রানু-২

রানু যে কি না সংসারের হাল ধরতে একটি নাটকের গ্রুপে নাম লিখিয়েছিল, তার উদ্দেশ্য মোটেও দেশ বা দশের কাছে সংস্কৃতিকে তুলে ধরা ছিল না। তাঁর একটাই উদ্দেশ্য টাকা, যা দিয়ে তার সংসার চলবে; মায়ের মেজাজ ঠিক থাকবে। মন্দির বলো, মসজিদ বলো, গীর্জা বলো, আর হাসপাতাল, স্কুল—সবকিছুর পেছনে এই মহামূল্যবান টাকা কাজ করে। নাটক করতে গিয়ে রানুর মাথায় আরও বেশি করে এ ভাবনা স্থায়ী হয়েছে।

ছেলেদের প্রেমিকা চলে গেলেও এত কষ্ট পায় না, যতটা কষ্ট পায় টাকার উৎস বন্ধ হয়ে গেলে। এই তো সেদিন সে এরকম এক নাটকে ব্যর্থ প্রেমিকার অভিনয় করল, যেখানে ছিল টাকার ষড়যন্ত্র। তার জীবনেও কি টাকা কোনো ভূমিকা রাখবে? এই টাকা বড় অদ্ভূত জিনিস! নাকি অদ্ভূত ক্ষুদার্থ পেট? কার জন্য চলছে এ পৃথিবী? এ জন্য কবি বলেছেন, ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়।’ যারা খাবারের কষ্ট করেনি কখনো, তারা গল্পের বই পড়েও তা উপলবদ্ধি করতে পারবে না যে, খাবারের কষ্ট কী? পৃথিবী চলছে এই খাবারের জন্য। নাহ আমাকে শুধু খাবার না, অনেক কিছু করতে হবে। এসব কথা ভাবতে ভাবতে সে ঘুরে দাঁড়ায়।

রানুর মনের চঞ্চলতা বাড়লেও চালচলনে কেমন ধীর-স্থির হয়ে উঠেছে। পরিবারের বড় মেয়ে বলেই হয়তো এমন হয়েছে। মা ইদানীং অনেক শান্ত। বেশি না পারলেও সামান্য কিছু হলেও সংসারের হাল ধরতে পেরেছে সে। বাবার জন্য তার কষ্ট হয়। বাবা যে ইচ্ছে করে বেকার তাও নয়। একসময় ভালো ব্যবসা করতেন। এককালে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি ছিলেন। তারপর নিজেই একটা ফার্মেসি দিয়েছিলেন। ছোটবেলায় তাদের তেমন কোনো অভাব ছিল না। বাবা বাজারের বড় কৈ মাছ, রুই মাছ, মাংস সবই কিনে আনতেন তাদের জন্য। তখন শুধু সে আর ঝুনু। দু বোনকে দু পাশে বসিয়ে মুখে তুলে ভাত খাওয়াতেন। বাবার হাতের মাখানো ভাতের স্বাদ অন্য রকম। এখনো তিনি খেতে বসলে আগে ভাত মাখিয়ে দু লোকমা করে তাদের মুখে দেন। কারণ তিনি জানেন, তাঁর হাতের ভাত মাখা না খেলে তাদের পেট ভরে না। মাছ-মাংস না থাকলেও বাবার হাতের আলু ভর্তা মাখা ভাতও অমৃত মনে হয়। ডালের সঙ্গে লেবু চিপে এমনভাবে স্বাদ তৈরি করেন যে, খেতে অসাধারণ লাগে। সে নিজে এটা করতে পারে না। করতে গেলে এত টক হয় যে, মনে হয় তেতুল খাচ্ছে।

মা বাবার একদম উল্টো। বাগানের ঝিঙা, চিচিঙ্গা, কাঁকরোল ভাজি করেন। ওর ছোট বোন বা ভাই খেতে না চাইলে হাতের খুন্তি উঁচিয়ে বলেন, ‘মুখে দে না হয় এখনই একটা দিব।’ ওরা ভয়ে গিলে ফেলে। কিন্তু চিবোতে তাদের কষ্ট হয়। চোখের ভাষায় বোঝাতে চায় সবজি একটা খাওয়ার বিষয় হলো? মণি চোখে পানি নিয়েও খেয়ে ফেলে। ইদানীং সে যখন টাকা পায়, নিজেই কান্দিরপাড় বাজারে ঢুকে একটা বড় ইলিশ মাছ বা বোয়াল মাছ কিনে নিয়ে আসে। এতে সবচেয়ে খুশি হন বাবা। বাবার সে সুখী চোখ দেখলে তার চোখে পানি চলে আসে আনন্দে। নিশ্চয় বাবা মিস করেন ব্যাগ ভরে ভরে বাজার নিয়ে আসার দিনগুলো! বাবা খুব শৌখিন, রুচিশীল মানুষ ছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করে স্ট্রোক করে এই দুরবস্থায় চলে গেলেন।

