ট্রাম্পের বিরুদ্ধে করা তদন্ত প্রতিবেদনে যা আছে

৬ জানুয়ারি ক্যাপিটলে হামলার তদন্ত কমিটি বলছে, এই হামলা উসকে দিয়েছেন ট্রাম্প
ফাইল ছবি: রয়টার্স

যুক্তরাষ্ট্রের ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর সেই ফলাফল পাল্টে দিতে ষড়যন্ত্রের পথ বেছে নিয়েছিলেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এই ষড়যন্ত্রের পথ ধরে ২০২১ সালে ৬ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্ট ভবন ক্যাপিটলে হামলা হয়। হামলার পর কংগ্রেসের একটি প্যানেল এর তদন্ত শুরু করে। সেই তদন্তে নির্বাচনের ফল নিয়ে ট্রাম্পের ষড়যন্ত্রের এই চিত্র উঠে এসেছে। তদন্ত কমিটি ট্রাম্পকে দায়ী করেছে বিভিন্ন দিক থেকে।

কংগ্রেসের তদন্ত কমিটি ৮৪৫ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন দিয়েছে। এতে সুপারিশ করা হয়েছে, ট্রাম্প যেন ভবিষ্যতে আর সরকারি কার্যালয়ের কোনো পদে বসতে না পারেন। অর্থাৎ ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্প প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ঘোষণা দিয়েছেন, প্রকারান্তরে তা আটকে দেওয়ার সুপারিশ করেছে কমিটি।

৬ জানুয়ারি হামলার পরপরই ওই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এ জন্য ১৮ মাস সময় নিয়েছে তারা। এ সময় ১০টি প্রকাশ্য শুনানি হয়েছে। এক হাজারের বেশি মানুষের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তা যেমন রয়েছেন, তেমনি রয়েছেন ট্রাম্পের পরিবারের সদস্যও। এ ছাড়া পুলিশ কর্মকর্তা ও দাঙ্গাকারীও সাক্ষ্য দিয়েছেন।

কংগ্রেসের এই তদন্ত কমিটিতে রয়েছেন ট্রাম্পের রাজনৈতিক দল রিপাবলিকান পার্টির দুই সদস্য এবং বর্তমান ক্ষমতাসীন দল ডেমোক্রেটিক পার্টির সাত সদস্য। তদন্ত শেষে ট্রাম্পকে বিচারের আওতায় আনতে গত সোমবার তাদের সুপারিশ বিচার বিভাগের কাছে পাঠিয়েছে।

৮৪৫ পৃষ্ঠার এ তদন্ত প্রতিবেদনটি যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার জনসমক্ষে এসেছে। সেখান থেকে ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরা হলো।

ট্রাম্পের মিথ্যা দাবি

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ সালের নির্বাচনে রাতে ট্রাম্প নিজের বিজয় দাবি করেছিলেন, তা ছিল মিথ্যা। এটা ছিল পূর্বপরিকল্পিত। সেই সময় তাঁর আইনজীবী রুডি জুলিয়ানি ছাড়া এই দাবি আর কেউ বিশ্বাস করেননি। নিজের বিজয় দাবি করার পরপরই ভিত্তিহীন একটি অভিযোগ তোলেন ট্রাম্প। সেটি হলো, এই নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে। জোরালোভাবে এই মিথ্যা দাবি করেই যাচ্ছিলেন ট্রাম্প।

তদন্ত কমিটিতে ট্রাম্পের একাধিক আইনজীবী ও উপদেষ্টা সাক্ষ্য দিয়েছেন। তাঁরাও বলেছেন, ট্রাম্প নির্বাচনে কারচুপির যে অভিযোগ তুলেছিলেন, তা তাঁরা বিশ্বাস করতেন না। এ ছাড়া এ দাবির পক্ষে কোনো যুক্তিও ছিল না।

কমিটির কাছে এ বিষয়ে স্পষ্ট বক্তব্য দিয়েছেন ট্রাম্পের সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল উইলিয়াম বার। তিনি কমিটিকে দেওয়া জবানবন্দিতে বলেন, ‘আমি এটা স্পষ্ট করে বলেছিলাম, নির্বাচনে কারচুপির যে অভিযোগ তোলা হয়েছে, তার সঙ্গে আমি একমত নই।’ নির্বাচনে কারচুপির প্রচার বন্ধ করতেও বলেছিলেন তিনি। বিষয়টি তিনি ডোনাল্ড ট্রাম্পকেই বলেছিলেন।

