'ক্ষণস্থায়ী মোহের অন্তরালে অবিশ্বাসের দাবানল'
প্রিয় রুমাল থেকে একটা সুতা ঝরে পড়তে দেখলে আমরা বিচলিত হয়ে পড়ি। রুমালের সৌন্দর্য বুঝি ঝরে যেতে শুরু হলো। প্রাচুর্য আর অহংকারের ছোঁয়া হয়তো ক্ষয়ে যেতে লাগল!
প্রিয় মানুষটা যখন ধীরে ধীরে, ক্ষণে ক্ষণে দূরে যেতে থাকে, তখন কেউ ভাবে না কতটা অবিশ্বাসের দংশন ঘাড়ে নিয়ে সে চলে যাচ্ছে দূরে। সবাই তাদের নিজস্ব অবিশ্বাসী দম্ভের ওপর অনড় বসে থেকে উচ্চারণ করতে চায় দোষারোপের বাক্যবাণ; তৈরি করে নেয় অপবাদের স্লোগান, সেজে যায় মহৎপ্রাণ প্রতারক। কেউ ছাড়তে চায় না নিজের ভেতরে সাজিয়ে রাখা প্রতারণার পাহাড় কিংবা সাময়িক বিনোদনের বদভ্যাস।
পৃথিবীতে যখনই যেকোনো সম্পর্কের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হতে শুরু করে, কেউ খুঁজে দেখে না তার অন্তর্নিহিত কারণ। তাৎক্ষণিক খুঁজে বেড়ায় সাময়িক সমাধান। সমাধান সবাই খুঁজে পায় ঠিকই, কিন্তু মনের দূরত্ব নিজেদের অজান্তেই বাড়তে থাকে। সহদোর ভাইবোন, আত্মীয়-স্বজন, স্বামী-স্ত্রী কিংবা প্রেমিক-প্রেমিকা যে কারও মধ্যে যখনই বিরোধ হয়, দূরত্ব বাড়ে—তার পেছনে ঠিক দুটি মৌলিক কারণ থাকে; ১) সম্পদের লোভ ও ২) অবিশ্বাসী আচরণ।
সম্পদের লোভ থেকে যদি কোনো সংঘাত হয়, তাহলে একটা সময় সুষম বণ্টনের বা সমঝোতার মাধ্যমে তা একসময় মিটে যায়। সময়ের পরিক্রমায় মানবিক দূরত্বটাও কমে আসে। কিন্তু অবিশ্বাসী ও রূঢ় আচরণের ক্ষত ক্রমেই বিস্তার পায়। সাময়িক অবিশ্বাস থেকে সৃষ্ট আচরণ থেকে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত করতে না পারলে প্রতিটি সম্পর্কের মধ্যে বহুমুখী দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। প্রতিটি দ্বন্দ্বের ব্যথা অনিয়ন্ত্রিত হতে হতে একসময় দূরত্ব সৃষ্টির চাকায় আনে লাগামহীন গতি। কোনো একদিন হয়তো অব্যক্ত ফোড়ন-ব্যথা চিরস্থায়ী দেয়াল তুলে দেবে অমূল্য সম্পর্কের মাঝখানে।
ছোট একটি পারিবারিক উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করি। মনে করুন একটি পরিবারে একজন খুব দায়িত্বশীল মা (বাবা, স্বামী, স্ত্রী কিংবা অন্য কেউ) তাঁর পরিবারের সৃজনশীলতা, নিয়মানুবর্তিতা, সামাজিকতা ও সময়ানুবর্তিতা নিয়ে সব সময় খুবই সচেতন। তিনি চান তাঁর পরিবারের সবাই খুব সচেতনভাবে পারিবারিক, সামাজিক, ধর্মীয়, স্বাস্থ্যগত ব্যাপারগুলোতে নিজেদের পাশাপাশি অন্য সবার খেয়াল রাখবে। সকাল-সন্ধ্যা অক্লান্ত পরিশ্রমের পরও মা জেগে থাকেন পরিবারের সর্বশেষ সদস্য ঘুমিয়ে পড়ার পর পর্যন্ত। মা সন্ধ্যার পর থেকেই সবাইকে তাগাদা দিতে থাকেন—পড়া শেষ কর, খাওয়া শেষ করো, কাজ শেষ করো, সময়মতো ঘুমাতে যাও ইত্যাদি। সবাই ঘুমিয়ে পড়লে মায়ের নিজেকে ঘুম পাড়ানো ছাড়া আর কোনো কাজ নেই। তবু কেন মা সবাইকে এত তাড়া দেন? কারণ, মায়ের ইচ্ছা সবাই যাতে সময়মতো ঘুম থেকে ওঠে; কেউ যেন দেরিতে নাশতা করে স্বাস্থ্য খারাপ না করে; কেউ যেন বাইরে বেরোনোর তাড়ায় সকালের নাশতা মিস না করে; সবাই যেন প্রতিদিন সকালে বাসার সবার সঙ্গে কুশল বিনিময়ের পর্যাপ্ত সময়টুকু পায়; সামাজিক, ধর্মীয় ও জাগতিক আরাধনায় যেন সবাই সাবলীলভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে।
এতক্ষণ তো বললাম একজন সচেতন মায়ের কথা। এবার বলি অন্যদের কথা। আপনার মা যখন আপনাকে তাগাদা দিচ্ছেন সব শেষ করে তাড়াতাড়ি ঘুমানোর জন্য, আপনি হয়তো তখন স্মার্টফোনে কোনো এক ক্ষণস্থায়ী বিনোদনে মহা ব্যস্ত। হয়তো বা মায়ের কথায় বিরক্ত হয়ে করছেন রূঢ় আচরণ, কিংবা বেছে নিচ্ছেন মা-কে ধোঁকা দেওয়ার অন্যায় কোনো পন্থা। দুটো আচরণই কিন্তু মাকে কষ্ট দেয়। দূরত্বের যাত্রা এখান থেকেই শুরু হয়। আপনি হয়তো ভেবে নিচ্ছেন মায়ের অহেতুক যন্ত্রণা থেকে আপনি রেহাই পেয়ে যাচ্ছেন এমন করে; আসলেই কি তাই?
