আল–জাজিরার এক্সপ্লেইনার
যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল সম্পর্ক: ফ্লোরিডায় এবার ট্রাম্প-নেতানিয়াহুর মধ্যে কী কথা হবে
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্র সফর করছেন। সেখানে তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। ফিলিস্তিন, লেবানন ও সিরিয়ায় ইসরায়েলের হামলা এবং ইরানকে ঘিরে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি যখন চরম উত্তাপের দিকে যাচ্ছে, ঠিক সেই সময়ই এই বৈঠক হতে যাচ্ছে।
আজ সোমবার ফ্লোরিডার মার-এ-লাগো রিসোর্টে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক করবেন নেতানিয়াহু। গাজায় যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপ সম্পন্ন করতে ওয়াশিংটন যখন চাপ জোরালো করছে, তখনই এই আলোচনা হতে যাচ্ছে।
প্রায় প্রতিদিনই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গাজায় যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠলেও যুক্তরাষ্ট্র ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে তাদের ২০-দফার তথাকথিত ‘শান্তি পরিকল্পনা’ বাস্তবায়নের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
অধিকৃত পশ্চিম তীর, লেবানন এবং সিরিয়ায় হামলা আরও জোরদার করছে ইসরায়েল। একই সঙ্গে ইসরায়েলি কর্মকর্তারা ইরানের সঙ্গে আরেকটি যুদ্ধ হতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন।
নেতানিয়াহুর যুক্তরাষ্ট্র সফর কেমন হতে পারে, তা নিয়ে বিশ্লেষণ করেছে আল-জাজিরা।
নেতানিয়াহু বৈঠকে ট্রাম্পের সঙ্গে কী বিষয়ে আলোচনা করবেন? যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল সম্পর্কের অবস্থাই কী—এমন নানা প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে আল–জাজিরা।
কবে বৈঠক হবে
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী রোববার যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছাছেন। তবে এই বৈঠক হোয়াইট হাউসে হবে না। পরিবর্তে, নেতানিয়াহু ফ্লোরিডায় ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন, যেখানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ছুটি কাটাচ্ছেন।
দুই নেতার বৈঠক আজ সোমবার অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা।
ট্রাম্পের সঙ্গে এটি নেতানিয়াহুর কততম সাক্ষাৎ
এই সফর নেতানিয়াহুর গত ১০ মাসে যুক্তরাষ্ট্রে পঞ্চম সফর। অন্য যেকোনো বিশ্বনেতার চেয়ে নেতানিয়াহুকে সবচেয়ে বেশি বার যুক্তরাষ্ট্রে স্বাগত জানিয়েছেন ট্রাম্প।
ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর গত ফেব্রুয়ারি মাসে নেতানিয়াহু প্রথম বিদেশি নেতা হিসেবে হোয়াইট হাউস সফর করেছিলেন। এরপর তিনি এপ্রিল এবং জুলাই মাসেও যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন। সবশেষ গত সেপ্টেম্বর মাসে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের পর ট্রাম্পের সঙ্গে ওয়াশিংটন ডিসিতে সাক্ষাৎ করেন।
ট্রাম্পের সঙ্গে নেতানিয়াহুর বৈঠকটি হোয়াইট হাউসে হবে না। ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক করতে নেতানিয়াহু ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যে যাবেন। সেখানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট অবকাশ যাপন করছেন।
আজ সোমবার দুই নেতার মধ্যে বৈঠক হওয়ার কথা আছে।
