সেকালের গাড়ি
যশোর বিমানবন্দরে নেমে টারমাক ছেড়ে এগিয়ে তারের জালির বেড়াটি পার হতেই দেখলাম সামনে একটা গাঢ় জলপাই রঙের জিপ। ঢাকায় আমাদের যেমনটি ছিল, ঠিক তেমন। এই গাড়ির জন্মস্থান আমেরিকা। ওরা সদ্য স্বাধীন পাকিস্তানকে গোড়া থেকেই অর্থ, প্রযুক্তি ও পণ্য দিয়ে সহায়তা করে আসছিল। এসব সহায়ক প্রকল্পের অংশ হিসেবেই এই জিপগুলো পাকিস্তান পেত, আর সামরিক বা বেসামরিক কর্মকর্তাদের ব্যবহারের জন্য বরাদ্দ করত। জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই আমি আমাদের বাড়িতে সরকারি বরাদ্দে এমন একটি জিপ আব্বার ব্যবহারের জন্য সব সময় থাকতে দেখেছি।
উইলি ওভারল্যান্ড নামে মার্কিন একটি কোম্পানির তৈরি করা এই গাড়িগুলোর প্রচলিত নাম ছিল উইলি’স জিপ। গাড়ির ব্যাপারে ছেলেবেলা থেকেই আমার উৎসাহ। বেড়ে ওঠার সময় এই জিপগাড়িগুলো অনেককাল ধরে চড়তে ও দেখতে হয়েছে। সেই সময়টাতে এর ঠিকুজি কুলুজি সম্পর্কে আমার কৌতূহলের কোনো শেষ ছিল না। কিছুটা পড়ে আর বেশিরভাগ শুনে একসময় সেগুলো ভালোই জানতাম। সবটা এখন মনে নেই; যতটুকু মনে আছে বলি।
১৯৩৫ সাল থেকে পৃথিবীজুড়ে ঘটবে এমন বড় একটা যুদ্ধের আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। তার প্রস্তুতিতে ১৯৪০ সালে আমেরিকার সমর দপ্তর দেশের ১৩৫টি গাড়ির কোম্পানিকে যুদ্ধক্ষেত্র ও অন্যান্য প্রতিকূল পরিবেশে চলার উপযোগী একটা গাড়ির নকশা তৈরির জন্য দর প্রস্তাব দিতে আমন্ত্রণ জানায়। দর প্রস্তাবের শর্তগুলো খুব কঠিন ছিল। ১১ দিনের মধ্যে বন্ধ খামে দরপত্র, ৪৫ দিনের মধ্যে কার্যকরী প্রোটোটাইপ বা নমুনা এবং তার ৭৫ দিনের মধ্যে ৭০টি টেস্ট মডেল ডেলিভারি দিতে হবে। এত কঠিন শর্ত পূরণ করার সামর্থ্য প্রায় কোনো কোম্পানিরই ছিল না। শেষ পর্যন্ত শুধু বানটাম ও উইলি ওভারল্যান্ড নামের দুটি গাড়ির কোম্পানি সাহস করে দরপত্র জমা দিল। ডিজাইন ও প্রাযুক্তিক উৎকর্ষ বিবেচনা করে বানটাম কোম্পানি প্রতিযোগিতায় উইলিসকে হারিয়ে কাজটা পেল। কিন্তু মাঠে নেমে বানটাম দেখল একসঙ্গে এত গাড়ি তৈরি করা ওদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাদের অপারগতা জানতে পেরে মার্কিন সরকার ফোর্ড ও উইলি কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করে অনুরোধ করল, তারা যেন এই গাড়িটি বানিয়ে দেয়।
