগুলো তার মায়ের সঙ্গে শেয়ার করে। ফাতেমার মা বিস্তারিত সব গল্প শোনার পর কথা দেন, তিনিও শামিল হবেন মঞ্জু-ফাতেমার প্রেমযুদ্ধে। একদিন সন্ধ্যার পর ফাতেমার মা রঞ্জুকে তার বাসায় ডেকে নেন। রঞ্জুকে দুশ্চিন্তা করতে মানা করে সৃষ্টিকর্তার ওপর ভরসা রাখতে বলেন। ফাতেমা ও রঞ্জুকে সুখী দেখতে তাঁর সামর্থ্যের সর্বোচ্চ সহায়তা করবেন বলে আশ্বাস দেন।
রঞ্জুর জীবনেও প্রেম আসবে, এটা সে নিজে কখনো ভুলেও কল্পনা করেনি। তাও যেহেতু এসেছে, প্রেম টিকিয়ে রেখে আজীবন ফাতেমাকে বুকে ধরে রাখতে হলে এখনো অনেক চড়াই-উতরাই পাড়ি দিতে হবে এবং জীবনে প্রথমবারের মত মঞ্জু সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে দৃঢ়-সংকল্পবদ্ধ হল। কিন্তু নিজ পরিবারের কাছে ব্যাপারটা কীভাবে উপস্থাপন করবে, তা মঞ্জু ঠিক করতে পারছিল না। একসময় ঠিক করল, একটা একটা করে পদক্ষেপ নিতে হবে।
নিজ পরিবারে বড় ভাতিজিটা প্রায় তার সমবয়সী এবং তার সঙ্গে বেশ ফ্রেন্ডলি। সাহস করে ভাতিজিকে জানিয়েও খুব একটা সুবিধা হল না। সব শোনে ভাতিজি রঞ্জুকে তার বিশাল পরিবারের নিয়মিত সংস্কৃতি সম্পর্কে তার দুশ্চিন্তার কথাটাই তুলে ধরল। তারপরও ভাতিজি তাকে অভিনন্দন জানাতে ভুলেনি এবং বলল, ‘আপাতত প্রেমটাকে ধরে রেখে সময়টা উপভোগ করো, পরেরটা সময় হলেই দেখা যাবে। একটা উপায় আমরা সবাই মিলে খুঁজে বের করবই।’
এদিকে আস্তে আস্তে ফাতেমার পরিবারের সবাই জেনে গেলেন ব্যাপারটা, একমাত্র ফাতেমার বাবা ছাড়া। ফাতেমার বাবা কিছুটা রাগী প্রকৃতির মানুষ, তাঁকে আগেভাগে জানিয়ে গোলমাল বাঁধাতে চান না ফাতেমার মা। তবে ফাতেমার ধার্মিক দাদা, মানে ফাতেমার বাবার মামা, যিনি ফাতেমাদের বাসায়ই থাকতেন, উনি প্রেম কিংবা ছেলেমেয়ের মেলামেশা বা একসঙ্গে চলাফেরা করাটা শরিয়ত সম্মত নয় বলে মন্তব্য করলেন। তবে আদরের নাতনিকে চোখের জলে ভাসাতে চান না বলে, শরিয়তসম্মত একটা উপায় খুব শিগগিরই তিনি নিজে খুঁজে বের করবেন বলে সবাইকে জানিয়ে দিলেন।
ফাতেমার দাদা রঞ্জুকে বাসায় ডেকে এনে পরিচিত হলেন, পাড়ার মসজিদে এসে একসঙ্গে নামাজ পড়ার দাওয়াত দিলেন। রঞ্জুর দুরুদুরু মনে কিছুটা আশার সঞ্চার হতে লাগল। দাদা আল্লাহওয়ালা মানুষ হিসেবে যখন চেষ্টা করছেন, তখন সুন্দর একটা সমাধান নিশ্চয়ই বেরিয়ে আসবে। দাদা কিছুদিন পরে রঞ্জুকে প্রস্তাব দিলেন, তাঁর সঙ্গে একবার তাবলিগ জামাতে যেতে। তাবলিগে আমলের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা সেরে নেওয়ার তাঁর ইচ্ছার কথাও তাঁকে জানালেন।
