বিকাশ যাদব: যুক্তরাষ্ট্রে পান্নুন হত্যাচেষ্টায় অভিযুক্ত কে এই ভারতীয়
বিকাশ যাদব। তিনি ভারতের সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় বংশোদ্ভূত শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা গুরপতবন্ত সিং পান্নুনকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ওই পরিকল্পনা সফল হয়নি। গত বৃহস্পতিবার বিকাশ যাদবকে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযুক্ত করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। এই সম্পর্কের পেছনে বড় একটি কারণ—দুই দেশেরই প্রতিপক্ষ চীন। এরই মধ্যে বিকাশ যাবদকে অভিযুক্ত করা নিয়ে ওয়াশিংটন-নয়াদিল্লি উষ্ণ সম্পর্কে কিছুটা হলেও শীতল হয়েছে। বৃহস্পতিবার মার্কিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বলেছেন, মার্কিন কোনো নাগরিকের বিরুদ্ধে বিদেশি নাগরিকদের তৎপরতা সহ্য করবে না ওয়াশিংটন।
বিকাশ যাদব কে
বিকাশ যাদব ভারতের নাগরিক। ভারতেই বসবাস করেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ, ২০২৩ সালের মে মাসের দিকে পান্নুনকে হত্যা করতে নিখিল গুপ্ত নামের এক ভারতীয়কে নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। বৃহস্পতিবার অভিযুক্তকরণ নথিতে যুক্তরাষ্ট্র উল্লেখ করেছে, বিকাশ যাদবের বয়স ৩৯ বছর। ‘আমানত’ নামেও নিজের পরিচয় দেন তিনি।
অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, বিকাশ যাদবকে নিয়োগ দিয়েছিল ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা। বিদেশে গোয়েন্দা তৎপরতা চালায় এই সংস্থা। তাঁকে একজন ‘সিনিয়র ফিল্ড অফিসার’ হিসেবে উল্লেখ করেছে ওই সংস্থা। ভারতের হয়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা ও গোয়েন্দাগিরির কাজ করতেন তিনি।
অভিযুক্তকরণ নথিতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ভারতের সবচেয়ে বড় আধা সামরিক বাহিনী ‘সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্সের’ হয়ে কাজ করতেন বিকাশ যাদব। পান্নুনকে হত্যার জন্য নিউইয়র্কে তাঁর ঠিকানা, ফোন নম্বর ও প্রতিদিনের কর্মকাণ্ডের বিস্তারিত তথ্য নিখিল গুপ্তকে দিয়েছিলেন বিকাশ।
যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বিকাশ যাদব এখনো মুক্ত রয়েছেন। তাঁকে আটক করা যায়নি। ধারণা করা হয়, তিনি এখন ভারতেই রয়েছেন। সেখান থেকে তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যাবর্তনের জন্য মার্কিন সরকার কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে কি না, তা-ও জানা যায়নি।
ভারত সরকারের প্রতিক্রিয়া কী
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সোয়াল বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগের অভিযুক্তকরণ নথিতে যে ব্যক্তির নাম এসেছে তিনি এখন আর ভারত সরকারের কর্মচারী নন। এই বক্তব্য থেকে এটাই নিশ্চিত হয় যে—একসময় ভারতের সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন বিকাশ যাদব।
এর আগে ভারত বলেছিল, পান্নুন হত্যাচেষ্টার সঙ্গে ভারতীয় গোয়েন্দাদের জড়িত থাকার যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তা নিয়ে নিজস্বভাবে অভ্যন্তরীণ তদন্ত চালাচ্ছে নয়াদিল্লি। দেশটির সরকার এ-ও বলেছিল, তারা দেশের বাইরে কোনো হত্যাকাণ্ড চালায় না। পান্নুন হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনার সঙ্গে যদি কোনো ভারতীয় নাগরিক জড়িতও থাকেন, তিনি সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নির্দেশপ্রাপ্ত নন।
পান্নুনের সঙ্গে কী হয়েছিল
২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পান্নুন হত্যার পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। সে বছরের ২৯ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটি আনুষ্ঠানিক অভিযোগে বলা হয়েছিল, ভারতের সরকারি একটি সংস্থার কর্মকর্তার সহযোগী ৫৩ বছর বয়সী নিখিল গুপ্ত। তখন ওই কর্মকর্তার নাম ‘সিসি-১’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল।