দরপত্রের শর্তানুযায়ী, সমর দপ্তর বানটামের গাড়ির নকশার মালিকানা পেয়ে গিয়েছিল। ফোর্ড ও উইলিকে তারা সেই নকশা ব্যবহার করেই গাড়িগুলো বানাতে বলল। সেই মতো দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে উইলি ৩ লাখ ৬৩ হাজার ও ফোর্ড ২ লাখ ৮০ হাজার জিপ তৈরি করে দেয়। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ফোর্ড এই গাড়ি বানানো বন্ধ করে দিলেও উইলি তাদের জিপ বানানো চালিয়ে যেতে থাকে। উইলি ওভারল্যান্ড কোম্পানিটিও পরে একসময় বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু গাড়িটি তখনো খুব জনপ্রিয়। তৈরি-সত্ত্ব কিনে নিল ক্রাইসলার মোটর কোম্পানি, যারা এখনো সেটা বানিয়ে চলেছে। জিপ ব্র্যান্ডের বিভিন্ন মডেলের যে গাড়িগুলো এখন বাজারে রয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় জিপ র্যাংলার। এই র্যাংলারই তার পূর্বপুরুষ উইলিস জিপের মূল ডিএনএ আজও বয়ে বেড়াচ্ছে।
জানি এটা কিছুটা ধান ভানতে শিবের গীত হয়ে যাচ্ছে। অন্য একটা গল্প বলব বলে এই লেখাটি শুরু করেছিলাম। সেটা থেকে ক্রমশ সরে যাচ্ছি, আর আমার গল্পটি হয়ে উঠছে নিছক গাড়ির গল্প। তা হোক না হয়। তোলা থাক মূল গল্পটি; বরং, শিবের গীতই গাই।
গাড়ির ব্যাপারে ছেলেমানুষি উৎসাহ ছিল খুব বেশি, তাই নতুন স্কুল, নতুন বাড়ি, নতুন বন্ধু-এসব বাদ রেখে যশোরে আসার আগে থেকেই আশায় ছিলাম, বদলি হয়ে ওখানে যাওয়ার পর আব্বা হয়তো জিপ বাদে অন্য কোনো গাড়ি পাবেন? কিন্তু অপেক্ষারত সরকারি গাড়িটিকে দূর থেকে দেখে হতাশই হলাম; নাহ, সেই একই! অবশ্য সেই আমলে সংখ্যা ও বৈচিত্র্যে গাড়ির বিস্তৃতি তেমন ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও চিকিৎসকদের তখন বিলেত আমেরিকায় পড়তে যাওয়ার সুযোগ হতো। তাঁরা ফেরার সময় অন্য মালপত্রের সঙ্গে পারলে একটি করে গাড়ি জাহাজে তুলে নিতেন। প্রায় শতভাগ ক্ষেত্রেই সেগুলো হতো গুবরে পোকার মতো বিদঘুটে আকৃতির একটি যন্ত্রযান; রংটি অবধারিতভাবে কালো। সেই গাড়িটির নাম ছিল মরিস মাইনর। প্রায় শতভাগ বলছি এই জন্য যে, এই গাড়িটি ছাড়া আরও একটি গাড়ি কোনো কোনো বিদেশ ফেরত বাঙালি সঙ্গে করে নিয়ে আসতেন। এটিও গুবরে পোকার মতই দেখতে; তবে, মরিস মাইনরের মতো অত গাবদা-গোবদা নয়, আর রঙে সম্পূর্ণ বিপরীত; সাদা; কখনো কখনো আকাশ নীল। এই গাড়িটি জার্মান, ফক্সওয়াগন বিটল; অর্থাৎ নামেই এটা গুবরে পোকা। এগুলো মরিস মাইনরের মত চার দরজার নয়, দুই দরজার।
জিপের বদলে অন্য কিছু দেখার আশা ছিল, কারণ ভাগ্যবান কিছু কর্মকর্তা তত দিনে সরকারি বরাদ্দে অন্য ধরনের কিছু গাড়ি পেতে শুরু করেছেন। সেগুলো কি? এখন শুধু দুটি গাড়ির কথা মনে পড়ে, ডাটসান ব্লু-বার্ড, আর টয়োটা করোনা। যদিও জাপানি এই গাড়িগুলোর ওপর তখনো মানুষের পুরোপুরি ভক্তি আসেনি। কিন্তু ইউরোপীয় গাড়ির তুলনায় দাম কিছুটা কম এবং চড়ায় ও দেখায় অনেক গুন ভালো হওয়ায় এগুলোর ব্যাপারে মানুষের আগ্রহ বাড়ছিল। ষাটের দশকের গোড়ার দিকের যে সময়টার কথা বলছি, সেই সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে