যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ কী বার্তা দিচ্ছে

ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভে ফিলিস্তিনের পতাকা হাতে এক শিক্ষার্থী। লস অ্যাঞ্জেলেস, ক্যালিফোর্নিয়া, ২৫ এপ্রিলছবি: রয়টার্স

ফিলিস্তিনের গাজা নিয়ে মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে শিক্ষার্থীদের চলা বিক্ষোভ ইসরায়েলকে সমর্থন করা বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দাদের মধ্যে প্রজন্মগত ফারাককে তুলে ধরেছে। দেশজুড়ে আন্দোলন ছড়িয়ে দিয়ে তরুণ প্রজন্ম মার্কিন রাজনীতিবিদদের ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষগুলোকে এ বিষয়ে চ্যালেঞ্জ জানাতে চান। এমনটাই মত বিশ্লেষকদের।

বিশ্লেষকেরা যুক্তি দিচ্ছেন, ফিলিস্তিনিদের ব্যাপারে আগের চেয়ে আরও বেশি সহানুভূতিশীল এই তরুণ মার্কিন প্রজন্ম। তাদের সঙ্গে আগের প্রজন্মের মানুষের মতামতের পার্থক্য জো বাইডেনের (৮১) পুনরায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনায় ঝুঁকি তৈরি করেছে।

সাধারণভাবে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে বড় ছাত্র বিক্ষোভ চলাকালে বা এর জেরে জনমতে এক বড় পরিবর্তন আসতে দেখা গেছে। দেশের রাজনীতিতে পরিবর্তনের ভিত্তি হয়ে উঠতে পারে ক্যাম্পাসের এ বিক্ষোভ। কম-বেশি এমন একটা ধারণা আছে, এ বিক্ষোভই দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে পারে।
এমান আবদেলহাদি, ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর সমাজবিজ্ঞানী

নতুন ও পুরোনো প্রজন্মের মধ্যে মতামতের এ ফারাক যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসরায়েলের জন্যও একটি হুমকি। দেশটি ওয়াশিংটনে রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট—উভয় দল থেকে সমর্থন পেয়ে আসছে।

ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ওমর ওয়াশো বলেন, ‘ইসরায়েলকে নিয়ে এরই মধ্যে আমরা প্রজন্মগত মতপার্থক্যের বিষয়টি দেখতে পাচ্ছি। এটি ডেমোক্রেটিক পার্টির জন্য দীর্ঘমেয়াদি একটি ইস্যু হতে চলেছে।’

আল জাজিরাকে ওমর ওয়াশো বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চলা বিক্ষোভ এ মতপার্থক্যকে জোরালো করেছে।’

ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানিয়ে ক্যাম্পাসে গত সপ্তাহে অস্থায়ী ক্যাম্প গড়ে তুলেছেন নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা। তাঁদের বিক্ষোভ দমনে পুলিশকে ব্যবস্থা নিতে বলেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এরপর থেকে বিক্ষোভে অংশ নেওয়া এ শিক্ষার্থীরা গ্রেপ্তার হওয়াসহ বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থার সম্মুখীন হচ্ছেন।

দমনপীড়ন সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে একই রকম ক্যাম্প গড়ে তুলেছেন শিক্ষার্থীরা। বিক্ষোভ চলছে অন্যান্য দেশেও।

প্রকাশিত বিভিন্ন ফুটেজে দেখা গেছে, বিক্ষোভে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের পাশাপাশি সাংবাদিকদেরও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে সহিংস পন্থায় আটক করছে পুলিশ। এসব ঘটনায় ক্ষোভ আরও বেড়েছে। কিন্তু ক্রমেই ছড়িয়ে পড়তে থাকা বিক্ষোভ প্রশমনে খুব সামান্যই ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।

জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটিতে ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ। ওয়াশিংটন, ২৫ এপ্রিল
ছবি: রয়টার্স

‘বিভক্তির মুহূর্ত’

বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের মূলত দাবি, তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তৃপক্ষ যেন ইসরায়েলকে সরবরাহ করা অস্ত্রের উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ও ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিনিয়োগ না করে এবং তাদের কাছ থেকে তহবিল না নেয়।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের পাশাপাশি হোয়াইট হাউস ও ইসরায়েলপন্থী গোষ্ঠীগুলোর অভিযোগ, শিক্ষার্থীরা ইহুদি–বিদ্বেষ উসকে দিচ্ছেন। তবে বিক্ষোভকারীরা দ্ব্যর্থহীনভাবে এ অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছেন।

এমান আবদেলহাদি ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর সমাজবিজ্ঞানী। তাঁর মতে, যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতির অপরিবর্তনশীল অবস্থায় দেশটির তরুণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে ক্রমেই হতাশা বাড়ছে। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, পুরোনো প্রজন্মের ব্যাপারে তাঁদের সত্যিকার অসন্তোষ রয়েছে। তবে যা আরও গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, পুরোনো প্রজন্মের চালু রাখা ব্যবস্থার প্রতি তাঁদের অসন্তোষের বিষয়টি।’

আরও পড়ুন

এমান আবদেলহাদি বলেন, শিক্ষার্থীদের এ বিক্ষোভ মার্কিন জনমতে ‘বিভক্তির মুহূর্ত’কে আরও বিস্তৃতভাবে তুলে ধরেছে।

আল জাজিরাকে এ সমাজবিজ্ঞানী বলেন, সাধারণভাবে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে বড় ছাত্র বিক্ষোভ চলাকালে বা এর জের ধরে জনমতে এক বড় পরিবর্তন আসতে দেখা গেছে। দেশের রাজনীতিতে পরিবর্তনের ভিত্তি হয়ে উঠতে পারে ক্যাম্পাসের এ বিক্ষোভ। কম–বেশি এমন একটা ধারণা আছে, এ বিক্ষোভই দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি হোয়াইট হাউস ও ইসরায়েলপন্থী গোষ্ঠীগুলোর অভিযোগ, শিক্ষার্থীরা ইহুদি-বিদ্বেষ উসকে দিচ্ছেন। তবে বিক্ষোভকারীরা দ্ব্যর্থহীনভাবে এ অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছেন।

বাইডেনের দুশ্চিন্তা

গত কয়েক বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রে চালানো বিভিন্ন জনমত জরিপে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সম্ভবত আরও বেশি সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠা ও ইসরায়েলের ব্যাপারে সমালোচনামূলক মনোভাব পোষণ করার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

সার্বিকভাবেও মার্কিনদের মধ্যে ফিলিস্তিনিদের প্রতি ইসরায়েলের আচরণ, বিশেষ করে গাজায় দেশটির চলমান যুদ্ধ নিয়ে নেতিবাচক মনোভাব বেড়েছে।

একাধিক জনমত জরিপ ইঙ্গিত দিচ্ছে, জরিপে অংশ নেওয়া মার্কিনদের বড় অংশ গাজা উপত্যকায় স্থায়ী যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠাকে সমর্থন করেন। গত ৭ অক্টোবর গাজায় ইসরায়েলি বাহিনী নারকীয় তাণ্ডব শুরু করার পর এ পর্যন্ত সেখানে নিহত হয়েছেন ৩৪ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি। তাঁদের বেশিরভাগ নারী ও শিশু। ইসরায়েলের আগ্রাসনে উপত্যকার বড় অংশ পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে।

এ নৃশংসতা সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট বাইডেন ইসরায়েলকে দৃঢ় সমর্থন দেওয়া অব্যাহত রেখেছেন। এমন অবস্থান ৮১ বছর বয়সী এ প্রেসিডেন্টের জন্য হয়ে উঠতে পারে রাজনৈতিকভাবে ব্যয়বহুল। কেননা, আগামী নভেম্বরে পুনর্নির্বাচনী দৌড়ে সম্ভাব্য রিপাবলিকান প্রার্থী ও সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মুখোমুখি হতে হবে তাঁকে।

