'কী রে বউ, কেমন আছিস?'

‘কী রে বউ, কেমন আছিস?’ এই সম্বোধনের মাধ্যমে ২০০৪ সালে প্রথম পরিচয় হয় নিশাত আপার সঙ্গে। আর এই কয়েক দিন আগে তিনি চলে গেলেন হঠাৎ করেই।
সেদিন ছিল ১৯ জানুয়ারি। স্থান উদীচী স্কুল। বিকেলে ‘আই শকুন্তলা’ দেখতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি, ঠিক সে সময় খবর পেলাম নিশাত আপা অসুস্থ। উদীচীতে থাকতেই খবর পেলাম আমাদের নিশাত আপা আর নেই! কী শুনলাম বুঝে উঠতে পারলাম না। এলোমেলো হয়ে গেলে আমার মাথা। আমার বর বলল, ‘চলো কুইন্স থিয়েটারে। তারপর কথা হবে। এতটাই নার্ভাস লাগছিল ফোন ফেলেই রওনা দিয়েছিলাম। ফিরে এসে অনেক খোঁজাখুঁজি করে ফোন পেলাম।
নিশাত আপা সম্পর্কে লেখার যোগ্যতা তো আমার নেই, সাহসও নেই। তিনি কত বড় মাপের থিয়েটারকর্মী ছিলেন, তা পরিমাপ করার মতো দুঃসাহস আমার নেই। যার সঙ্গেই কাজ করেছেন, তাঁর সঙ্গেই একাত্ম হয়ে মিশে গেছেন। ব্যক্তিগত পরিচয় হোক বা পারিবারিক; কোনো দিন স্বার্থপরতা দেখিনি তাঁর মধ্যে। অনেককেই দেখেছি কাজ করতে গিয়ে নিজের স্বার্থটা দেখেন, আত্মপ্রচারকেই প্রাধান্য দেন। কিন্তু তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম। সব সমস্যাকে সহজেই দূরে সরিয়ে কাজ করেছেন নতুনদের সঙ্গে। এ জন্য সবার কাছ থেকে ভালোবাসাও পেয়েছেন শর্তহীন।
নিশাত আপার সঙ্গে কাটানো সময়ের স্মৃতিগুলো বারবার মনকে নাড়া দিচ্ছে। চোখের পানি ধরে রাখাটা কষ্টকর আমার জন্য। নিশাত আপা এতই পরিষ্কার মনের মানুষ ছিলেন যে, আমরা যারা নাটক করি বা সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সঙ্গে জড়িত, তাদের অনুপ্রেরণার উৎস ও অভিভাবক ছিলেন তিনি।
২০০৪ সালে ‘জল বালিকা’ নাটকের নির্দেশনা দিয়েছিলেন, সেই সুবাদে তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয় আমার। সেই থেকে আমাকে ডাকতেন ‘বউ’ নামে। ফোনেও কথা হতো নিয়মিত। ২০১৬ সালে যখন নিউইয়র্কে এলেন ‘হাছন রাজা’ নাটক করবেন বলে, তখন আমার সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁকে বাসায় রাখার। তিন মাস তাঁর খুব কাছাকাছি থেকে যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল, তা ভোলার নয়। জীবন যাপন করতেন অতি সাধারণভাবে। বাসায় থাকার সময় একেবারে পরিবারের একজন হয়ে গিয়েছিলেন। কখনো বুঝতেই দেননি তিনি অতিথি। যেন এক বড় বোন খুঁজে পেয়েছিলাম। খুশি হয়েছিলাম বহুদিন পর আমার বরকে শাসন করবার মতো কাউকে পেয়ে।
হাছন রাজা নাটকের শিল্পী কাস্ট করার সময় আমাকে বলেছিলেন, ‘মুক্তা তুই হাছনের মায়ের চরিত্র করবি।’ আমি বলছিলাম, ‘নিশাত আপা, আমার তো নাটক করা হয় না।’ আমার বরও (সীতেশ ধর) আমার সঙ্গে গলা মিলিয়ে বলেছেন, ‘আমি নাটক করি না।’ এমনিতে আমাদের ছোট শহর মৌলভীবাজারে পূজায় কিংবা কলেজে থিয়েটার গ্রুপে জড়িত ছিলাম। নিউইয়র্কেও করেছি। শখের বশে গান করি। এমনি একদিন গান করছি। নিশাত আপা চুপচাপ লিভিং রুমে বসে আমার গান শুনছেন। পরে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘শোন, নাটকের গানে তোকে কাস্ট করে ফেললাম।’ আমি তো ভয়ে বলতে চাইছিলাম, ‘নিশাত আপা, আমি কি পারব?’ মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বললেন, ‘চুপ। কোনো কথা নয়। যা বলছি, করতে হবে।’ সেদিন থেকেই কাজ শুরু। তখন একটু অসুস্থ ছিলাম। খুব খেয়াল রাখতেন গলায় কোনো চাপ পড়ছে কি না, জোরে কথা বলছি কি না, এমনকি ফোনেও কথা বলতে দিতেন না।
নিশাত আপার খাওয়া-দাওয়া ছিল খুব সাধারণ। শুধু চা খেতেন বেশি। নানা পদের খাবার দিলে বাসায় থাকবেন না বলে হুমকি দিতেন। যদি সত্যিই চলে যান, এই ভয়ে সতর্ক থাকতে হতো। একদিন তাঁর ভাইয়ের বাসা থেকে আমার বাসায় ফেরার পথে তীব্র ঠান্ডায় পথ হারিয়ে ফেললেন। বলেছিলাম, কোনো দোকানে ঢুকে বসতে। বসলেন না। ঠান্ডার মধ্যেই হেঁটে বাসায় পৌঁছে গেলেন। পরে বলেছেন, সেদিন ঠান্ডায় খুব কষ্ট পেয়েছিলেন। ঠান্ডা থেকে কাশি হয়ে গেল। কিন্তু ওষুধ খাবেন না। আমি জোর করে কালিজিরা, মেথি, আদা, গরম পানি খাইয়ে মোটামুটি সুস্থ করি। একদমই শরীরের যত্ন নিতেন না। একদিন তাঁর পায়ে ভেসলিন মাখিয়ে দিতে গেলাম। লাফ দিয়ে সরে গিয়ে বললেন, ‘আমার পায়ে ধরিস না। যদি অসুস্থ হই, হাসপাতালে ফেলে রাখিস।’ ভাবলে এখন কষ্ট হয়। বলতেন, ‘‘বেঁচে থেকে কী হবে রে?’ তখন বলতাম, ‘আমাদের যে অনেক শেখার রয়ে গেছে আপা। একটু নিজের যত্ন নাও।’ চলে গেলেন মমতাময়ী বোন, এক শিক্ষাগুরু; শিল্পী তৈরির কারিগর। নিশাত আপা তুমি বেঁচে থাকবে তোমার কাজে; তুমি বেঁচে থাকবে তোমার হাতে গড়া আমাদের ধ্যানে।