উচ্চবিত্ত মানুষের সংখ্যা চেষ্টা করলে হাতের আঙুলে গুনে ফেলা যেত। অবাঙালি কিছু ধনী ব্যবসায়ী বাংলায় থাকতেন, তাঁরা অবশ্য ঝকঝকে মার্সিডিজ বেঞ্জ নিয়ে রাস্তায় বেরোতেন। মজার ব্যাপার হলো সে সময়ের ঢাকায় ট্যাক্সিগুলো ছিল মার্সিডিজ বেঞ্জের, যার সবগুলোতেই ছিল মিটার বসানো। ব্যক্তি-মালিকানায় আরও কয়েক রকমের গাড়ির দেখা পাওয়া যেত তখন। এর মধ্যে ইউরোপীয় ভক্সল ভিক্টর, ফোর্ড প্রিফেক্ট ও কনসাল কর্টিনা উল্লেখযোগ্য। গড়পড়তার বাইরের এই গাড়িগুলো কিনতেন বাঙালি উচ্চবিত্তরা। বলতে ভুলে গেছি, গড়পড়তার তালিকায় আরও একটা গাড়ি ছিল, বিলেতের অস্টিন কোম্পানির গাড়ি; নাম অস্টিন মিনি। মিস্টার বিনের ছবিতে তাঁর যে গাড়িটি দেখা যায়, ঠিক সেটি। হ্যাঁ, আরও এক ঘরানার গাড়ি সড়কে মাঝেমধ্যে দেখা যেত। সেটার সম্পর্কে বলা আগে ভারতবর্ষে যন্ত্রচালিত গাড়ির ইতিহাসটি সংক্ষেপে বলে নিই।
উপমহাদেশে আসা প্রথম যন্ত্রচালিত গাড়িটি আনেন পাতিয়ালার মহারাজা, ১৮৯২ সালে। সেটি ছিল বাষ্পীয় শকট। ভারতে আসা জ্বালানি তেলে চালিত প্রথম গাড়িটি এনেছিলেন এক বাঙালিই। ১৮৯৭ সালে কলকাতার এক বাঙালি প্রথম এমন গাড়ি আনেন। পরের বছর আরও চারটি গাড়ি আসে ভারতবর্ষের বোম্বেতে। এগুলো আনেন সেখানকার পার্সি ব্যবসায়ীরা। এদের একজনকে নামে অনেকেই চেনেন, জামসেদজি টাটা। তৃতীয় যে শহরে গাড়ি চলল, সেটি মাদ্রাজ, সময় ১৮৯৯। প্রথমদিকে অমন একটি দুটি করে এলেও, ১৯১০ সালের ভেতরে ভারতবর্ষ গাড়িতে বোঝাই হয়ে গেল। শুধু বোম্বাইতেই ১৩ বছরে দশ হাজারের ওপর গাড়ি চলে এল। ১৯২৬ সালের আগেই কানাডা থেকে শুধু ফোর্ড কোম্পানির মডেল টি গাড়িই আসে ২২ হাজারের বেশি। গাড়ির এই রমরমা বাজার দেখে ১৯২৮ সালের মধ্যে আমেরিকার ফোর্ড ও শেভ্রলে/জিএম কোম্পানি ভারতে আলাদাভাবে দুটো সংযোজন কারখানা বসিয়ে ফেলে। ১৯২০-এর দশক থেকে শুরু হয় আমাদের বাংলায় কিছু কিছু বনেদি পরিবারের গাড়ি কেনা। বিদেশে তৈরি নয়, সেগুলোর বেশির ভাগই ছিল ভারতীয় কারখানায় সংযোজিত। প্রতিটি জেলায় তখন গড়পড়তা দু-একটি জমিদার পরিবার ছিল। স্ট্যাটাস সিম্বল হিসেবে এরাই প্রথম গাড়ি কেনা শুরু করেন। তারপর এগিয়ে আসেন কিছু ব্যবসা সফল উকিল, যশস্বী চিকিৎসক ও ধনাঢ্য ব্যবসায়ীরা। এই গল্পের সময়কাল ১৯৬৪ সাল। ১৯২৮ থেকে ১৯৫৩, এই সময়ে তৈরি শেভ্রলে, ফোর্ড ও অস্টিন গাড়ির ভারিক্কি উপস্থিতি সেই ১৯৬৪ সালের সড়কে বেশ দেখা যেত। এগুলোই হচ্ছে সেই অন্য ঘরানার গাড়ি, যার প্রসঙ্গ ওপরে এসেছিল।