আজ জীবনের সবচেয়ে বড় কষ্ট সে তার বাবাকে দিয়েছে। সে এসএসসি পরীক্ষায় পাস করতে পারেনি। খুব সামান্য মার্কের জন্য অঙ্কে ফেল করেছে। মার্কস দ্বিতীয় বিভাগের হলেও অঙ্কে ফেল। কী করবে বুঝতে পারে না। বাবা উদাস চোখে বলেছেন, ‘তোমার আর দোষ কী? দোষ তো সব আমার! আজ আমার এ পঙ্গু অবস্থা যদি না হতো, তোমার পড়াশোনা ঠিকমত চলত। যাও মন খারাপের কিছু নেই। আগামী বছর ইমপ্রুভমেন্ট পরীক্ষা দিতে পার কি না দেখ।’ রানু চোখ মুছতে মুছতে সরে যায়। এখন পড়াশোনায়ও মন বসে না। এক সময় তারও খুব ইচ্ছে ছিল যে, সে ডাক্তার হবে। সাদা অ্যাপ্রোন পরে হন হন করে হাঁটবে। গলায় ঝোলানো থাকবে স্টেথো। ব্যস্ত হয়ে রোগীর হাতটা ধরে নাড়ীর গতি দেখবে। কোনো স্বপ্নই তো সফল হয় না। জীবন মনে হয় বিরাট এক নাট্যমঞ্চ। সে শুধু অভিনয় করে যাচ্ছে।

রানু এখন হাঁটছে এক অমসৃণ পথে। সে পথের নাম যাদু, যা ধরাছোঁয়ার বাইরে। অথচ এ অমসৃণ পথের কথা ভাবলেই সে নিজেকে বেশি আনন্দিত দেখে। মনে হয় সবকিছু সুন্দর! বুঝতে পারে না কি করবে? যাদু একদিনই এসেছিল তাদের বাসায়। সে চা, বোম্বে টোস্ট, নুডলস কত কী করল, কিন্তু সে শুধু চা আর চানাচুর খেল। অনেক সাধাসাধির পর একটা বোম্বে টোস্ট নিয়েছে। তারপর সে বাবার সঙ্গেই অনেকক্ষণ কথা বলেছে। ভাব দেখে মনে হলো বাবাই তার বন্ধু। সে এখানে চা-নাশতা দেওয়ার জন্য এসেছে এমন কেউ। যাক ভালোই হয়েছে একদিকে। নতুবা খুব অস্বস্তি হতো। ঝুনুও হরিণের মতো কান খাড়া রাখত। মা এলে হয়তো উল্টাপাল্টা বলত।

যাদব, মানে যদু খেয়াল না করলেও সে দেখল, তার ভাই ও মণি মিলে সব খাবার খেয়ে ফেলেছে। চোখ দিয়ে ইশারা করেও থামাতে পারেনি। এমন পেটুক সবগুলো! লজ্জায় সে জন্য সে নিজেই কাপ পিরিচ সব ট্রেতে তুলে নিল। রান্নাঘর পর্যন্ত আসতে পারেনি, একটা কাপ ঠাস করে পড়ে গেল। ইশ, তার এত মায়ার কাপের কড়াটা ভেঙে গেল!

দাঁতে দাঁত চেপে চোখ বড় করে একবার নিলয়ের দিকে তাকালো। নিলয় দু’কানে হাত দিয়ে সরি বলছে। সে আর শক্ত থাকতে পারল না। হেসে ফেলে। একটু পরে তার বাবাই তাকে গলা ছেড়ে ডাক দিলেন। সে পাশেই ছিল। একটু দূর থেকে পর্দার আড়ালে শুধু যাদবকে দেখছিল। সে সামনে এসে দাঁড়াল। বাবা বললে, ‘যাদব তো উঠতে চাচ্ছে।’ যাদবও বলে উঠল, ‘হ্যাঁ এবার আসি।’ রানু ‘আচ্ছা’ বলে, তার পেছন পেছন বিল্ডিংয়ের নিচ পর্যন্ত এল। যাবার বেলা একটা চিঠি দিয়ে গেল যাদু।

