শোন একটি মুজিবরের থেকে...
বেশ কয়েক বছর আগের কথা। আমি ঢাকা থেকে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা পরিদর্শনের জন্য মাদারীপুর গেছি। সেদিন সম্ভবত পূর্ণিমার রাত ছিল। সন্ধ্যা বেলায় সূর্যের মত বিশাল একটা চাঁদ উঠেছে। সংস্থাটির পরিচালক আইয়ুব ভাই বেশ খোলামেলা একটা জায়গায় চেয়ার–টেবিল সাজিয়ে আমাকে ডাকলেন জোছনার আলোতে বসে গল্প করার জন্য। বসন্তের শুরুতে কেমন একটা শির শিরে হাওয়া দিচ্ছিল। তার সঙ্গে দূর থেকে ভেসে আসছিল মাইকে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ।
আমি বললাম, কী অসাধারণ একটা ভাষণ। যেমন বজ্রকণ্ঠ, তেমন গোছানো কথা। মাত্র ১৭/১৮ মিনিটের একটা অলিখিত ভাষণে স্বাধীনতা–উন্মুখ বাঙালি জাতিকে একটা পরিপূর্ণ দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। শুনলেই শরীর গরম হয়ে যায়।
আইয়ুব ভাই আমার কথা শুনে বললেন, আপনার কেমন লাগে জানি না। তবে আমার অনুভূতি একেবারেই অন্যরকম। আমি ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ সরাসরি বঙ্গবন্ধুর মুখ থেকে ভাষণ শুনেছি।
আমি বিশেষ আগ্রহ নিয়ে আইয়ুব ভাইয়ের দিকে তাকালাম। বললাম, তখন আপনার বয়স কত? তখন কি আপনি ঢাকায় থাকতেন? আইয়ুব ভাই বললেন, তখন আমার বয়স তেরো/চৌদ্দ বছর হবে। আমি এই গ্রামেই থাকতাম। তখন তো ঢাকার সঙ্গে বাস যোগাযোগ এত ভালো ছিল না। বেশ কয়েকটি ফেরি পার হয়ে ঢাকা যেতে সারা দিন লাগত। আমরা যাওয়া–আসা করতাম লঞ্চে। বাবার পকেট থেকে ১০ টাকা চুরি করে তিন বন্ধু মিলে রাতের বেলায় লঞ্চে চেপে বসেছি। পরদিন দুপুরে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ রমনা রেসকোর্স ময়দানে, বর্তমানে যেটি সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। সকাল থেকেই সেদিন রেসকোর্স ময়দান লোকে লোকারণ্য। চারিদিক থেকে ব্যানার, ফেস্টুন নিয়ে দলে দলে লোক আসছে। আমরা ছোট মানুষ পেছন থেকে কিছু দেখতে পাব না, তাই সামনের দিকে একটা গাছে উঠে বসেছিলাম। আমাদের মত আরও অনেকেই সেদিন গাছে উঠেছিল।
মানুষের মিছিল, স্লোগান। অপেক্ষার পর অপেক্ষা। তারপর লাখ লাখ মানুষের অপেক্ষার পালা শেষে সাদা পায়জামা–পাঞ্জাবি ও হাতাকাটা কালো কোট পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আসলেন মঞ্চে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুরু করা মাত্র সবাই চুপ। যাকে বলে পিন পতন নীরবতা।
আমি বললাম, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর উচিত ছিল, আওয়ামী লীগের হাতে সুষ্ঠুভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। অথচ তারা তা না করে বাঙালিদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকেন, কিন্তু ১ মার্চ অনির্দিষ্টকালের জন্য অধিবেশন মুলতবি ঘোষণা করে। এর প্রতিবাদেই পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন ও বিক্ষোভ শুরু হয়।
আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ সারা দেশে হরতাল পালিত হয়। ৩ মার্চ পল্টনের জনসভায় তিনি পূর্ব বাংলায় অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণ দেন। মার্চের শুরুতেই স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্রসহ পতাকা উড়ানো হয়েছে। স্বাধীনতার ইশতেহার ঘোষণা করা হয়েছে। নির্বাচন করা হয়েছে জাতীয় সংগীত। কিন্তু স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান আন্দোলনের ব্যাপারে বা স্বাধীনতার প্রশ্নে ৭ই মার্চ কোন চূড়ান্ত ঘোষণা দেবেন—সে জন্যই ছিল মানুষের অধীর আগ্রহ।