বৃহস্পতিবারের আনুষ্ঠানিক অভিযোগে ‘সিসি-১’-কে বিকাশ যাদব হিসেবে পরিচয় দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ করা হয়েছে, ভারত থেকেই পান্নুনকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন বিকাশ। এ কাজের জন্য ২০২৩ সালের মে মাসে নিখিল গুপ্তকে নিয়োগ দিয়েছিলেন তিনি।
নিখিল গুপ্তকে বলা হয়েছিল পান্নুনকে হত্যার জন্য একজন ঘাতক ভাড়া করতে। তিনি এমন একজনকে ভাড়া করেছিলেন, যিনি তাঁর পরিচিত ছিলেন না। ভাড়াটে ওই ব্যক্তি আসলে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা ড্রাগ এনফোর্সমেন্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (ডিইএ) একজন ছদ্মবেশী কর্মকর্তা।
পান্নুনকে হত্যার জন্য ডিইএর ওই কর্মকর্তাকে এক লাখ ডলার দিতে রাজি হয়েছিলেন নিখিল গুপ্ত। ২০২৩ সালে জুন মাসের ৯ তারিখের দিকে নিউইয়র্কের ম্যানহাটানে তাঁকে আগাম ১৫ হাজার ডলার দিয়েছিলেন। হত্যার এই চুক্তিতে রাজি ছিলেন বিকাশ যাদবও। বৃহস্পতিবার করা যুক্তরাষ্ট্রের নতুন অভিযোগে এসব তথ্য দেওয়া হয়েছে।
২০২৩ সালের ১৮ জুন কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়া প্রদেশে একটি শিখমন্দিরের বাইরে শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হরদীপ সিং নিজ্জরকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
বৃহস্পতিবারের অভিযোগে পান্নুনকে নিজ্জরের একজন সহযোগী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের পর নিজ্জরের ‘রক্তাক্ত মরদেহের’ ভিডিও নিখিল গুপ্তকে পাঠিয়েছিলেন বিকাশ যাদব।
যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগে বলা হয়েছে, ডিইএর ছদ্মবেশী কর্মকর্তাকে নিখিল গুপ্ত বলেছিলেন, নিজ্জরও তাঁদের ‘(হত্যার) একটি লক্ষ্যবস্তু ছিলেন’ এবং ‘আমাদের এমন অনেক লক্ষ্যবস্তু রয়েছে।’ আর নিখিল গুপ্তকে বিকাশ যাদব বলেছিলেন, ২০২৩ সালের ২০ জুন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির যুক্তরাষ্ট্র সফরের দিন বা এর পরের দিনগুলোতে পান্নুনকে হত্যা না করতে।
২০২৩ সালের ৩০ জুন নিখিল গুপ্তকে গ্রেপ্তার করে চেক প্রজাতন্ত্রের কর্তৃপক্ষ। চলতি বছরের জুন মাসে তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যাবর্তন করা হয়। পরে নিউইয়র্কের একটি আদালতে তিনি দাবি করেন, পান্নুন হত্যার পরিকল্পনার সঙ্গে তিনি জড়িত নন।
বিকাশ যাদবকে অভিযুক্ত করা এখন গুরুত্বপূর্ণ কেন
নিজ্জর ও পান্নুন—দুজনই খালিস্তানপন্থী। ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যে শিখধর্মাবলম্বীদের জন্য ‘খালিস্তান’ নামের একটি রাষ্ট্রগঠনের আন্দোলনের পক্ষে তাঁরা। এই আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত অনেককে ‘সন্ত্রাসী’ তকমা দিয়েছে ভারত সরকার। নিজ্জর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ভারত জড়িত বলে অভিযোগ করে আসছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। এ নিয়ে দুই দেশের সম্পর্ক বর্তমানে তলানিতে রয়েছে। এমনই এক সময় বিকাশ যাদবের বিরুদ্ধে নতুন করে অভিযোগ আনল যুক্তরাষ্ট্র।
গত সোমবার জাস্টিন ট্রুডো বলেন, নিজ্জর হত্যাকাণ্ডের পেছনে ভারতীয় গোয়েন্দাদের জড়িত থাকার ‘স্পষ্ট প্রমাণ’ সামনে এনেছে রয়্যাল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশ (আরসিএমপি)। ট্রুডো ও আরসিএমপির ভাষ্যমতে, কানাডায় বসবাসকারী শিখদের মধ্যে যাঁদের ভিন্নমত রয়েছে, তাঁদের হত্যা করতে ভারতের কুখ্যাত লরেন্স বিষ্ণোই গ্যাংয়ের সদস্যদের ভাড়া করেছে ভারত সরকার। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে নয়াদিল্লি।
এমনই এক পরিস্থিতির মধ্যে অটোয়ায় ভারতের হাইকমিশনার সঞ্জয় কুমার ভার্মাসহ ছয় কূটনীতিককে গত সোমবার বহিষ্কার করেছে কানাডা সরকার। পাল্টা জবাবে ভারত থেকে কানাডার ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনারসহ ছয়জন কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছে নয়াদিল্লি।