ফাইনাল পরীক্ষার ছয় সপ্তাহ আগে রঞ্জু ফাতেমার দাদার সঙ্গে তাবলিগ জামাতে তিন দিনের জন্য গেল। গুরুত্বপূর্ণ আলাপ বলতে দাদা যা বললেন, ‘এই যে তোমরা যুবক বয়সে মেলামেশা করছ, রিকশায় পাশাপাশি বসছ, চাকরির ইন্টারভিউ দিতে দূর-দূরান্তে একসঙ্গে যাচ্ছ, এসব কিন্তু কোনো কিছুই শরিয়ত সম্পন্ন না। বিবাহ–বহির্ভূত মেলামেশাতে শরিয়তের কড়া নিষেধ আছে। তবে, যেহেতু তোমরা একজন আরেকজনকে পছন্দ করো এবং বিয়ে করে সংসারী হতে চাও, তাতে আমাদের কোনো আপত্তি নাই। এখনো চাকরি-বাকরি পাওনি বলে এই মুহূর্তে তোমাদের পক্ষে সংসারী হওয়াটা যেমন সম্ভব নয়, ঠিক তেমনি বিয়ের আগ পর্যন্ত মেলামেশা বন্ধ রাখতেও তোমরা এ যুগের ছেলে-মেয়েরা রাজি হবে না। ফাতেমা আমার খুব আদরের নাতনি, সেই সুবাদে তুমিও আমার খুব প্রিয়জন। আমি চাই না, তোমাদের পবিত্র সম্পর্কের সঙ্গে কোনো প্রকার গুনাহ জড়িয়ে থাকুক বা আল্লাহ তায়ালার কোন বিধিনিষেধ তোমার অমান্য করে চলো। তাই আমি তোমাদেরকে গুনাহ থেকে দূরে রাখতে এবং আল্লাহর নিকট দায়মুক্ত থাকার জন্য একটা প্রস্তাব দিচ্ছি। তুমি রাজি হলে, বেশি কাউকে না জানিয়ে আমাদের বাসায় আমি ধর্মীয়ভাবে তোমাদের বিয়ের কাজটা গোপনে সেরে নিতে চাই। পরে এ নিয়ে কথা উঠলে সব দোষ আমি আমার নিজের কাঁধে নিয়ে নেব। এমনকি প্রয়োজন হলে তোমার পরিবারের সঙ্গে আমি একাই লড়াই করব। তুমি রাজি থাকলে বাসায় ফিরে আমি ফাতেমার মায়ের সঙ্গে আলাপ করে আগামী শুক্রবারেই তোমাদের বিয়ের আয়োজনটা করে ফেলব। এবার তুমি ভেবে দেখো, ধর্মীয়ভাবে বিয়েটা হয়ে গেলে তোমাদের মঙ্গলই হবে এবং তোমাদের পক্ষে লড়াই করতে আমার জন্যও অনেক সুবিধা হবে। একবার বিয়েটা হয়ে গেলে তোমাদেরও আর কেউ কখনো আলাদা করার সুযোগ পাবে না।’
দাদার কথাগুলো শুনে রঞ্জু প্রথমে কিছুতেই সাহস করতে পারছিল না। ফাতেমার সঙ্গেও তার এই ব্যাপারে কথা বলার প্রয়োজন আছে এবং তাতে দুজনের মতামতটাও এক হওয়া জরুরি। আবার এটাও ভাবছে, দাদা মুরব্বি মানুষ, তাঁর কথাতে রাজি না হলে যদি তিনি বিগড়ে যান, তাতেও বিশাল বিপত্তি নেমে আসার সম্ভাবনা আছে। এদিকেও বিপদ, ওদিকেও বিপদ।
রাতে দাদা ঘুমিয়ে পড়ার পরে রঞ্জু মসজিদ থেকে বের হয়ে ফাতেমাকে ফোন করে। দাদার পরিকল্পনার কথা বিস্তারিত বলে। সব শোনে ফাতেমাও দ্বিধা-দ্বন্দ্বে আটকে পড়ে। সবশেষে সিদ্ধান্তটা রঞ্জুর ওপরেই ছেড়ে দেয় ফাতেমা। চিন্তা, গবেষণা আর উত্তেজনায় সারা রাত ঘুমাতে পারেনি সে। পরের দিন আছরের নামাজের পরে জামাত থেকে বিদায় নেবে তাঁরা, এর আগেই দাদাকে কিছু একটা বলতে হবে তার।