সে খুব সাবধানে খুলে দেখল, ‘কাল নদী দেখতে যাব। বাসায় বলো রিহার্সেল আছে ৩টা থেকে। এ কথা বলে এসো। শিল্পকলা একাডেমির কাছে আমি অপেক্ষা করব। তারপর অনেক দূর যাব, গোমতী নদীর পাড়ে।’ এতটুকুই। রাতে উত্তেজনায় সে ঠিকমতো ঘুমাতে পারল না। এই চিরকুট সে কয়েক শ বার পড়ে ফেলেছে। সে মনে মনে ভাবে গোমতী কুমিল্লা শহরের সঙ্গে। এটই ভালো হবে। শহরে শালবনবিহার আছে। সে দিকেও কি যাবে? যাদব নদী খুব পছন্দ করে। একদিন তুমুল আড্ডায় বলেছিল, তার মামার বাড়ির কাছে ডাকাতিয়া নদী, যে নদী বয়ে গেছে বাগমারা উচ্চ বিদ্যালয়ের পেছন দিয়ে। তার মামাতো ভাই যখন স্কুলে পড়ত, সেও যেত সঙ্গে। অনেক স্মৃতি তার এই নদী নিয়ে। নদীর পারে বেদেদের বাড়ি ছিল। তারা সাপ ধরত। তাদের নৌকা নিয়ে নদীতে ঘুরতে যেত। তবে তার গোমতী নদী বেশি ভালো লাগে। এটা অনেক বিশাল। এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে রানু।

সকাল থেকে অনেক কাজ করার পরও যেন সময় যাচ্ছে না রানুর। সে এক ঘণ্টা আগে বের হলেই হবে। উত্তেজনায় তার হাত পা কাঁপছে। জীবনের প্রথম কারও সাথে একা দেখা করবে। তাও তার পছন্দের মানুষ। সে কী পরবে? শাড়ী না সালোয়ার কামিজ? সালোয়ার কামিজই ভালো। এখন তার বেশ কয়েকটা ভালো কাপড় আছে। বেছে বেছে সে লাল ওড়নাওয়ালা পোশাকটাই পছন্দ করে রাখল। সে মোটরসাইকেলের পেছনে বসে আছে। হাওয়ায় তার লাল ওড়না উড়ছে। তার মনে হচ্ছে বাকের ভাই ও মোনার প্রেমের মতো সেই বিখ্যাত গান ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজছে। ‘হাওয়া মে উড়তা যায়ে তেরে লাল দোপাট্টা মলমল কা হোঁ জি...।’ হঠাৎ ঝুনুর চিৎকারে তার ধ্যান ভাঙে।

-কী হয়েছে?
-কী আর হবে? আমি সারা দিন বাঁদির মত ঘরে খাটি। আজ স্কুল বন্ধ। আমি একটু বিশ্রাম নিতে পারি। তুমি তো কিছু করতে পার। সব সময় বাইরে থাকার বাহানা।
এ কথার কোনো জবাব না দিয়ে রানু মিটমিট করে তাকায়। মিথ্যে বলার মতো যথেষ্ট যোগ্যতা থাকলেও আজকে যেন শব্দ ভুলে গেছে।
-লক্ষ্মী বোন হঠাৎ রিহার্সেল পড়ে গেল।
-আমি বুঝি রাহার্সেল না কী? আগে বলো আমাকে নতুন ড্রেস কিনে দেবে, নতুবা মাকে বলে এমন প্যাঁচ লাগাব।
-আচ্ছা যা দিব। (মনে মনে একটা বিচ্ছিরি গাল দেয়)

রিকশা নিয়ে রানু সময়ের ১০ মিনিট আগেই পৌঁছে গেল। একটু দূরে হেঁটে গিয়ে যাদব মোটরসাইকেল নিয়ে রানুর কাছে এগিয়ে এল।
-ঠিকমতো বস। ভয় পেলে আমার কাঁধে হাত রাখ।
-ভয় পাব না। বলে সিটের একপাশে ডান হাত দিয়ে ধরে বসল।

কিন্তু তার ভয়ই লাগছে। আত্মীয়স্বজন কেউ দেখলে রক্ষা নেই। মায়ের কানে পৌঁছালে শেষ। এমনিতেই বলে দিয়েছেন, ‘হিন্দু ছেলেপেলের সঙ্গে মিশবা কম।’ সে কোনো রকম ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে বসল। তারপর শহর ছেড়ে দূরে গ্রামের পথে নেমে এল। বাতাসের তোড়ে ডরভয় সব চলে গেল। কখন যে যাদবের কাঁধে হাত রেখেছ সে নিজেও জানে না।

এদিকে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে গেছে। রানু তখনো ফিরে আসেনি। মা বারবার ঘর-বাহির করছেন। অন্য দিন তো এত দেরি হয় না। এ দু দিন বোনের বাড়ি ছিলেন। বোন খুব অসুস্থ। স্কুলে বলতেই ছুটি দিল। ফিরে মেয়েকে ঘরে না দেখে কেন যেন অসহায় লাগছে। মায়ের ঘরে-বাইরে আসা যাওয়া দেখে ঝুনু কেঁদে ফেলল। সে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আপা মনে হয় যাদব ভাইয়ের সঙ্গে চলে গেছে।’

-কোথায় গেছে?
-জানি না। বলেছে, রিহার্সেল। কিন্তু আসলে না।
-বলেছে যেহেতু, তখন শেষ করে আসবে। মা ভেতরে ভেতরে ভয় পেলেও ওপরে সব কেমন শক্ত হয়ে মেয়ের পথ চেয়ে বসে রইলেন।