প্রথম মেয়াদে ট্রাম্প আরও বেশি করে ইসরায়েলের রক্ষণশীল সরকারের পক্ষে মার্কিন নীতিকে এগিয়ে নেন। তিনি জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তর করেন, সিরিয়ার অধিকৃত গোলান মালভূমিতে ইসরায়েলের সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি দেন এবং জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থীবিষয়ক সংস্থাকে (ইউএনআরডব্লিউএ) অর্থায়ন বন্ধ করে দেন।
চলতি বছর হোয়াইট হাউসে ফেরার পর ট্রাম্প নেতানিয়াহুর সঙ্গে প্রকাশ্যে দ্বিমত প্রকাশ করার প্রবণতা দেখিয়েছেন। তবু তাঁর প্রশাসন ইসরায়েলের প্রতি দৃঢ় সমর্থন জানিয়েছে। যেমন মার্চে গাজা উপত্যকায় সংক্ষিপ্ত যুদ্ধবিরতির পর ইসরায়েল আবারও হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নিলে যুক্তরাষ্ট্র তাতে সমর্থন জানিয়েছিল।
গত জুনে ট্রাম্প ইরানের ওপর ইসরায়েলের হামলায় যুক্ত হন, যা তার কিছু সমর্থককে হতাশ করেছিল।
ওয়াশিংটন যখন মধ্যপ্রাচ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা জোরদার করতে চাইছে, তখন ইসরায়েল অঞ্চলজুড়ে ‘পূর্ণ আধিপত্য’ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের উপসাগরীয় মিত্ররাও রয়েছে।(সিনা টুসি, সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল পলিসির জ্যেষ্ঠ ফেলো)
আবার একই সঙ্গে ট্রাম্প গাজায় বর্তমান যুদ্ধবিরতির সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ইসরায়েলকে চাপ দিচ্ছেন। গত সেপ্টেম্বরে দোহায় ইসরায়েলি হামলার বিরোধিতা করেন ট্রাম্প। ইসরায়েলের সংশয়ের পরও তিনি দ্রুত সিরিয়ার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন।
ট্রাম্প ও নেতানিয়াহুর সম্পর্ক উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে গিয়েছে। ২০২০ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জো বাইডেনের জয়ের পর পরই নেতানিয়াহু তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। আর তাতে ট্রাম্প বিরক্ত হন। কারণ, তিনি তখন মিথ্যা দাবি তুলেছিলেন, নির্বাচনে জালিয়াতি হয়েছে।
২০২১ সালে সংবাদমাধ্যম এক্সিওসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘আমি তখন থেকে তাঁর (নেতানিয়াহু) সঙ্গে কথা বলিনি।’
২০২৪ সালে ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হওয়ার পর দুই নেতার মধ্যে আবারও দৃঢ় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ফিলিস্তিনি অধিকার কর্মীদের ওপর কঠোর পদক্ষেপ নিতে শুরু করেন।
নিজ দেশে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠা নেতানিয়াহুকে ক্ষমা করে দিতে গত নভেম্বরে ট্রাম্প আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হারজগকে অনুরোধ জানান।
তবে ট্রাম্প ও নেতানিয়াহুর মধ্যে যে পুরোপুরিভাবে মতের মিল রয়েছে, তা নয়। গাজা ও সিরিয়া পরিস্থিতি এবং তুরস্ক ও উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অংশীদারত্বের মতো বিষয়গুলোতে তাদের অবস্থানে ফাটল রয়েছে।
এবার যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় নেতানিয়াহু সম্ভবত ট্রাম্পের প্রশংসা করবেন এবং তাঁর সঙ্গে উষ্ণ সম্পর্ক রয়েছে বলে দেখাতে চাইবেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর এজেন্ডাকে এগিয়ে নেবেন এবং ইসরায়েলে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের দেখাতে চাইবেন যে, তাঁর ওপর এখনো ওয়াশিংটনের সমর্থন রয়েছে।
২০২৩ সালের পর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নেতানিয়াহুর সম্পর্ক
