সামান্থা তাহলে কোথায়?
বেসমেন্ট পরিষ্কার করতে গিয়ে সচরাচর প্রয়োজন নয় এমন জিনিস ক্লোজেটে গোছাচ্ছিল হাসান। পেশায় সে একজন ব্যাংকার। এইচএসবিসির জনসংযোগ ম্যানেজার হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার ‘এমপ্লয়ি অব দ্য ইয়ার’ নির্বাচিত হয়ে নেতৃত্ব দিয়েছে লিডারশিপ ট্যুরে। গান, নাটক, আবৃত্তি, উপস্থাপনা আর লেখালেখি ওর নেশা। তাই আলবেনির বাঙালি কমিউনিটির খুব পরিচিত ও জনপ্রিয় মুখ হাসান। নানা দিকে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা বাঙালিদের নিয়ে সে ইতিমধ্যে একটি বাংলা সাংস্কৃতিক গ্রুপ গঠন করেছে। সবাই মিলে দেশীয় বিশেষ বিশেষ দিবসগুলো উদ্যাপনসহ পিকনিক, পিঠা উৎসব করে থাকে। বাঙালি কমিউনিটিতে সে একজন ভালো সংগঠক হিসেবেও পরিচিত।
নিউইয়র্কের রাজধানী আলবেনির শহরতলি নিসকাউনায় হাসানদের পুরোনো বাড়ি। সেটি বিক্রি করে সবে সে আলবেনি শহরে ব্রিকের তৈরি এই বিশাল বাড়িটি কিনেছে। এখানকার বাড়িগুলো খুব দূরেও নয়। নতুন প্রতিবেশীরা খুব প্রফেশনাল ও বনেদি মানুষ। এই বাড়ির মালিক অ্যামেন্ডা মিলার নিজেও চিকিৎসক। নিসকাউনার কাঠের ফ্রেমের তৈরি বাড়িটি নিয়ে তাদের ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। এ ছাড়া চারদিকে এমন গভীর বন, নিস্তব্ধতা ও একাকিত্ব আর ভালো লাগছিল না নিরা বা হাসানের। হাসান নিজে খুব আড্ডাপ্রিয় মানুষ। নিরা নিরিবিলি পছন্দ করলেও, নিরেট নীরবতায় সেও হাঁপিয়ে উঠেছিল। যাই হোক, ভাগ্য ভালো সে মোটামুটি ভালো দামেই বাড়িটি বিক্রি করতে পেরেছিল। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব সবাই এখন এই নতুন বাড়ি দেখে আনন্দিত। বিশেষ করে নিরার বাবা-মা বেজায় খুশি। বাড়িটিতে প্রচুর ক্লোজেট। সব ঘরেই সূর্যের আলো আসে। রিয়েল স্টেট ডিলার জনের মারফত বাড়ির মালিক অ্যামান্ডার সঙ্গে কয়েক দফা কথা চালাচালি করে ৩৫০ হাজার ডলারে শেষ পর্যন্ত রফা হয়েছিল।
বাড়ি বদল করা চাট্টিখানি কথা নয়। গত এক সপ্তাহ ধরে যে ধকল যাচ্ছে তাতে তার আর নিরার জীবন বেরিয়ে যাচ্ছে বলা যায়। নিরা হাসানের স্ত্রী। রূপবতী ও খুব বুদ্ধিমতী মেয়ে। দোষের মধ্যে সে বেজায় অলস। আর ইদানীং প্রথমবারের মতো মা হওয়ার পর আলসেমি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। যেকোনো কাজ নানা অজুহাতে ‘পরে করব’ বলে ফেলে রাখতে তার জুড়ি নেই।