তবে এরপরও ট্রাম্প নির্বাচনের ষড়যন্ত্র তত্ত্বের প্রচার চালিয়ে যান কয়েক সপ্তাহ ধরে। যদিও সেই সময় প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারাও ট্রাম্পকে জানিয়েছিলেন, তিনি যে দাবি তুলছেন, সেটা আদতে সত্য নয়।

ট্রাম্পের কারণে দাঙ্গাকারীরা ওয়াশিংটনে

তদন্তের পর কমিটি বলেছে, ক্যাপিটলে হামলার বিষয়টি ট্রাম্প নিজেই উসকে দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে ২০২০ সালের ১৯ ডিসেম্বরের একটি টুইট উপস্থাপন করেছে কমিটি। ওই দিন ট্রাম্প একটি টুইট করে জানান, ৬ জানুয়ারি ওয়াশিংটন ডিসিতে বড় সমাবেশ হবে। এই সমাবেশে যোগ দিন, বেপরোয়া হয়ে উঠুন।

জবানবন্দি এবং আদালতের নথি, দাঙ্গাকারী ও মিলিশিয়া বাহিনীর সদস্য যাঁরা ওই দিন ক্যাপিটলে উপস্থিত ছিলেন, তাঁরা স্বীকার করেছেন, ট্রাম্পের ওই টুইট দাঙ্গাকারীদের ওয়াশিংটনে আসার পক্ষে একধরনের যুক্তি দাঁড় করাতে সাহায্য করেছে।

৬ জানুয়ারি হামলা বন্ধে ট্রাম্প কোনো পদক্ষেপ নেননি।
ফাইল ছবি

ট্রাম্পের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ক্যাপিটলে এসেছিলেন এমন একজনের উদাহরণ তুলে ধরা হয়েছে। রবার্ট মরস নামের এই ব্যক্তি ক্যাপিটলে হামলার জন্য দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। কমিটিকে তিনি বলেন, ট্রাম্পের ওই টুইট বার্তা পেয়েই তিনি সেখানে গেছেন। এ ছাড়া গোয়েন্দা সংস্থাও আগে থেকেই সতর্কবার্তা দিয়েছিল, ৬ জানুয়ারি ট্রাম্পের সমর্থকেরা সেখানে আসতে পারেন এবং সহিংস হামলা চালাতে পারেন।

দাঙ্গা থামাতে ট্রাম্প ব্যর্থ

তদন্ত কমিটি তার প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে, ৬ জানুয়ারি হামলা বন্ধে ট্রাম্প কোনো পদক্ষেপ নেননি। কংগ্রেস থেকে দেওয়া সতর্কবার্তা তিনি যে উপেক্ষা করেছেন, সেটি ট্রাম্পের পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়েছে।

ট্রাম্পের সেই সময়ের পদক্ষেপ নিয়ে বেশ কয়েকজন জবানবন্দি দিয়েছেন। এর মধ্যে হোয়াইট হাউসের কর্মী ক্যাসিডি হাচিনসন অন্যতম। ওই দিন হোয়াইট হাউসে কী কী বিশৃঙ্খল ঘটনা ঘটেছিল তার প্রমাণ তুলে ধরেছেন ক্যাসিডি।

তদন্তে কমিটি বলেছে, ট্রাম্পের ডাকে সাড়া দিয়ে হামলাকারীরা ক্যাপিটলে এসেছিলেন
ফাইল ছবি

ওই হামলার দিন কংগ্রেসের সদস্যরা ক্যাপিটলে আটকে পড়ার পর তাঁরা হোয়াইট হাউসের চিফ অব স্টাফ মার্ক মিডোসের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। তাঁরা সাহায্য চেয়েছিলেন। কিন্তু হোয়াইট হাউস কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এতে হোয়াইট হাউসের অনেকে হতাশ হয়েছিলেন। ট্রাম্পের আমলে হোয়াইট হাউসে কাজ করেছেন হোপ হিকস। তিনি ট্রাম্পের মেয়ে ইভানকা ট্রাম্পের চিফ অব স্টাফ জুলি র‌্যাডফোর্ডকে দেওয়া একটি খুদে বার্তায় লিখেছিলেন, ‘আমরা সবাই এখন স্থানীয় সন্ত্রাসীদের মতো আচরণ করছি।’ এ ছাড়া হোয়াইট হাউসের আরেক আইনজীবীকে তিনি খুদে বার্তা দিয়েছিলেন, ‘আমি খুবই হতাশ। আমরা সবকিছু করেছি যেন মুছে ফেলার জন্য।’