জোহরের নামাজ শেষ করে দাদার সঙ্গে একই গ্রুপে খেতে বসেছে রুঞ্জু। দাদা খেয়াল করে দেখলেন, সে কেমন যেন আনমনা হয়ে গেছে, ঠিকমতো খেতেই পারছে না বেচারা। খাবার পর্ব শেষ করে দাদা তাকে কাছে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘আমি বুঝতে পারছি, আমি তোমাকে খুব কঠিন একটা পরীক্ষায় ফেলে দিয়েছি। আল্লাহর ওপর ভরসা রাখো ভাই, খাস দিলে চিন্তা করো এবং আল্লাহর কাছে সিদ্ধান্ত চাও। আল্লাহই সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক। আল্লাহ তোমার ওপর রাজি–খুশি থাকলে তিনি নিজেই তোমার ক্বলবের মধ্যে তাঁর সিদ্ধান্তটা প্রবেশ করিয়ে দেবেন। তোমাদের দুজনের সুখের জন্য আমি নিজের আল্লাহর দরবারে চোখের পানি ফেলছি। কবুল করার মালিক আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন।’
তাবলিগ জামাতের দৈনিক সূচি অনুযায়ী সবাই দুপুরের খাবারের পর কিছুটা সময় বিশ্রাম নেন। গতরাতে নির্ঘুম থাকার কারণে বিশ্রামের সময়টায় রঞ্জু কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিল। আছরের নামাজ শেষে বিদায়ের আগমুহূর্তে রঞ্জু দাদাকে তার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিল। যেকোনো কিছুর বিনিময়ে হলেও সে ফাতেমাকে তার জীবনসঙ্গী হিসেবে চায়।
(পর্ব তিন)
রঞ্জুর ডায়েরির পাতাগুলো একটার পর একটা পড়তেই থাকল শায়ের। অনেক রাত হয়ে গেছে, সকালে অফিস যেতে হবে, তারপরেও পড়া থামাতে পারছে না শায়ের। রঞ্জুর জীবনটা যতটা সহজ সমীকরণের ভেবেছিল শায়ের, আসলে ততটা সহজ নয়। অনেক বেশি রোমাঞ্চকর ছিল রঞ্জুর যৌবনকাল। অন্তত শায়েরের নিজের জীবনের চেয়ে অনেক বেশি রোমাঞ্চকর। পরদিন বাসায় ফিরে আবারও রঞ্জুর ডায়েরি নিয়ে পড়তে বসল শায়ের।
ফাইনাল পরীক্ষা পুরোপুরি শেষ হওয়ার আগেই চাকরির কনফারমেশন পেয়ে গেল মঞ্জু। তাই আর দেরি না করে রেজাল্ট হওয়ার আগেই চাকরিতে যোগ দিতে ঢাকায় গেল রঞ্জু। কিছুদিনের মধ্যে ফাতেমাও একটা ব্যাংকে যোগ দিল। সারা দিন মুঠোফোনে টেক্সট আর বাসায় ফিরে আলাপন চলছিল ঠিকই, তবুও দুজনের মধ্যে চরম মাত্রার দুশ্চিন্তা কাজ করছিল। কবে ইউনিভার্সিটির রেজাল্ট প্রকাশ হবে, কবে রঞ্জুর চাকরি পারমানেন্ট হবে, কবে দুই পরিবারের মধ্যে সমঝোতা হবে এবং কবে তারা দুজন সামাজিকভাবে বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ করে সংসার শুরু করবে?