আপনার রূঢ় কিংবা প্রতারণাপূর্ণ আচরণ মাকে ধারণা দেয় যে আপনি তাঁর কথা শোনেন না। মায়ের মনে অবিশ্বাসের জন্ম দেয় এবং ক্রমান্বয়ে তা একের পর এক স্তর বুনতে থাকে মায়ের সঙ্গে আপনার সম্পর্কের মাঝখানে। মা ভাবতে শুরু করেন, আপনি তার কথায় আর গুরুত্ব দেন না। তাঁর সাবলীল স্বপ্নের চেয়ে ক্ষণস্থায়ী বিনোদন আপনার কাছে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। আস্তে আস্তে মা আপনাকে উৎসাহ, উপদেশ, পরামর্শ কিংবা তাগাদা দেওয়ার আগ্রহ হারাতে থাকেন। দিনে দিনে আগ্রহ হারানোর ব্যাপারটা আতঙ্কে রূপ নেয়। চক্ষুলজ্জার ভয়ে মা তখন আর আপনাকে কিছুই বলেন না; এমনকি আপনি কী করছেন, না করছেন তা খেয়ালও করেন না। আপনি হয়তো মনে মনে ভাবেন, ‘যাক এখন আমি অনেক স্বাধীন’।
প্রশ্ন হচ্ছে, এই স্বাধীনতাটা কি আপনার খুব প্রয়োজন? কিছুদিনে মধ্যেই আপনি আবিষ্কার করবেন: আপনার মধ্যে নানাবিধ সমস্যার আনাগোনা; আপনার স্বাস্থ্য ঠিক নেই, স্কুল-কলেজ-কর্মক্ষেত্র কিংবা সামাজিক মিলনায়তনে আপনি সর্বদা অজুহাতের ফিরিস্তি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, আপনি সামাজিকতা সঠিকভাবে শেখেননি অথবা ভুলে গেছেন, আপনার আত্মীয়তার কোনো বন্ধনই আর সুষম নেই, উপাসনালয়ে আরাধনার অনেক কিছুই আপনি ভুলে গেছেন, জীবনের যে লক্ষ্য নিয়ে আপনার যাত্রা শুরু হয়েছিল, সেখান থেকে অনেক আগেই আপনি ছিটকে পড়েছেন। হয়তো বা প্রিয়জনের কাছে আপনি খুবই অবহেলিত; হয়তো আপনার প্রতিটা অজুহাত সমাজে সবার কাছে অবিশ্বাস্য; ওই সব সাময়িক বিনোদন এখন আর আপনাকে শিহরিত করে না। হতাশার ধোঁয়া, আর ঘোর অন্ধকার ভবিষ্যৎ ছাড়া আপনার কাছে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। মায়ের সেই নির্মোহ প্রচেষ্টার প্রতিটা ধাপ আপনি খুব হালকাভাবে নিয়ে ঝেড়ে ফেলেছেন সফলতার সব পরশপাথর।
হয়তো কোনো একদিন মনে হবে, মায়ের সেই আপাত যন্ত্রণাময় চাদরের নিচে ফিরে যাওয়ার কথা। যখন ফিরে তাকাবেন, ঠিক তখনই আপনার সামনে এসে হাজির হবে আপনারই রূঢ় আচরণ, যা জমে জমে এক বিশাল পাহাড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আপনারই সামনে। একদিকে আপনার কানের পর্দা মোটা হয়েছে, অন্যদিকে আপনার মায়ের গলার স্বর নিতান্তই নেমে গেছে। আপনার দিশেহারা আর্তনাদ হয়তো মায়ের বুকটাকে আবারও কাঁপিয়ে তুলবে। কিন্তু মায়ের নিচু স্বরের আওয়াজ আপনার কানের মোটা পর্দা ভেদ করে আপনাকে আর উৎসাহ দিতে পারবে না। এই কথাগুলো কারও জীবনে প্রভাব ফেলুক, তা আমাদের কারওই কাম্য নয়। আমি শুধু সবাইকে সাবধান হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছি।
আপনি নিজেকে যতটাই সৎ বলে দাবি করুন না কেন, দৃষ্টির আড়ালে আপনার প্রতিটা অবিশ্বাসী আচরণ আপনার প্রতারক চেহারার নিখুঁত ছবি এঁকে যাবে। সততার মানে মুখে মুখে প্রশংসা কিংবা কৃতজ্ঞতার ঝরনাধারা নয়। সততার মানে হচ্ছে, প্রতিটি দৃষ্টির আড়ালে নিজেকে প্রতারণা, আর ছলনার অভ্যাস থেকে নিভৃত রাখা। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও নিষ্ঠার মাধ্যমে প্রতিটি সম্পর্ককে জিইয়ে রাখা।
ভালো থাকবেন সবাই।