আইয়ুব ভাই বললেন, আমারা ভেবেছিলাম সেদিনই স্বাধীনতা ঘোষণা করা হবে। আর সেই ইতিহাসের সাক্ষী হওয়ার জন্যই আমরা সেদিন ঢাকা গিয়েছিলাম। মজার ব্যাপার, স্বাধীনতার ঘোষণার বিষয়ে আমরা এতটা নিশ্চিত ছিলাম যে, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শেষ হওয়ার পরও আমরা বুঝতে পারিনি তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা দেননি। ভাষণ শেষে স্বাধীনতার পক্ষে স্লোগান মুখর হয়ে উঠেছিল ঢাকার রাস্তাগুলো। পরে লোকজনের মুখে আর পত্র-পত্রিকা থেকে জেনেছি, যাতে বঙ্গবন্ধুকে দেশদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত করা না হয়, সে জন্য তিনি সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি।
আমি বললাম, বঙ্গবন্ধু সেদিন সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা না দিলেও স্বাধীনতার জন্য সব ধরনের দিকনির্দেশনাই দিয়েছিলেন। ভাষণে তিনি একদিকে যেমন যুদ্ধের প্রস্তুতি, যুদ্ধ পরিচালনা, যুদ্ধকালে কার ভূমিকা কেমন হবে, সেটি যেমন বলেছেন তেমন ভাষণটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, স্বাধীন বাংলাদেশের রূপরেখাটি কেমন হবে, তারও দিক নির্দেশনা আছে।
এই একটি ভাষণের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু একটি জাতিকে স্বাধীনতার জন্য উজ্জীবিত করেছেন, প্রস্তুত করেছেন মুক্তিযুদ্ধের জন্য এবং সেই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেও এই ভাষণ প্রেরণা জুগিয়েছে, এ কারণেই এত বছর পরও মানুষ তাঁর ভাষণ তন্ময় হয়ে শোনে।
বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বলেছেন, ‘আমরা সংখ্যায় মেজরিটি, কিন্তু একজন মানুষও যদি ন্যায্য কথা বলে আমরা তা মেনে নেব’—এর চেয়ে বড় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ আর কি হতে পারে? তিনি বলেছেন, এই বাংলায় হিন্দু বা মুসলমান, বাঙালি বা অবাঙালি সকলেই এ দেশের সন্তান, তাদের জানমালের নিরাপত্তার দায়িত্ব হলো জনগণের। তিনি দলের নেতা–কর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, আমাদের যেন বদনাম না হয়। এ কথা থেকেই বোঝা যায়, তিনি কতটা মানবিক আর অসাম্প্রদায়িক চরিত্রের অধিকারী ছিলেন।
৭ই মার্চের ভাষণের বড় শিক্ষা হলে, কোনো জাতিকে তার আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং স্বাধিকার থেকে বঞ্চিত করা যায় না৷ বন্দুকের নল বা অস্ত্রের মুখে ‘দাবিয়ে’ রাখা যায় না৷ এই সত্যই আমরা মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করেছি। যা পৃথিবীর সব মুক্তিকামী জাতি গোষ্ঠীর জন্য একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ অনেক ভাষায় অনুবাদ হয়েছে, গবেষণা হয়েছে, পাঠ্যপুস্তকেও ঠাঁই পেয়েছ, ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক এই ভাষণকে বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেসকো।
আমরা যখন এসব আলোচনা করছি তখন বাতাসে ভেসে আসছে, ...এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশা আল্লাহ!