আজ ছুটির দিন থাকায় হাসান সকাল থেকেই কোমর বেঁধে বেসমেন্ট গোছানো এবং সাজসজ্জার কাজে নেমে পড়েছিল। সদ্য রং করা বেসমেন্টে এখনো রঙের কড়া গন্ধ থাকায় নিরা বেবিকে নিয়ে নিচে নামতে চায় না। বেসমেন্টে অনেকগুলো ওয়ার্কিং ক্লোজেট আছে। একটি বিশেষ ক্লোজেট মোছামুছি করতে গিয়ে ক্লোজেটের নিচের ড্রয়ারটি হাসানের হাতের টানে খুলে গেল। ড্রয়ারের ঠিক নিচেই গোপন কুঠুরি নজরে এল। হাসানের মনে পড়ল, এই ধরনের গোপন কুঠুরি ঢাকার বাড়ির স্টিলের আলমারিতেও সে দেখেছে। একটু টানাটানি করতেই সেটির পাল্লাও খুলে গেল। ছোট্ট সেই কুঠুরির পাল্লাটি খুলতেই দেখা গেল, সেখানে পড়ে আছে একটি ডায়েরি আর ছবির অ্যালবাম। বেসমেন্টটি হাসান ও নিরা নতুন করে সাজাতে চেয়েছিল। এটা হবে তাদের বসা প্লাস আড্ডা মারার একটি ওপেন স্পেস।
ডায়েরি আর ছবির অ্যালবাম একপাশে রেখে হাসান হাতের ফ্লাশ লাইটটি জ্বেলে ভালো করে কুঠুরির চারপাশ আর ভেতরে উঁকি মেরে দেখতে লাগল। নাহ, তেমন আর কিছুই নেই এখানে। মেয়েদের পায়ের সোনালি রঙের ইমিটেশনের একটা নূপুর আর কয়েকটি হ্যান্ডব্যান্ড ছাড়া। জিনিসগুলো অ্যালবামের পাশে রেখে আবার সব গোছাতে শুরু করল। এই ক্লোজেটটি তৈরি করা হয়েছিল দামি কাপড়, শীতের পোশাক এসব যত্নে রাখার জন্য। রিয়েল এস্টেটের এজেন্ট বলেছিল, এই ক্লোজেটের কাঠ বিশেষ ঔষধি গাছ থেকে বানানো। এই গাছে পোকামাকড় তাড়ানোর ঔষধি গুণ রয়েছে।
নিরার ও নিজের শীতের পোশাক ক্লোজেটের হ্যাংগারে ঝুলিয়ে দিল হাসান। সব গোছানো শেষ হতেই হাসান আয়েশ করে একটা সিগারেট ধরাল। সিগারেট টানতে টানতেই কৌতূহলবশত পাশে রাখা অ্যালবামের পাতা উল্টিয়ে দেখতে শুরু করল সে। একজন সাদা তরুণীর নানা ভঙ্গিমার ছবিতে অ্যালবামটি ঠাসা। তরুণীটি অসম্ভব সুন্দরী তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বয়স বাইশ-তেইশ হবে। কয়েকটি ছবিতে তার সঙ্গে আরও একজন তরুণীকে দেখা যাচ্ছে। দুজনই মনে হচ্ছে সমবয়সী। সম্ভবত তারা টুইন। শুধু একজনের চুল কোঁকড়া; অন্যজনের মসৃণ এবং সোজা। কোঁকড়ানো চুলের মেয়েটির চিবুকে বড় একটি তিল আছে। যার জন্য তাকে অন্যজনের থেকে আলাদা করে চেনা যায়। পেছনের দিকে কিছু পারিবারিক ছবিও আছে। সম্ভবত বাবা-মার সঙ্গে তোলা কিছু ছবি। সাঁতার কাটা, ঘোড়ায় চড়া, পাহাড়ে হাইকিং করার অনেক রকম ছবি। সিগারেটটি শেষ হওয়ায় তা অ্যাস্ট্রেতে ফেলে দিল হাসান।
আরও অনেক কাজ পড়ে আছে। বেসমেন্টে রাখা কুইন সাইজ খাট সে একাই ঠেলেঠুলে বেসমেন্টের একেবারে পশ্চিম দিকের এক কোনায় নিয়ে সেট করে দিল। খাটের দুই পাশে দুটো বেডসাইট টেবিল বসিয়ে তার একটিতে একটি টেবিল ল্যাম্প সেট করল। তার আর নিরার সংগ্রহের বই দিয়ে সাজিয়ে রাখা বুককেসটির পাশেই বসাল অ্যামান্ডার রেখে যাওয়া মূল্যবান আবলুস কাঠের কালো রকিং চেয়ার। বাড়ি বিক্রি করার সময় বাড়ির সঙ্গে সঙ্গে অ্যামান্ডার বেশ কিছু ভারী ফার্নিচারও সে নামমাত্র দামে তাকে দিয়ে গেছে।
