সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কোথায় আমরা 

প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফটের সহপ্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ধনীদের একজন তিনি। দাতব্য সংস্থা বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের সহপ্রতিষ্ঠাতাও তিনি। ১৮ অক্টোবর নিজের ওয়েবসাইট গেটস নোটসে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সৃষ্ট বিপর্যয় এড়াতে পরিবেশবান্ধব জ্বালানির দিকে যাত্রার অগ্রগতি, ঘাটতি ও করণীয় নিয়ে লিখেছেন তিনি।

সৌরশক্তি পেতে যুক্তরাজ্যের রয়স্টোনের কাছে একটি মাঠে বসানো হয়েছে সোলার প্যানেল
রয়টার্স

জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে আমার জানাশোনার শুরুটা বছর ১৫ আগে। তখন আমি মোটাদাগে তিনটি সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলাম। প্রথমত, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সৃষ্ট বিপর্যয় এড়ানো মানুষের এযাবৎকালের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে। দ্বিতীয়ত, বিপর্যয় এড়ানোর একটাই পন্থা—পরিবেশবান্ধব জ্বালানির উদ্ভাবন ও এর ব্যবহার বাড়ানো। তৃতীয়ত, আমাদের থামলে চলবে না, এগিয়ে যেতে হবে।

তখন থেকে বেসরকারি ও সরকারি পর্যায়ে এ ক্ষেত্রে বিপুল বিনিয়োগ হচ্ছে, যা পরিবেশবান্ধব জ্বালানির উদ্ভাবনে গতি এনেছে; বস্তুত আমি এতটা আশাই করিনি। এই অগ্রগতি ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমাকে আশাবাদী করে তুলেছে।

তবে একই সঙ্গে বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে আমি সমানভাবে বাস্তববাদী। বৈশ্বিকভাবে এখন বছরে ৫ হাজার ১০০ কোটি টন গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হচ্ছে। এটাকে আমাদের শূন্যে নামিয়ে আনতে হবে। কিন্তু প্রতিবছর কার্বন নিঃসরণ বেড়েই চলেছে। আপনারা যদি জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত আন্তসরকার প্যানেলের (আইপিসিসি) বার্ষিক প্রতিবেদনগুলোর ওপর নজর রাখেন, নিশ্চয়ই এ চিত্র দেখে থাকবেন যে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমিত রাখা, এমনকি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে আটকে রাখার বিষয়টি দিন দিন নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। এ জন্য আমাদের যেসব পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি দরকার, তার বেশ কিছুর ব্যবহার শুরু হতে এখনো অনেক দেরি। এগুলো সাশ্রয়ী হলে বৃহৎ আঙ্গিকে আমরা ব্যবহার করতে পারব।

গত এক দশকে আমরা পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ব্যবহারের পথে হাঁটতে শুরু করেছি। আগামী তিন দশকে আমাদের আরও দ্রুতগতিতে অনেক দূরে যেতে হবে। জলবায়ু বিপর্যয় এড়ানোর ব্যাপারে আমি এখনো আশাবাদী। মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এই সংকট মোকাবিলায় আগামী প্রজন্মকে যদি একান্তভাবে নিয়োজিত করা যায়, তবে বিপর্যয় এড়ানো কঠিন হবে না বলেই আমি মনে করি। 

জ্বালানির রূপান্তর কেন এত কঠিন

কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনার বিষয়টি বুঝতে হলে কীভাবে বছরে ৫ হাজার ১০০ কোটি টন কার্বন বায়ুমণ্ডলে ছড়াচ্ছে, সে প্রশ্ন আমাদের করতে হবে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, সব জায়গা ও সবকিছু থেকেই এই কার্বন নিঃসরণ ঘটছে।  

সবকিছু: বস্তুত মানুষের প্রতিটি কর্মকাণ্ড থেকেই গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ ঘটে। স্বাভাবিকভাবেই বিদ্যুতের কথা চলে আসে। এ ক্ষেত্রে কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনা সম্ভব। কারণ, বায়ু ও সৌরবিদ্যুৎ এখন জীবাশ্ম জ্বালানির চেয়ে সাশ্রয়ী। বিশ্বে মোট কার্বন নিঃসরণের ২৬ শতাংশই আসে বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে। একইভাবে লিথিয়াম–আয়ন ব্যাটারি ভবিষ্যতে গাড়িতে ভ্রমণ কার্বনমুক্ত হওয়ার বিষয়টি সম্ভব করছে। বৈশ্বিক মোট কার্বন নিঃসরণের ১৬ শতাংশের জন্য দায়ী পুরো পরিবহন খাত। আর এর অর্ধেকের মতো কার্বন নিঃসরণ ঘটে গাড়ি থেকে। তবে দূরপাল্লার বিমানযাত্রা, পণ্যবাহী জাহাজ ও বড় ট্রাকের ক্ষেত্রে লিথিয়াম–আয়ন ব্যাটারির খুব বেশি কিছু করার নেই।

বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণের ২১ শতাংশ আসে কৃষি খাত থেকে, আর আবাসন নির্মাণ খাত থেকে হয় ৭ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি—৩০ শতাংশ কার্বন নিঃসরণের জন্য দায়ী হলো উৎপাদন খাত, যেসব জিনিসের ওপর আমাদের আধুনিক জীবনব্যবস্থা টিকে আছে।

যেমন সিমেন্ট, প্লাস্টিক ও স্টিলের পণ্য উৎপাদন। বিশ্বে এমন একটিও সিমেন্ট কারখানা নেই, যেখান থেকে কার্বন ডাই–অক্সাইডের নিঃসরণ ঘটে না। অবশ্য মাত্র একটি স্টিল কারখানা আছে, যা কার্বন ডাই–অক্সাইড নিঃসরণ করে না।

 সুতরাং আপনি যদি আজ সকালে বাসে করে আপনার কংক্রিট ও স্টিল নির্মিত কার্যালয়ে গিয়ে থাকেন এবং প্লাস্টিকের কোনো পাত্রে রেখে দুপুরের খাবার খেতে খেতে এই লেখাটি পড়তে থাকেন, তাহলে আপনি দেখতে শুরু করবেন, কতভাবেই না আমরা এই সমস্যায় (জলবায়ু সংকট) ভূমিকা রাখছি—হোক তা অল্প বা বেশি পরিমাণে।

বিল গেটস
ফাইল ছবি

 সব জায়গায়: বিশ্বের ৭০টির বেশি দেশ গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ ও শোষণ সমান করার বা ‘নেট জিরো’তে পৌঁছানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণকারী দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নও রয়েছে। যদি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ তাদের লক্ষ্যে পৌঁছেও যায়, এরপরও আমরা সমস্যার সমাধান করতে পারব না। 

বিশ্বের মোট জনসংখ্যার চার ভাগের তিন ভাগের বসবাস ব্রাজিল, চীন, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো বিকাশমান অর্থনীতির দেশগুলোতে। যদিও ঐতিহাসিকভাবে জলবায়ু পরিবর্তনে এসব দেশের ভূমিকা সামান্যই। তবে এখন বৈশ্বিক গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের দুই–তৃতীয়াংশের জন্য দায়ী এসব দেশ। শুধু চীনই এক–চতুর্থাংশের বেশি গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ করে। সুতরাং সমাধান কোনো একক দেশ বা অঞ্চলের ওপর নির্ভর করছে না। সব দেশকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে, নতুবা তাপমাত্রার পারদ চড়তেই থাকবে।

সুতরাং সবখানে সবকিছুর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা হতে পারে তিন ধাপে। প্রথমত, বেশি মাত্রায় কার্বন নিঃসরণকারী যেসব প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আমরা এখন যাচ্ছি, সেসব জায়গায় আমাদের নতুন পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। যেমন স্টিল নির্মাণ, বিমান ওড়ানো বা জমির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধির জন্য নতুন পন্থায় যেতে হবে।

দ্বিতীয়ত, নতুন পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তিকে অবশ্যই সাশ্রয়ী করতে হবে। কেবল গুটিকয় ধনী দেশের জন্য নয়, দরিদ্র দেশগুলোও যাতে ওই প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারে, সে রকম দামে নিয়ে আসতে হবে। 

সমাধানের তৃতীয় পর্যায় হলো এসব সায়শ্রী প্রযুক্তির ব্যবহার ত্বরান্বিত করা। উদাহরণস্বরূপ, বিশ্বে বর্তমানে ২ হাজার ৪১২টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে। এ সংখ্যা এখনো বাড়ছে। তবে শেষ পর্যন্ত এর প্রতিটিকে পরিবেশবান্ধব জ্বালানিনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রে রূপান্তরিত করতে হবে।

যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে বিশ্ব

২০১৫ সালে ফ্রান্সের প্যারিসে কপ–২১ সম্মেলনের পর অনেক কিছু বদলেছে। ওই সম্মেলনে ২২টি দেশের সরকার ‘মিশন ইনোভেশন’ নামে একটি উদ্যোগের সূচনা করে। এরপর থেকে সরকারিভাবে জলবায়ুবিষয়ক গবেষণা ও উন্নয়নে বরাদ্দ প্রায় এক–তৃতীয়াংশ বেড়েছে।