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাস ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে হামলা চালায়। এর জবাবে সেদিন থেকেই গাজায় হামলা শুরু করে ইসরায়েল।
গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচার হামলা শুরুর পর নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্র থেকে অবাধ কূটনৈতিক ও সামরিক সহায়তা চান।
ওই সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ছিলেন জো বাইডেন। গাজায় হামলা শুরু হওয়ার ১১ দিন পর তিনি ইসরায়েলে সফর করেন এবং ঘোষণা দেন যে ইসরায়েলকে সহযোগিতা করাটা যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য জরুরি।
বাইডেন তেল আবিব বিমানবন্দরে নেতানিয়াহুকে যেভাবে আন্তরিকতার সঙ্গে জড়িয়ে ধরেছিলেন, তাতে বোঝা যাচ্ছিল ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন থাকবে। অথচ ওই সময় গাজায় ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছিল ইসরায়েল। গত দুই বছরে ইসরায়েলকে ২ হাজার ১০০ কোটি ডলারের বেশি সামরিক সহায়তা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ইসরায়েলিবিরোধী প্রস্তাবে একাধিক ভেটো দিয়েছে তারা।
নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্রকে দেখাতে চাইছেন, ইসরায়েল নিজের পাশাপাশি মার্কিন স্বার্থ হাসিলেও কাজ করছে। গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে দেওয়া ভাষণে তিনি দাবি করেন, ইসরায়েল গাজা ও লেবাননের মাধ্যমে ইরানের সঙ্গে পরোক্ষভাবে লড়ছে।
নেতানিয়াহু মার্কিন আইনপ্রণেতাদের বলেন, ‘আমরা শুধু নিজেদের রক্ষা করছি না, আমরা আপনাদেরও সুরক্ষা দিচ্ছি।’
যুদ্ধ চলাকালে অসংখ্য প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাইডেন ও ট্রাম্প নেতানিয়াহুর প্রতি অসন্তুষ্ট ছিলেন বা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তবে ইসরায়েলের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ও রাজনৈতিক সহায়তা অব্যাহত থেকেছে। নেতানিয়াহু সব সময় মার্কিন প্রেসিডেন্টদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। এমনকি উত্তেজনা চললেও এর নড়চড় হয় না।
ট্রাম্প ও নেতানিয়াহুর সম্পর্ক উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে গিয়েছে। ২০২০ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জো বাইডেনের জয়ের পর পরই নেতানিয়াহু তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। আর তাতে ট্রাম্প বিরক্ত হন। কারণ, তিনি তখন মিথ্যা দাবি তুলেছিলেন যে নির্বাচনে জালিয়াতি হয়েছে।
গাজায় যুদ্ধবিরতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান
গত সপ্তাহে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বলেছেন, ট্রাম্প প্রশাসনের শীর্ষ অগ্রাধিকারের জায়গা হলো গাজায় যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপ সম্পূর্ণ করা এবং শুধু লড়াই বন্ধ করার পর্যায় থেকে দীর্ঘমেয়াদি শাসন, স্থিতিশীলতা ও পুনর্গঠন পর্যায়ে যাওয়া।
ইসরায়েল নিয়মিতভাবে গাজায় যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করছে। সম্প্রতি একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে হামলার ঘটনায় কমপক্ষে ছয়জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে।
