যুক্তরাষ্ট্রে কেন নেই দ্রুতগতির ট্রেন

চীনে উচ্চগতির বুলেট ট্রেনফাইল ছবি: রয়টার্স

আধুনিক এই যুগে উচ্চগতির ট্রেন কতটা জরুরি, সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এতে ভ্রমণে কেবল সময় কম লাগে না, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান ও মানুষকে কাছাকাছি নিয়ে আসতে এই ট্রেনের ভূমিকা অসাধারণ। চীন, জাপান ও ইউরোপের দেশগুলো উচ্চগতির ট্রেনের ব্যবহারে নেতৃত্ব দিচ্ছে বলা যায়।

কিন্তু এসব দেশের মতো যুক্তরাষ্ট্রে কেন এমন রেল নেটওয়ার্ক নেই। এই গ্রহের সবচেয়ে ধনী দেশ, অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে সফল দেশ। দেশের প্রায় ৩০ কোটি মানুষ নগরজীবনে বসবাস করে। কিন্তু তারা কেন উচ্চগতির ট্রেনের ব্যবহার করছে না, সেটা বোঝা বেশ মুশকিল।

জাপান ১৯৬৪ সালে শিনকেনসনের সঙ্গে প্রথম ‘বুলেট ট্রেন’ চালু করে। ফ্রান্স ১৯৮০–এর দশকে টিজিভি উচ্চগতির ট্রেন চালুর পর বিশ্বব্যাপী পরিবহনব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে। কিন্তু এই বিপ্লবকে এত দিন ধরে অনেকটা এড়িয়ে চলেছে যুক্তরাষ্ট্র।

যুক্তরাষ্ট্রে দূরপাল্লার পথে যাতায়াতের জন্য এখনো মহাসড়ক বা আকাশপথই ভরসা। এ জন্য তাঁদের কম ভোগান্তি হচ্ছে না।

চীন ২০০৮ সাল থেকে প্রায় ২৬ হাজার মাইল (৪২ হাজার কিলোমিটার) উচ্চগতির ট্রেন চলাচলের জন্য রেললাইন নির্মাণ করেছে। ২০৩৫ সাল নাগাদ তারা ৪৩ হাজার মাইল (৭০ হাজার কিলোমিটার) রেললাইন নির্মাণের পরিকল্পনা করছে।

এই জায়গায় যুক্তরাষ্ট্র অনেক পিছিয়ে। ১০০ মাইলের বেশি গতিতে চলাচলের মতো তাদের মাত্র ৩৭৫ রুট–মাইল দীর্ঘ লাইন রয়েছে।

উত্তর আমেরিকার রেলপথশিল্পের পুরোনো প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান রেলওয়ে এজ–এর প্রধান সম্পাদক উইলিয়াম সি বানতুনো বলেন, অধিকাংশ মার্কিন নাগরিকের মধ্যে উচ্চগতির ট্রেন বা এই ট্রেনের মূল্য সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই। হতাশাজনকভাবে মহাসড়ক আর আকাশপথই তাদের মনে গেঁথে আছে।

১৯৫০–এর দশক থেকে প্রাইভেট কার ও উড়োজাহাজ যুক্তরাষ্ট্রে দূরপাল্লার ভ্রমণে প্রধান ভরসা হয়ে আছে। তবে ‘দ্য এম্পায়ার বিল্ডার’, ‘সুপার চিফ’ ও ‘সিলভার কমেট’–এর মতো বিলাসী যাত্রীবাহী ট্রেন দ্রুত জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

১৯৭০–এর দশকে নিউইয়র্ক সেন্ট্রালের মতো বিখ্যাত রেল পরিবহন দেউলিয়া হয়ে যায়। ফলে ১৯৭১ সালে প্রতিষ্ঠিত জাতীয় যাত্রীবাহী ট্রেন পরিচালনাকারী সংস্থা আমট্রাকের কাছে এই প্রতিষ্ঠানটিকে হস্তান্তর করা হয়।

পণ্যবাহী রেলপথ নির্মাণে যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। তবে ব্যাপক হারে কর্মী ছাঁটাইসহ নানা বাজে অভিজ্ঞতার কারণে যাত্রীবাহী ট্রেনের বিষয়টি আর হালে পানি পায়নি। মার্কিন আইনপ্রণেতারাও এ নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামান না।