জরিপের ফলাফলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে, নির্বাচনে জিততে প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে ডেমোক্রেটিক পার্টির ঘাঁটি ধরে রাখতে হবে। কিন্তু ইসরায়েলকে সমর্থন করা নিয়ে সেখানকার ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে ঐক্য রিপাবলিকানদের মতো সুসংহত নয়।

আরও পড়ুন

অ্যাঙ্গাস জনস্টন যুক্তরাষ্ট্রে ছাত্র বিক্ষোভের ঘটনার একজন ঐতিহাসিক। তিনি বলেন, ইসরায়েলকে নিয়ে প্রজন্মগত বিভাজন বিশেষ করে ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে সুস্পষ্ট।

আল জাজিরাকে এই ঐতিহাসিক বলেন, ‘জাতীয় পর্যায়ে আমরা এ বিভাজনকে ডেমোক্র্যাট দলের তরুণ ভোটার ও অধিকাংশ রাজনীতিকের মূল্যবোধের মধ্যে একধরনের বিচ্ছিন্নতার রূপে দেখেছি। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ও প্রশাসকদের মধ্যে একই রকমের বিচ্ছিন্নতা দেখছি। অ্যালামনাই ও দাতাদের নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালনা করেন এই প্রশাসকেরা।’

সমাজবিজ্ঞানী আবেদলহাদির মতে, গাজাবাসীর প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের এ সংহতি বিক্ষোভ কঠোর হাতে দমনের দৃষ্টিভঙ্গি ডেমোক্র্যাটদের এই যুক্তিকে ক্ষুণ্ন করেছে যে বাইডেনের বিজয় জাতিকে ট্রাম্পের হাত থেকে রক্ষা করবে। এই ডেমোক্র্যাটরা ট্রাম্পের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারের অভিযোগ করে থাকেন।

আবদেলহাদির মতের অনুরূপ মতামত ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার সহকারী অধ্যাপক ওমর ওয়াশোর। তিনি বলেন, চলমান বিক্ষোভ ও এতে দমনপীড়ন বাইডেনের ব্যাপারে ভোটারদের অনাগ্রহে যুক্ত করতে পারে নতুন মাত্রা।

ফিলিস্তিনের সমর্থনে বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে ইসরায়েলপন্থী শিক্ষার্থীরাও। লস অ্যাঞ্জেলেস, ক্যালিফোর্নিয়া, ২৫ এপ্রিল
ছবি: রয়টার্স

পররাষ্ট্রনীতির পরিবর্তন

সে যা–ই হোক, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা যুক্তরাষ্ট্রের দলীয় রাজনীতিতে নিজেদের জড়াচ্ছেন না। এর পরিবর্তে তাঁরা ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকার রক্ষায় সহায়তা করার তাঁদের দাবিতে জোর দিচ্ছেন।

স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠছে, মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন আনা ও যুক্তরাষ্ট্রকে ‘গণহত্যা থেকে বিচ্ছিন্ন’ রাখার দাবি পূরণে বিক্ষোভকারীরা সক্ষম হবেন কি না।

আরও পড়ুন

এ বিষয়ে ঐতিহাসিক জনস্টন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইসরায়েলকে সহায়তাকারী ওই সব বড় প্রতিষ্ঠান ও প্রতিরক্ষা খাত থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করবে—সম্ভবত এটি স্বল্প সময়ে হবে না। কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলোয় বিনিয়োগে স্বচ্ছতা আনার দাবি যৌক্তিক। তিনি আরও বলেন, দীর্ঘমেয়াদে পরিবর্তন আনা সম্ভব। কিন্তু তা রাতারাতি হবে না।

‘আমরা বারবার দেখেছি, ছাত্র বিক্ষোভ পররাষ্ট্রনীতিতে বদল এনেছে। তবে তা সব সময় দ্রুত আনেনি। আবার, শিক্ষার্থীরা যেভাবে চেয়েছেন, সেভাবেও সব সময় আসেনি’, বলেন জনস্টন।

আরও পড়ুন