বিশাল বেসমেন্টের চারদিকে তাকিয়ে হাসান খুব শান্তি পেল। একধারে দশ চেয়ারের বিশাল ডাইনিং টেবিল। কাচের জিনিসপত্র রাখার শোকেস। মাঝখানে এক সেট সোফা। অন্যদিকে আরেক কর্নারে বেশ নিরিবিলি। নিরিবিলিতে এখানে পড়াশোনা ও লেখালেখির কাজ করবে এটাই হাসানের মুখ্য উদ্দেশ্য। রকিং চেয়ারটি হাসানের খুব পছন্দ হয়েছে।
অনেকক্ষণ একা একা কাজ করতে গিয়ে ক্লান্ত হাসান রকিং চেয়ারে দুলতে দুলতে একসময় ঘুমিয়ে পড়েছিল। হঠাৎ হাসানের খেয়াল হলো কেউ একজন তার খুব কাছে এসে দাঁড়িয়েছে; অবাক বিস্ময়ে ঝুঁকে তার মুখের কাছে মুখ এনে লক্ষ করছে। এমনকি আগন্তুকের তপ্ত নিশ্বাসও সে তার মুখের ওপর অনুভব করল। তারপর সেই আগন্তুক রকিং চেয়ারের চারদিকে হেঁটে বেড়াতে লাগল। সম্ভবত তার পায়ের নূপুর টুংটাং করে মৃদু একটা শব্দ করছিল। আবছা সেই অবয়ব আবারও ঘুরে তার দিকে এগিয়ে কাছে চলে আসতেই ঘুমের মধ্যেই হাসানের সারা শরীর শিরশির করে কাঁটা দিয়ে উঠল। হাসান দেখল, ধবধবে ফরসা এক নারীমূর্তি এগিয়ে এসে তার রকিং চেয়ারে কোলের ওপর বসে পড়ল। প্রবল এক ভয়ে হাসান হঠাৎ করেই ঝাঁকি খেয়ে জেগে উঠল। সে অনুভব করল প্রচণ্ড তৃষ্ণায় মুখ এবং গলা পর্যন্ত শুকিয়ে গেছে। সে তাড়াতাড়ি চেয়ার থেকে উঠে বসল। কী আশ্চর্য! সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুমের মধ্যে অদ্ভুত একটা স্বপ্নও দেখছিল।
হাসানের খেয়াল হলো ওপর থেকে নিরার কোনো আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে না অনেকক্ষণ। বড় ধরনের কাজকর্মের চাপ পড়লেই সে ডুব দিতে পছন্দ করে। আর তার নতুন অভ্যাস হলো মেয়ে ঘুমালেই সেও মেয়ের পাশেই ঘুমিয়ে পড়ে।
বেশ কয়েক বছর আগে হাসান দম্পতিদের ‘দাম্পত্য-কলহের’ সবচেয়ে সাধারণ বিষয়গুলো নিয়ে একটি গদ্য লিখেছিল ফেসবুকের বিভিন্ন লেখালেখির গ্রুপে। তখন অবশ্য তার সঙ্গে অনেক ‘দিল্লিকা লাড্ডু’ খাওয়া নারী ও পুরুষকুল সহমর্মিতা জানিয়েছিল। এমনকি দু-একজন সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিল, ‘আরে ভাই, এই কাহিনি তো ঘরে ঘরে’। লাড্ডুর সাতকাহন লিখে হাসান দুই পক্ষের প্রিয়ভাজনে পরিণত হয়েছিল। লাড্ডু না খাওয়া গ্রুপের ছেলেদের সঙ্গে সঙ্গে তার অনেক মেয়ে ফ্যানও জুটে গিয়েছিল। বিবাহিত নারী-পুরুষ অনেকে তাকে কিছুটা তির্যক চোখে দেখতে শুরু করলেও অনেকে সমব্যথী হলো।