তিন হাজার বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার দাবি করা ট্রাম্প ইসরায়েলের প্রতিদিনের কর্মকাণ্ডের চেয়ে ব্যাপকভাবে যুদ্ধবিরতি এগিয়ে নেওয়ার দিকে বেশি মনোযোগ দিয়েছেন।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রুবিও ইঙ্গিত দিয়েছেন, চুক্তির আওতায় হামাসকে অস্ত্রশূন্য করার ক্ষেত্রে কিছুটা নমনীয়তা থাকতে পারে। তিনি বলেন, প্রতিটি যোদ্ধার কাছ থেকে অস্ত্র সরানোর চেয়ে এই গোষ্ঠী যেন ইসরায়েলের জন্য হুমকি তৈরি না করতে পারে—তার ওপরই মূলত জোর দেওয়া হবে।
তবে ইসরায়েলের অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রটি ভিন্ন বলে মনে হচ্ছে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ গত মঙ্গলবার বলেছেন, দেশটি গাজায় নতুন করে অবৈধ বসতি স্থাপনের চেষ্টা করছে। পরে তিনি এই মন্তব্য প্রত্যাহার করেন। তবে তিনি জোর দিয়ে বলেন, ইসরায়েল ওই এলাকায় স্থায়ী সামরিক উপস্থিতি বজায় রাখবে, যা ট্রাম্পের পরিকল্পনার বিরোধী।
এমন পরিস্থিতিতে আশা করা হচ্ছে, গাজা নেতানিয়াহু এবং ট্রাম্পের আলোচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হবে।
সিরিয়ার সঙ্গে কোনো চুক্তি হতে পারে কি
গত বছর ট্রাম্প আক্ষরিকভাবে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারাকে গ্রহণ করেছেন। তিনি দেশটির ওপর থেকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা তুলে দেন এবং তাঁর সরকারের নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা শুরু করেন। তবে ইসরায়েল সিরিয়ায় তার নিজস্ব এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে।
সাবেক প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ সরকারের পতনের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ইসরায়েল গোলান মালভূমির বাইরে সিরিয়ায় তার দখলদারির সম্প্রসারণ শুরু করে।
যদিও নতুন সিরীয় কর্তৃপক্ষ প্রথম থেকেই বলে দিয়েছিল, তারা ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাত চায় না। তবু ইসরায়েলি সেনারা সিরিয়ার রাষ্ট্র ও সামরিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর বিমান হামলা চালায়।
ইসরায়েলি বাহিনী দক্ষিণ সিরিয়াতেও অভিযান চালাচ্ছে এবং স্থানীয়দের অপহরণ ও নিখোঁজ করার ঘটনা ঘটাচ্ছে।
গত মাসে ইসরায়েলি বিমান হামলায় ১৩ জন সিরীয় নাগরিক নিহত হওয়ার পর ট্রাম্প ইসরায়েলের সমালোচনা করেন।
ট্রাম্প বলেন, ‘ইসরায়েল এবং সিরিয়ার মধ্যে দৃঢ় ও প্রকৃত সংলাপ বজায় রাখা খুবই জরুরি। এমন কিছু করা উচিত নয়, যা সিরিয়াকে একটি সমৃদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করার পথে বাধা তৈরি করবে।’
সিরিয়া ও ইসরায়েল চলতি বছরের শুরুতে নিরাপত্তা চুক্তি করার জন্য আলোচনায় বসেছিল। তবে ইসরায়েলি নেতারা সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পতনের পর দখলকৃত ভূমি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে দেওয়ার জোর দাবি জানালে আলোচনা ভেস্তে যায়।
নেতানিয়াহুর এবারের যুক্তরাষ্ট্র সফরে ট্রাম্প সিরিয়া-ইসরায়েল চুক্তি নতুন করে এগিয়ে নেওয়ার জন্য চাপ দেবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
কেন ইরান আবার শিরোনামে
নেতানিয়াহুর সফর এমন এক সময়ে হচ্ছে, যখন ইসরায়েলে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতা পুনর্নির্মাণের বিষয়ে সতর্কবার্তা বেড়ে গেছে। গত জুনে দুই দেশের মধ্যে ১২ দিনের সংঘাতের পর এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