ওই সম্মেলনে আমি বিনিয়োগকারীদের একটি দলের সদস্য হিসেবে অংশ নিয়েছিলাম। তখন বিনিয়োগকারীদের ওই দল ‘ব্রেকথ্রু এনার্জি ভেঞ্চার’ নামে একটি তহবিল চালু করে। এর আওতায় এখন শতাধিক কোম্পানি রয়েছে, যারা পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। এরই মধ্যে অন্যান্য উদ্যোগ থেকেও এ খাতে আরও বিনিয়োগ হচ্ছে। ফলে বেসরকারি খাতে জলবায়ুবিষয়ক গবেষণা ও উন্নয়ন ত্বরান্বিত হচ্ছে। 

কার্যকর নীতি গ্রহণের মাধ্যমে সরকারি খাতও এগিয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আরও উচ্চাভিলাষী অভীষ্ট নির্ধারণ করা হয়েছে।

গত ১২ মাসে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে জলবায়ু–সম্পর্কিত তিনটি আইন পাস হয়েছে এবং আইন তিনটিতে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সইও করেছেন। এগুলোর আওতায় যুক্তরাষ্ট্রে পরিবেশবান্ধব জ্বালানির জন্য ৫ হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে ২০৫০ সালের মধ্যে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ এবং সমপরিমাণ বায়ুমণ্ডল থেকে সরিয়ে নেওয়ার (নেট জিরো) বিষয়টিকে ২০২১ সালে আইনে অন্তর্ভুক্ত করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ওই বছরই তারা ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্য ৫৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৪০ শতাংশ করেছে (১৯৯০ সালের তুলনায়)। এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রণয়নের বিষয়টি আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এগোচ্ছে। 

বিশ্বের যা করতে হবে

এখন আমাদের সামনে যেসব বিষয় উপস্থিত—এর আগে মানবেতিহাসে তেমনটা আর ঘটেনি। বিনিয়োগ, নীতি গ্রহণ, উদ্ভাবন এবং সার্বিকভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টিকে অগ্রাধিকারের বিষয় হিসেবে তুলে ধরতে জনসচেতনতা তৈরি করা। সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, এখন সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনকে অন্য যেকোনো বিষয়ের চেয়ে বড় হুমকি হিসেবে দেখছে। পাশাপাশি আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশিসংখ্যক মানুষ এখন ব্যক্তি উদ্যোগে কার্বন নিঃসরণ কমাতে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছেন। বহু মানুষের এই উদ্যোগ সম্মিলিতভাবে ব্যবসায়ী ও সরকারের নীতিনির্ধারকদের কাছে জোরালোভাবে এই বার্তাই দিচ্ছে যে সামনে আরও বেশি কিছু করতে হবে। 

এর অর্থ এখানে তিনটি বিষয়—আরও গবেষণা, উন্নয়ন ও জনসমক্ষে প্রদর্শন; একটি সুষ্ঠু ও কার্যকর প্রক্রিয়ার উন্নয়ন ঘটানো এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সৃষ্ট পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে মানুষকে সহায়তা করা। কেননা আমরা এখন যা–ই করি না কেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা করেই আমাদের চলতে হবে।

‘নেট জিরো’র দিকে যাত্রা

চূড়ান্ত বিচারে বৈশ্বিক গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের ক্ষেত্রে সাফল্যের মাপকাঠি হলো আগামী তিন দশকে আমাদের বার্ষিক নিঃসরণ ৫ হাজার ১০০ টন থেকে শূন্যে নামাতে হবে। তবে এটা কার্যকর করার প্রশ্নে অনেক ঘাটতি রয়েছে। পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির উন্নয়ন, জনসমক্ষে সেটির প্রদর্শন ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিনিয়োগের বিষয়টি আসে প্রথমে। গ্রিনহাউস নিঃসরণ কমানোর বিষয়টি দুই নম্বরে। গ্রিন প্রিমিয়াম (পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির জন্য যে বাড়তি ব্যয়) দেওয়ার পর যে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি যত বেশি সাশ্রয়ী হবে, সেটির ব্যবহার তত বাড়বে।

সংকটের সময় মানুষ কতটা কী করতে সক্ষম, সে ব্যাপারে আমি আশাবাদী। ফলে আমি আমাদের বিরুদ্ধে বাজি ধরতে রাজি নই। তবে দুর্ভাগ্যের কথা, সময় নষ্ট করার মতো সময় আমাদের হাতে নেই। আমরা এরই মধ্যে জ্বালানির ক্ষেত্রে অনেক যুগান্তকারী সাফল্য পেয়েছি। জলবায়ুর বিপর্যয় এড়াতে আমাদের আরও দ্রুত আরও সাফল্য পেতে হবে। 


ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ হাসান ইমাম