ভাষণ শেষে কিছু সময় বিরতি দিয়ে এবার গান ভেসে এল।
শোন একটি মুজিবরের থেকে
লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি
আকাশে-বাতাসে ওঠে রণী
বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ।।
আইয়ুব ভাই জিজ্ঞাসা করলেন, এ গানটা কি গোবিন্দ হালদারের লেখা?
আমি বললাম, না। এই ভুলটা অনেকেই করে। মুক্তিযুদ্ধের সময় লেখা অনেক কালজয়ী গানের স্রষ্টা গোবিন্দ হালদার। যেমন, মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি’ কিংবা ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে, রক্ত লাল রক্ত লাল।’ কিন্তু এখন মাইকে যে গানটি বাজছে সেটি লিখেছেন বিশিষ্ট গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার আর সুর করেছেন অংশুমান রায়। এই গানটি লেখা নিয়ে একটা মজার গল্প প্রচলিত আছে।
১৯৭১ সালের এপ্রিলের মাঝামাঝি একটা সময়ে গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার ও সুরকার অংশুমান রায়সহ বেশ কয়েকজন কলকাতার শহরতলি গড়িয়ার একটা চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন। সেই সময় তাদের আরেক বন্ধু আকাশবাণীর প্রযোজক উপেন তরফদার একটা ক্যাসেট প্লেয়ারে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ শোনাচ্ছিলেন। ভাষণ শুনে সবাই যখন পূর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ করছিলেন, তখন গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার সিগারেটের প্যাকেটের ভেতরের সাদা কাগজটা বের করে লিখে ফেলেন এই কালজয়ী গান। গানের ইতিহাস শুনে আইয়ুব ভাই বাতাসে ভেসে আসা গানের কথাগুলো শোনার জন্য কান পাতলেন।
এই সবুজের বুকে চেরা মেঠো পথে
আবার যে যাব ফিরে, আমার
হারানো বাংলাকে আবার তো ফিরে পাব
শিল্পে-কাব্যে কোথায় আছে
হায়রে এমন সোনার খনি।।
বিশ্ব কবির ‘সোনার বাংলা’,
নজরুলের ‘বাংলাদেশ’,
জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’
রূপের যে তার নেই কো শেষ, বাংলাদেশ।
আমি একটু বিরতি দিয়ে বললাম, এখন তো দিন পাল্টিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনছি । স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গান শুনছি। ১৯৭৫ সালের পর তো একটা দীর্ঘ সময় এগুলোর কোন অস্তিত্বই ছিল না।
আইয়ুব ভাই আমার কথা শুনে হাসলেন। বললেন, দিন পাল্টে নতুন দিন এসেছে ঠিকই, কিন্তু চাঁদাবাজি, মাস্তানি আর দুর্নীতির হাত থেকে তো আমরা রেহাই পাচ্ছি না। বঙ্গবন্ধু তো এই বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেননি। আমি আইয়ুব ভাইকে আশ্বস্ত করে বললাম, বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তো নিরন্তর চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
আইয়ুব ভাই মনে হয় আমার কথা শুনে হাসলেন। আকাশের চাঁদটা তখন একটা ঘন মেঘের আড়ালে মুখ লুকাল। আইয়ুব ভাইয়ের হাসিটা ঠিক পরিমাপ করতে পারলাম না।
আইয়ুব ভাই বললেন, চাঁদটা মেঘে ঢাকা পড়েছে। জোছনাটা চলে গেল। চলেন উঠে পড়ি। গানের শেষ অংশটুকু তখনো মাইকে বেজে চলেছে।
জয় বাংলা বলতে মন রে আমার
এখনো কেন ভাবো আবার
হারানো বাংলাকে আবার তো ফিরে পাব
অন্ধকারে পূর্বাকাশে, উঠবে আবার দিনমণি।।