নিরা তার সেই মেয়ে ভক্তকুলেরই একজন। আগে তার বসবাস ছিল শুধু ফেসবুকে; এখন ফেসবুক ছেড়ে সে পুরোপুরিভাবেই হাসানের বুকে এবং ঘরে প্রবেশ করেছে। সেখানে শক্তপোক্ত আসন করে, তার হৃদয় কঠিন হাতে মুঠোয় তুলে নিয়েছে। যদিও নিরা এখন আর হাসানের লেখা পড়ে না। কিন্তু ইতিমধ্যেই তার আগাপাশতলা সব পড়া শেষ। হাসানের দাড়ি, কমা, যতিচিহ্ন সব তার মুখস্থ। সে জানে কোথায় কখন রাশ টেনে ধরতে হবে। কখন, কীভাবে তার মেয়ে ফ্যানগুলোকে কুপোকাত করে উচিত শিক্ষা দিতে হবে। ফেসবুকের বাইরে হাসানের জীবনে এহেন ফ্যানরা যেন এক পাও আগাতে না পারে সে ব্যাপারেও বেশ সজাগ।
কিন্তু এখন নতুন সমস্যা হলো, কন্যা সন্তান হওয়ার পর নিরার সমস্ত মনোযোগ হাসানের ওপর থেকে চলে গিয়ে কন্যাকে ঘিরেই ঘুরপাক খাচ্ছে। শুরুতে এটাকে ভালো মনে করে হাসানের ‘বন্দী হৃদয়-মন’ নেচে উঠেছিল। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই সে অনুভব করল, এই নারীদের খেদমত করতে করতেই হয়তো তার এই জীবনকে একদিন গুডবাই জানাতে হবে।
হাসান বেসমেন্ট থেকে ওপরে উঠে এল। দেখল, নিরা সবে গোসল সেরে ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুখে ক্রিম মাখছে। হাসানকে দেখামাত্র সে মধুর হেসে বলল, ‘আহারে সোনা, তুমি একা একা এত কষ্ট করছ? আমাকে ডাকলে না কেন জানু? অবশ্য পিচ্চিটাকে রেখে নিচে যাই কী করে বলো? এইতো শাওয়ারও নিলাম দরজা খোলা রেখেই। যদি বাবুটা আমাকে না দেখে কাঁদে সেই ভয়ে।’
‘ওকে, বেশ করেছ। লাঞ্চের কী ব্যবস্থা বলো তো? কিছু কি ফ্রিজে আছে, না ফোন করে অর্ডার করব? কাল সকাল থেকে কিন্তু আমার অফিস শুরু।’
‘ভেব না, লাঞ্চের ব্যবস্থা আছে। আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি; তুমি ততক্ষণ শাওয়ার শেষ করে গরম-গরম খাবে এসো।’
হাসান একটু অবাক হলো, নিরা কিছু রান্না করেছে বলে তো মনে হয় না। ঘরে তো রান্নাবান্না হয়েছে এমন কোনো চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু যেমন উৎসাহ নিয়ে কথা বলছে, মনে হচ্ছে সত্যিই ভালো কোনো খাবার আছে। সন্দেহ নিয়েই বাথরুমে ঢুকে গেল। ভাবল, দেখাই যাক নিরার ঝোলা থেকে কী এমন সারপ্রাইজ বের হয়।
পরিপাটি হাসান ডাইনিংয়ে এল। এ যে দেখছি মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। টেবিলে শোভা পাচ্ছে মেঘলা দিনের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত খাবার। ধূমায়িত ভেজিটেবল খিচুড়ি। পাশে চাক চাক করে কাটা বড় বেগুন ভাজা। কাচের সুদৃশ্য সেপারেটর দেওয়া পেয়ালায় রসুন সহযোগে কালোজিরা ভর্তা আর কাঁচা রসুন দিয়ে শুকনো মরিচের ভর্তা। আগের রান্না করা গরুর মাংস ভুনাকে পেঁয়াজ আর গাঢ় সবুজ হেলোপিনো দিয়ে নতুন করে মেকআপ করা হয়েছে।