গত সপ্তাহে এনবিসি নিউজের খবরে বলা হয়, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে ইরানের ওপর আরও হামলার পরিকল্পনা বিষয়ে অবহিত করবেন।
ট্রাম্প শিবিরের ইসরায়েলপন্থী অংশ ইতিমধ্যেই ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির বিরুদ্ধে সরব হয়ে উঠছে।
চলতি মাসে মার্কিন সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহাম ইসরায়েল সফর করেন এবং ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রকে ইসরায়েলের জন্য ‘বাস্তব হুমকি’ হিসেবে উল্লেখ করেন।
দ্য জেরুজালেম পোস্টকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে গ্রাহাম বলেন, ‘এই সফরের মূল উদ্দেশ্য হলো ইসরায়েলের জন্য ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের ঝুঁকি তুলে ধরা।’
জুনে ইরান-ইসরায়েল সংঘাত চলাকালে ট্রাম্প ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় মার্কিন হামলার অনুমোদন দিয়েছিলেন।
ইরান তাদের পারমাণবিক কর্মসূচিকে অস্ত্র তৈরির কাজে ব্যবহার করছে বলে কোনো প্রমাণ না থাকার পরেও সম্ভাব্য ইরানি পারমাণবিক বোমার ভয়ই যুক্তরাষ্ট্রের সংঘাতে জড়ানোর মূল কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছিল।
সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল পলিসির জ্যেষ্ঠ ফেলো সিনা টুসি বলেছেন, ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে সমর্থন করার জন্য ট্রাম্পকে রাজি করানোটা নেতানিয়াহুর জন্য কঠিন হবে।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজেকে শান্তি প্রতিষ্ঠাকারী হিসেবে উপস্থাপন করছেন এবং ভেনেজুয়েলায় সম্ভাব্য সংঘাতকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন।
টুসির মতে, ইরানের ওপর আরও হামলার চাপ নেতানিয়াহুর জন্য উল্টো ফল বয়ে আনতে পারে।
তবে টুসি এটাও বলেছেন, ট্রাম্প কী করবেন, তা নিয়ে আগে থেকে কিছু বলা যায় না। কারণ, তাঁর আশপাশে রুবিওর মতো ইসরায়েলপন্থীরা আছেন।
যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল সম্পর্কের বর্তমান অবস্থা কী
যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক অঙ্গনে বাম ও ডান—দুই দিক থেকেই বিরোধিতা বাড়লেও ইসরায়েলের প্রতি ট্রাম্পের সমর্থন এখনো অটল।
চলতি মাসে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস একটি সামরিক ব্যয় বিল পাস করেছে। সেখানে ইসরায়েলের জন্য ৬০ কোটি ডলার সামরিক সহায়তা দেওয়ার কথা বলা আছে।
ট্রাম্প প্রশাসন গাজায় যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন বা পশ্চিম তীরে অবৈধ বসতি সম্প্রসারণসহ ওই অঞ্চলে ইসরায়েলের আগ্রাসী আচরণের বিরুদ্ধে মৌখিক সমালোচনাও এড়িয়ে চলছে।
১৬ ডিসেম্বর হোয়াইট হাউসে ইহুদিদের উৎসব হানুক্কা উদ্যাপন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সে সময় ট্রাম্প কংগ্রেসে ইসরায়েলের প্রতি নিঃশর্ত সমর্থনের বিষয়ে বাড়তে থাকা সংশয় নিয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করেন। তিনি এই মনোভাবকে ইহুদিবিদ্বেষের সঙ্গে তুলনা করেন।
ট্রাম্প বলেন, ‘আপনি যদি ১০, ১২ বা ১৫ বছর আগে ফিরে তাকান, তাহলে দেখতে পাবেন ওয়াশিংটনে সবচেয়ে শক্তিশালী লবি ছিল ইহুদি লবি। আর তা হলো ইসরায়েল। এখন আর তা নেই।’
ট্রাম্প আরও বলেন, ‘আপনাদের খুব সতর্ক থাকতে হবে। বিশেষ করে কংগ্রেসে এমন একটা মনোভাব তৈরি হচ্ছে, যা ইহুদিবিদ্বেষী।’
তবে বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের কৌশলগত অগ্রাধিকারের মধ্যে দূরত্ব বাড়ছে।
সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল পলিসির জ্যেষ্ঠ ফেলো সিনা টুসির মতে, ওয়াশিংটন যখন মধ্যপ্রাচ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা জোরদার করতে চাইছে, তখন ইসরায়েল অঞ্চলজুড়ে ‘পূর্ণ আধিপত্য’ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের উপসাগরীয় মিত্ররাও রয়েছে।
টুসি আরও বলেন, ইসরায়েল যে আপসহীন অবস্থান ও কৌশলগত লক্ষ্য অনুসরণ করছে, তা একসময় যুক্তরাষ্ট্রের মূল স্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল জোটের ভবিষ্যৎ কী
ওয়াশিংটন ডিসির ইনডিপেনডেন্স অ্যাভিনিউ ধরে গাড়ি চালালে কংগ্রেস সদস্যদের দপ্তরের জানালায় অনেক সময় মার্কিন পতাকার চেয়ে বেশি ইসরায়েলি পতাকা চোখে পড়বে।
জনমত বদলাতে শুরু করলেও কংগ্রেস ও হোয়াইট হাউসে ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন এখনো বিপুল। রিপাবলিকান শিবিরে ইসরায়েল নিয়ে সমালোচনা বাড়লেও যাঁরা ইসরায়েলের বিরোধিতা করছেন, তাঁদের কোণঠাসা করে দেওয়া হচ্ছে। মার্জোরি টেইলর গ্রিন কংগ্রেস ছাড়ছেন। বিশ্লেষক টাকার কার্লসন নিয়মিত হামলা ও ইহুদিবিদ্বেষের অভিযোগের মুখে পড়ছেন। আর কংগ্রেস সদস্য টম ম্যাসি ট্রাম্প-সমর্থিত এক প্রতিদ্বন্দ্বীর চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছেন।
ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ মহল কট্টর ইসরায়েলপন্থীদের দিয়ে ভরা। যাঁদের মধ্যে আছেন—পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও, ধনকুবের দাতা মিরিয়াম অ্যাডেলসন এবং রেডিও উপস্থাপক মার্ক লেভিন।
তবে জনসমর্থন কমে যাওয়ায়, বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে জনসমর্থন কমে যাওয়ায় দীর্ঘ মেয়াদে মার্কিন রাজনীতিতে ইসরায়েলকে হয়তো কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হবে।
কংগ্রেসে ডেমোক্র্যাট সদস্যদের মধ্যে যাঁরা ইসরায়েলের কট্টর সমর্থক, তাঁদের কেউ কেউ এখন প্রাইমারি নির্বাচনে ফিলিস্তিনি অধিকারের পক্ষ সোচ্চার থাকা প্রগতিশীল প্রতিদ্বন্দ্বীদের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন।
সবচেয়ে প্রভাবশালী ইসরায়েলপন্থী লবিং সংগঠন আমেরিকান ইসরায়েল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি (এআইপিএসি) ডেমোক্র্যাটদের কাছে ক্রমেই একটি ‘বিষাক্ত’ ব্র্যান্ডে পরিণত হচ্ছে।
ডানপন্থী শিবিরেও ইসরায়েলের প্রতি সমর্থনের ঐকমত্যে ফাটল আরও স্পষ্ট হচ্ছে।
ট্রাম্প প্রশাসন যেখানে ফিলিস্তিনি অধিকারের পক্ষে সোচ্চার থাকা মানুষদের দমন করতে জায়নবাদের বিরোধিতাকে ইহুদিবিদ্বেষ হিসেবে আইনি রূপ দেওয়ার চেষ্টা করছে, সেখানে ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স এ বিষয়ে তুলনামূলক সংযত অবস্থান নিয়েছেন।
সম্প্রতি আনহার্ড ওয়েবসাইটকে দেওয়া সাক্ষাকারে ভ্যান্স বলেন, ‘আসলে যা ঘটছে, তা হলো মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির একটি দীর্ঘদিনের ঐকমত্যের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিক্রিয়া। আমি মনে করি, আমাদের এই নিয়ে আলোচনা করা উচিত, সেটিকে চেপে রাখার চেষ্টা করা নয়। অধিকাংশ মার্কিন নাগরিক ইহুদিবিদ্বেষী নন। তাঁরা কখনোই হবেন না। আমাদের উচিত আসল বিতর্কে মনোযোগ দেওয়া।’
সব মিলিয়ে বলা যায়, প্রবণতা বদলাচ্ছে। তবে আপাতত ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গীকার দৃঢ়ই রয়েছে।