নানা প্রশ্ন জল্পনা–কল্পনা নিয়েই চিন্তা করত দুজনে। এর মধ্যে রেজাল্ট হলো, দুজনেই ভালো সিজিপিএ নিয়ে পাশ করল, তবে রঞ্জুর চাকরি এখনো পারমানেন্ট হয়নি এবং এই চাকরিতে রঞ্জুর বেতনও খুব বেশি ভালো না। তারপরও ফাতেমাকে হারানোর ভয় রঞ্জুকে সব সময় তাড়া করে বেড়াত। ফাতেমার পরিবার থেকে প্রস্তাব আসল, ইউনিভার্সিটির সমাবর্তনের দিন যদি রঞ্জুর বাবা-মা আসেন, তাহলে ফাতেমার বাবা-মা এবং দাদার সঙ্গে তাদের পরিচয় হয়ে যাবে। সমাবর্তনের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলে ফাতেমার দাদা রঞ্জুর বাবা-মাকে রাতের খাবারের জন্য বাসায় দাওয়াত দেবেন।
ইতিমধ্যে, ফাতেমার দাদা রঞ্জুর বাবার খুব ঘনিষ্ঠ একজন উকিলকে খুঁজে বের করেছেন। রাতের দাওয়াতে উকিল সাহেবও উপস্থিত থাকবেন এবং এই উকিল সাহেবের মাধ্যমেই বিয়ের প্রস্তাবটা উপস্থাপন করাবেন রঞ্জুর বাবা-মা ও ফাতেমার বাবার সামনে। সেখান থেকেই ফাতেমার দাদা বিয়ের প্রস্তাবনা সমর্থন দিয়ে বিয়ের ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক রেওয়াজ মোতাবেক কথাবার্তা চালিয়ে যাবেন। কিন্তু এই পরিকল্পনা কাজ করল না, কারণ রঞ্জুর বাবা-মা সমাবর্তন অনুষ্ঠানে আসতে পারেননি। সেদিন রাতে রঞ্জুর দাওয়াত ছিল ফাতেমাদের বাসায়। সে বাসায় আসার পর ফাতেমার মা ও দাদা মিলে আলোচনায় বসলেন তার সঙ্গে। প্রাথমিক পরিকল্পনা যেহেতু ভেস্তে গেল, তাই এখন রঞ্জুকেই বাড়ি গিয়ে তার পরিবারের কাছে বলতে হবে, যাতে তারা প্রস্তাব নিয়ে ফাতেমাদের বাসায় আসেন। এই কাজ রঞ্জুকে ঢাকায় ফিরে যাওয়ার আগেই করতে হবে। কারণ, ফাতেমার বাবার কাছে প্রায় প্রতিদিনই নতুন নতুন প্রস্তাব আসছিল এবং তার বাবাও মেয়ের বিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে বেশ উদ্যোগী।
ফাতেমার বাবা রাগী মানুষ, কোনো প্রস্তাব পছন্দ হলে যদি কোনো পক্ষকে কথা দিয়ে বসেন, তাহলে তাকে ফেরানো সত্যিই মুশকিল হয়ে দাঁড়াবে। রঞ্জুকে যেতেই হবে তার পরিবারের কাছে, এ ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না সেই মুহূর্তে। পরদিন সকালে রঞ্জু তার বাড়িতে গেল। ভরসার পাত্রী প্রিয় ভাতিজিকে দিয়ে বাবা-মা, ভাই-বোন সবার কাছে বলল ফাতেমার কথা। মঞ্জু বিয়ে করতে চায়, তাও আবার প্রেমের বিয়ে শুনে বোনেরা সবাই সাফ জানিয়ে দিলেন, ‘আমরা এসব কোনো ঝামেলার মধ্যে নেই। বাবা-মা আছেন, ভাইয়েরা আছেন, তাঁরাই সিদ্ধান্ত নিক, কী করা উচিত।’