খুশিতে ডগমগ হাসান বলেই ফেলল, ‘এহেন রাজসিক লাঞ্চ আজ ভাগ্যে আছে তা কিছুক্ষণ আগে আমি তো স্বপ্নেও ভাবেনি। আই লাভ ইউ বেবি!’ ‘স্বপ্ন’ শব্দটা বলতে গিয়েই হাসানের মনে পড়ল সদ্য দেখা স্বপ্নের স্মৃতি। গ্রিক দেবীর মতো ধবধবে সাদা, অপস্রিয়মাণ নারী মূর্তি, ছবির অ্যালবাম আর ডায়েরির কথা। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই সে হিসেবি হয়ে উঠল। এই মুহূর্তে এসব কথা তুলে খাবারের আনন্দ মাটি করতে চায় না।
সারা দিন টিপটিপ বৃষ্টির পর বিকেলে আকাশ কালো করে মুষলধারে বৃষ্টি নামল। বাইরে কোথাও না গিয়ে হাসান মেয়ে আর নিরার সঙ্গে বিছানায় শুয়ে কিছুক্ষণ খুনসুটি করল। এরপর ভাবল, ডায়েরিটা একটু পড়ে দেখতে হবে। মনোযোগ দিয়ে দেখতে হবে ছবিগুলো। মেয়ে আর নিরা ঘুমিয়ে পড়লে কাঠের সিঁড়ি আর মেঝেতে যাতে শব্দ না হয় সে জন্য সে পা টিপে টিপে বেসমেন্টে নামল। অদম্য কৌতূহল নিয়ে ডায়েরি পড়তে শুরু করল।
ডায়েরির মালিক সামান্থা মিলার। সামান্থা এবং অ্যামেন্ডা যমজ বোন। সামান্থার মতে, ‘অ্যামান্ডা খুব অবসেসিভ টাইপের মেয়ে। সে ছোটবেলা থেকেই সারাক্ষণ মা-বাবার ভালোবাসা পাওয়া নিয়ে অবসেসনে ভুগত। এমনকি বড় হয়েও সে তাদের বন্ধু নিয়েও একই সমস্যা করত। তারপর তা রীতিমতো বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে গেল সামান্থার বয়ফ্রেন্ড অ্যালেক্সকে নিয়ে। অ্যালেক্স! তাকে যে জীবন দিয়ে ভালোবাসে সামান্থা। সে অ্যালেক্সকে হারাতে পারবে না। এ ধরনের টুকিটাকি ইমোশনাল কথাবার্তা লেখা আছে ডায়েরির পাতায়। আরও আছে বন্ধুদের সঙ্গে পিকনিক, ক্যাম্পিং, মাতাল হওয়ার নানা গল্প।
লেখা আছে অ্যালেক্সের সঙ্গে প্রথম ডেট, প্রথম চুমু ও প্রথম সেক্স করার অনুভূতি। অ্যামেন্ডার সঙ্গে নানা বিষয়ে বিরোধ, হয়রানি আর হেরে যাওয়ার বিবরণ। সবশেষে ভেঙে পড়া সামান্থার কিছু আহাজারি, দুঃখ আর ব্যর্থতার ইতিহাস। তবে কী সে অ্যালেক্সকে হারাতে বসেছিল? তাও অ্যামেন্ডার কাছে? তারপর সামান্থার কী হলো? কে এই অ্যালেক্স? এই প্রশ্নগুলো হাসানের মাথায় ঘুরপাক খেতে শুরু করল।