উগ্র ডানপন্থীদের পরিকল্পিত হামলা

যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন হয় ২০২০ সালের ৩ নভেম্বর। এরপর ডিসেম্বরকে সামনে রেখে হামলার ছক কষেন ডানপন্থীরা। এ জন্য ওয়াশিংটন ডিসিকে যেমন লক্ষ্যবস্তু হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছিল, তেমনি হামলার লক্ষ্য আগে থেকেই ছিল ক্যাপিটল ভবন। এ জন্য এফবিআইকে বার্তাও দেওয়া হয়েছিল। ‘ওথ কিপার্স’ ও ‘প্রাউড বয়েজের’ মতো ডানপন্থী গোষ্ঠীগুলো এমন পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত ছিল।

যেসব বার্তা ওই সময় দেওয়া হয়েছিল, সেগুলোর একটি এমন, ‘পথ একটাই। এটা কোনো সংকেত নয়। এটা কোনো সভা নয়। সেটা বুলেট।’

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাজ করে ক্যাপিটল পুলিশ ও সিক্রেট সার্ভিস। তারাও এমন বার্তা পেয়েছিল। ক্যাপিটলে হামলা হতে পারে, সরাসরি এমন বার্তায় তখন দেওয়া হয়েছিল। তদন্ত প্রতিবেদনের নথিতে এমন বার্তা তুলে ধরা হয়েছে।

হামলার বার্তা ট্রাম্পপন্থী বিভিন্ন ওয়েবসাইটে যেমন ছিল, তেমনি ছিল টুইটারে। আবার নজরদারির আওতার বাইরে থাকা বার্তা আদান-প্রদানের অ্যাপেও এমন বার্তা পাঠানো হয়েছিল সেই সময়। এরপর প্রতিফলন দেখা গেছে ৬ জানুয়ারি। সেদিন যাঁরা হামলা চালিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ডানপন্থী গ্রুপের সদস্যরাও ছিলেন।

নির্বাচনের ফল বদলে দিতে ট্রাম্পের চাপ

কারচুপির নির্বাচন, নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা ছাড়াও আরেকটি কাজ করেছিলেন ট্রাম্প। ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সকে এই নির্বাচনের ফল বদলে দিতে, অর্থাৎ তাঁকে বিজয়ী ঘোষণা করতে চাপ দিয়েছিলেন ট্রাম্প।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৬ জানুয়ারি মাইক পেন্সের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন ট্রাম্প। এ জন্য তাঁর সহকারীদের পেন্সকে টেলিফোন করতে বলেছিলেন। পরে অবশ্য কথা বলেছিলেন ট্রাম্প। এ সময় তিনি পেন্স বলেছিলেন, তাঁর ক্ষমতা রয়েছে জো বাইডেনের জয়ের আনুষ্ঠানিকতা ঠেকিয়ে দেওয়ার।

ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সকে এই নির্বাচনের ফল বদলে দিতে চাপ দিয়েছিলেন ট্রাম্প
ফাইল ছবি

তদন্তে সাক্ষ্য দেওয়া কয়েকজন বলেছেন, কথোপকথনের একপর্যায়ে পেন্সকে ভীতু বলে সম্বোধন করেন এবং তিনি ‘যথেষ্ট শক্ত নন’ বলেও মন্তব্য করেন ট্রাম্প।

এদিকে ৬ জানুয়ারি হামলাকারীদের সামনে যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেখানে পেন্সের কথা উল্লেখ করেন ট্রাম্প। বলেন, ‘পেন্স সঠিক কাজটি করবেন।’ পরে হামলার একপর্যায়ে পেন্সের নামে স্লোগান দেওয়া হয়। দাঙ্গাকারীরা ‘পেন্সের ফাঁসি চাই’ বলে স্লোগান দেন।

সরকারি দপ্তরে ট্রাম্প অযোগ্য

তদন্ত কমিটি বিচার বিভাগের কাছে ১১টি সুপারিশ তুলে ধরেছে। সেখানে সংবিধান থেকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, যদি কেউ সংবিধানের ধারাবাহিকতা রক্ষার শপথ নেন কিন্তু ‘একটি বিদ্রোহের সঙ্গে জড়িত থাকেন’ অথবা ‘সংবিধানের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত ব্যক্তিদের স্বস্তি দেন বা সাহায্য করেন’ তবে তিনি সরকারি কার্যালয়ে কাজ করার অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্রাম্প এই বিদ্রোহে সহযোগিতা করেছেন। অর্থাৎ কমিটি চাইছে, ট্রাম্প যেন কোনো সরকারি কার্যালয়ে কাজ করতে না পারেন সেই পদক্ষেপ নেবে বিচার বিভাগ।

বিবিসি থেকে অনুবাদ মোজাহিদুল ইসলাম মণ্ডল