ভাইয়েরা সবাই বেঁকে বসল, উল্টাপাল্টা কথা বলতে শুরু করল... ‘আমরা সবাই এত দিন ধরে পরিবারের ঘানি টানতে টানতে হয়রান, আর উনি পড়াশোনা শেষ করার আগেই প্রেমিকা জোগাড় করেছেন, চাকরি পাওয়ামাত্র নিজের পরিবারের কথা চিন্তা না করেই বিয়ে করার খায়েশ হয়েছে উনার। এত বড় একটা পরিবার কীভাবে চলে তার কোন খবর জানে ও, পরিবারে আজ পর্যন্ত কিছু করার মুরাদ হয়েছে ওর, ইত্যাদি।’
রঞ্জুর বাবা বলার মত কিছুই যেন পাচ্ছিলেন না। পরিস্থিতি উত্তপ্ত দেখে রঞ্জুর মা বলার চেষ্টা করছিলেন, ‘ঠিক আছে, রঞ্জু আমাদের জানিয়েছে, এখনই তো আর আমাদের কিছু করতে হবে না, কিছুদিন যাক পরে আমরা ভেবে দেখব কী করা যায়।’
মায়ের কথা শুনে বড়ভাই তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন, ‘তুমিও মা, এই হতচ্ছাড়া রঞ্জুর পক্ষে কথা বলছ। ভেবে দেখব মানে কী? এই বিয়ে হবে না, এটাই সিদ্ধান্ত। আর রঞ্জুকে বলো, ও যেন এই মুহূর্তে বাড়ি থেকে চলে যায়।’
উচ্চকণ্ঠে কথাবার্তা শুনতে শুনতে রঞ্জুর বাবা ধমক দিয়ে সবাইকে চুপ করতে বললেন। কিন্তু বড় ভাইয়ের রাগটা একটুও কমল না। তিনি ভেবেই নিয়েছিলেন, মা-বাবা দুজনেই মনে হয় রঞ্জুকে সমর্থন করছিলেন। পাশের রুম থেকে সে আর তার ভাতিজি মিলে সব কথা শুনছিল।
এই পর্যায়ে এসে রঞ্জু নিজের ভয়টাকে আর সামাল দিতে পারছিল না। ভেতরে গিয়ে কারো সঙ্গে দেখা করার সাহসটাও আর অবশিষ্ট ছিলো না। রঞ্জু ভাতিজিকে বুকে জড়িয়ে আদর করলো আর কপালে চুমু খেয়ে বলেছিল, ‘বাবা-মাকে বলিস, আমি চলে যাচ্ছি। আমাকে যেন উনারা ক্ষমা করে দেন।’
রাতের বেলা খাবার টেবিলে বসে রঞ্জুর বাবা জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘রঞ্জু কোথায়?’
প্রশ্ন শুনে বড় ভাই আবারও ক্ষেপে গেলেন। বাবার সঙ্গে রাগ করে সেদিন রাতেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে চলে গেলেন। এক সপ্তাহ যাবত কেউ জানতেই পারছিলেন না, বড় ভাই কোথায় ছিলেন?
ফেরার পথে রঞ্জু ফাতেমার কোনো কলই রিসিভ করেনি, যদিও ফাতেমা একের পর এক কল দিয়েই যাচ্ছিল। ঢাকার পথে রওয়ানা হওয়ার আগে শুধু ফাতেমাকে একটা টেক্সট করেছিলো, ‘এখন আর কল করো না প্লিজ, আমি কথা বলতে পারব না। পরে তোমাকে বিস্তারিত সব বলবো।’