এবার ফিরে যাই যেখানে শুরু করেছিলাম, সেখানে; যশোর বিমানবন্দরের পার্কিং লটে। আব্বার সরকারি জিপের ড্রাইভারের নাম নূর মোহাম্মদ। আমরা গাড়ির কাছাকাছি পৌঁছাতেই তিনি গাড়ির পেছনের দরজাটি খুলে দিলেন। দরজা যদিও বললাম ওটা ঠিক দরজা নয়। বরং বলা যায় ডালা। বন্ধ অবস্থায় ছিটকিনির মতো দুটো হুক ডানে ও বামে পেছনের চাকার ওপর দিকটায়, গাড়ির দু পাশে লাগানো থাকে। হুকগুলো খুলে দিলে সেটা নিচে ঝুলে পড়ে। পুরোপুরি নয়; দুই প্রান্তে দুটো শেকল ডালাটিকে আঁকড়ে রেখেছে। সে জন্য নিচে ঝুঁকতে ঝুঁকতে রাস্তার সমান্তরাল হতেই সেটা থেমে পড়ে। এভাবে গাড়ির পেছন দিকটা উন্মুক্ত হয় যাত্রী প্রবেশের জন্য। আমি আর আমার বোন ওদিক দিয়ে গাড়িতে ঢুকে পড়লাম।
জিপ গাড়িগুলোর সামনে দরজার অবস্থান থাকলেও তার স্থায়ী কোনো বন্দোবস্ত ছিল না। সামনের সিটগুলোতে ঢোকার জায়গাটি দু দিকেই খোলা। মাথার ওপরে একটা আচ্ছাদন ছিল, সেটি খাকি রঙের তেরপল জাতীয় কাপড়ের তৈরি। সামনের দরজার অংশটুকু বাদে দু পাশে, আর একদম পেছনটায় ছাদ থেকে ঝুলে নামত তিন ভাগে বিভক্ত তিনটি তেরপলের পর্দা। তাদের প্রতিটির মাঝে একটি করে স্বচ্ছ পলিথিনের জানালা। এই পর্দাগুলোর নিচের দিকে থাকত সারিবদ্ধ ছোট ছোট চামড়ার বেল্ট। গাড়ির দুপাশে আর পেছনের ডালার হুকের ভেতরে ঢুকিয়ে এই বেল্টগুলো এঁটে দিলে গাড়িটির পেছনের অর্ধেক সম্পূর্ণ আবরিত হয়ে যেত। চালক ও যাত্রী প্রবেশের খোলা অংশটিও বন্ধ করার ব্যবস্থা ছিল এক জোড়া পোর্টেবল দরজা দিয়ে। এগুলো লোহার ফ্রেমে জোড়া তেরপল দিয়ে তৈরি। শুকনো দিনে এগুলো সচরাচর ব্যবহার হতো না। শুধু দরকার মতো বর্ষাকালে গাড়িতে জুড়ে দেওয়া হতো। ছাদ, দেয়াল ও দরজার এই ঘেরাটোপ জিপের গায়ে লাগানো লোহার ফ্রেম থেকে ইচ্ছে করলে পুরোটাই খুলে ফেলা যেত। আরও একটা জিনিস ঠিক খোলা না গেলেও ভাঁজ করে নামিয়ে রাখা যেত, সেটা হচ্ছে চালকের সামনের কাচ, যাকে আমরা উইন্ডশিল্ড বলি।
গাড়িগুলো আমেরিকান, তাই চালকের আসন বামদিকে। তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে সপরিবারে ভ্রমণের সময় সামনের সিটে ড্রাইভারের ধার ঘেঁষে বসতেন আব্বা, দরজার দিকটায় আম্মা- ছোট বোনটিকে কোলে নিয়ে। এবারও তাই। মালপত্র নিয়ে আব্বা চলে আসতেই, সেগুলো তুলে দেওয়া হলো গাড়ির পেছনে দুই সারি বেঞ্চের মাঝখানে। গাড়িতে সবাই ওঠার পর আব্বা ড্রাইভারকে বললেন স্টার্ট দিতে। সেটা করতে গিয়ে বাধল সেই চিরপরিচিত ঝামেলা।
ড্রাইভার সাহেব চাবিটি জায়গামতো ঢুকিয়ে ঘোরাতেই, ইঞ্জিনটি আপত্তি জানাল। একটু গাঁইগুঁই করে একদম চুপ হয়ে গেল। এমনি কয়েকবার চেষ্টার পর ড্রাইভার ভ্রু কুঁচকে নেমে গেলেন। ইঞ্জিনের ঢাকনা খুলে নানান কারিগরির পর আব্বা ও ড্রাইভারের যৌথ প্রযোজনায় শেষ পর্যন্ত গাড়িটি স্টার্ট নিল। আমরা যশোরে আমাদের নতুন আবাসস্থলের দিকে রওনা হলাম।