ডায়েরি পড়তে পড়তে হাসানের মনে খানিকটা অপরাধবোধও কাজ করছিল। এটা নিশ্চয়ই অনধিকার চর্চা। গোপনে কারও ব্যক্তিগত লেখা পড়া অনুচিত। কিন্তু অপরিচিত সামান্থা আর অ্যামেন্ডার কাহিনি তাকে চুম্বকের মতো টানতে শুরু করল। সে অনুমান করল অ্যামেন্ডা নিশ্চয়ই এই বাড়ির মালিক, তাহলে সামান্থার ডায়েরি এখানে কী করে এল? সে ছবির অ্যালবাম খুলে সামান্থার পারিবারিক ছবিগুলো খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করল। ছবিগুলোর বেশ কয়েকটি আউটডোরের হলেও অনেকগুলো এই বাড়িতেই তোলা। এই বাড়ির লনে, পোর্চে, লিভিং রুমে। আরও কিছু ছবি বেসমেন্টে। এই কালো রকিং চেয়ারটিতেই বসা সামান্থা বা অ্যামেন্ডা। বেসমেন্টের সিঁড়ির ধাপে গলাগলি করে বসা দুই বোনের ছবি। বাড়ির ব্যাকইয়ার্ডে কাঠের দোলনায় বসা দুই বোন। লনের সবুজ ঘাসে শুয়ে লুটোপুটি করা দুই যুগল কন্যা। তবে কোনটা যে সামান্থা এবং কোনটা অ্যামেন্ডা তা হাসান কী করে বুঝবে। কারণ সে কখনো এই বাড়ির মালিক অ্যামেন্ডাকেও দেখেনি। তবে বাড়িটির ছবি দেখে অনুমান করা যায় এই বাড়িটি ওদের ফ্যামিলি হাউস। যেকোনো কারণে উত্তরাধিকার সূত্রে অ্যামেন্ডা এই বাড়ির মালিক হয়েছে। তাহলে সামান্থা এখন কোথায়?
হঠাৎ করেই প্রশ্নটি মাথায় এসে হাসানকে চমকে দিল। তাহলে কী সামান্থার কিছু হয়েছে? সামান্থা কী আর নেই? হাসান মরিয়া হয়ে আবারও খুঁটে খুঁটে ছবি দেখল, বারবার ডায়েরি পড়ল। কিন্তু আর কিছুই বলছে না এই ছবি ও ডায়েরি। হাসানের ঘুম ছুটে গেল। সে বাড়ির ইতিহাস ঘেঁটে মিলার পরিবারের সব তথ্য বের করার চেষ্টা করল। নাহ্, বাড়ি কিছুই বলছে না সামান্থার ব্যাপারে। তবে মিস্টার ও মিসেস মিলারের একজন গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে মারা যান, আরেকজনের হয়েছে স্বাভাবিক মৃত্যু। তবে কারও মৃত্যুই বাড়িতে হয়নি। হয়েছে হাসপাতালে। বাড়ির রেকর্ডে কোনো অপমৃত্যুর কথা নেই। সুতরাং বাড়িটি কোনোভাবেই অভিশপ্ত নয়। অ্যামেন্ডা এখনো বহালতবিয়তে বেঁচে আছে। বাকি রইল সামান্থা।
আরও অনেক তথ্য সংগ্রহ করার পর জানা গেল সামান্থা মিলারের নিখোঁজ হওয়ার সংবাদ। সারাটোগা লেকের পাড় থেকে তার রহস্যজনক অন্তর্ধানের গল্প। যেখানে পাওয়া গেছে তার পরিত্যক্ত কিয়ক বোট, সানগ্লাস, গাড়ির চাবি। কিন্তু পুলিশ বা উদ্ধারকারী দল তন্ন তন্ন করেও প্রায় সাড়ে চার মাইল লম্বা লেকে তার কোনো সন্ধান পায়নি। তাহলে সামান্থা এখন কোথায়? একই প্রশ্ন হাসানের মাথায় ঘুরপাক খেতে শুরু করল।
বিদ্যুৎ চমকের মতোই হাসানের মনে এল, তাহলে স্বপ্নে দেখা মেয়েটিই কি…ভাবতেই হাসানের বুকের ভেতরে ধক করে উঠল। সামান্থা মিলার খুব কাছে এসে তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল! হাসান তার তপ্ত নিশ্বাস পর্যন্ত অনুভব করেছে। কিন্তু কেন?