ওয়াশিংটনে প্রভাবশালী উড়োজাহাজ কোম্পানি, তেল ও গাড়িশিল্পের লবি গ্রুপ নিজেদের স্বার্থে কোটি কোটি ডলার ব্যয় করছে। তবে এটা ঠিক, পরিবেশ নিয়ে উদ্বেগ ও যানজটের অবনতিশীল অবস্থায় তাদের অবস্থান দিন দিন দুর্বল হচ্ছে।

রেলের উন্নয়নে শত শত কোটি ডলার বিনিয়োগ
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন রেলপথ উন্নয়নে ১৭ হাজার কোটি ডলারের পাশাপাশি অবকাঠামো উন্নয়নে ১ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন ডলার বরাদ্দ দিয়েছেন। আমট্রাকের বোস্টন, নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটনের মধ্যে সংযোগকারী উত্তর–পূর্ব করিডর (এনইসি) মেরামতে এখান থেকে কিছু বিনিয়োগ করা হবে।

আন্তনগর ও রাজ্যের মধ্যে নাগরিকদের দ্রুত ও টেকসই ভ্রমণের স্বার্থে দেশের অন্যান্য শহরে যাত্রীবাহী ট্রেন ফিরিয়ে আনার বড় পরিকল্পনা রয়েছে। কয়েক দশক আগেও এসব অঞ্চল ও শহরে ট্রেন যোগাযোগ ছিল। এর মধ্যে রয়েছে বেসরকারি বিনিয়োগে তৈরি ফ্লোরিডার ব্রাইটলাইন। ২০২৭ সালের মধ্যে ফ্লোরিডার সঙ্গে লস অ্যাঞ্জেলেস ও লাস ভেগাসের উচ্চগতির রেললাইন নির্মাণ করা হবে। ক্যালিফোর্নিয়া, টেক্সাসের মধ্যেও এমন পরিকল্পনা রয়েছে। প্রস্তাবিত ক্যাসকাডিয়া রুটের আওতায় পোর্টল্যান্ড, অরেগন, সিয়াটল ও ভ্যাঙ্কুবারের মধ্যে রেল যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করা হবে। অবশেষে এসব পরিকল্পনা দেখে মনে হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে যাত্রীবাহী ট্রেনে বিপ্লব হতে যাচ্ছে।

ফ্রান্সে উচ্চগতির ইউরোস্টার ট্রেন
ফাইল ছবি: রয়টার্স

বড় বিনিয়োগ
ট্রেন প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান অ্যাল্সটম ইউএস ডিভিশনের প্রধান বাণিজ্য কর্মকর্তা স্কট শেরিন বলেন, প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান থেকে প্রত্যেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়নের কথা বলেছেন। কিন্তু তাঁরা সব সময় কাজ করেছেন অন্য কোনো বিষয় নিয়ে। তবে এখন খুব গুরুত্ব দিয়ে সবাই এগোচ্ছে। একটা আশাবাদ তৈরি হয়েছে। যাত্রীবাহী ট্রেনের উন্নয়নে কাজ করার এখনই সময়।

শেরিন বলেন, মহাসড়ক ও আকাশপথের মতো সরকারি সেবায় ব্যাপক ভর্তুকি দেওয়া হয়। ট্রেনের ক্ষেত্রেও সরকার ভর্তুকি দেওয়া উচিত। তিনি বলেন, উচ্চগতির ট্রেন সবকিছুর সমাধান নয়। কিন্তু এর একটা অবস্থান আছে।

ট্রেনের নতুন প্রজন্ম
আমট্রাক চলতি বছর এনইসিতে মেয়াদোত্তীর্ণ এইসলাসের বদলে নতুন প্রজন্মের আভেলিয়া লিবার্টি ট্রেন চালুর পরিকল্পনা করছে। এনইসির রেলপথে সর্বোচ্চ ১৬০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চালানো যায়। তবে ২২০ কিলোমিটার গতিসম্পন্ন উচ্চগতির ট্রেন নামানো হচ্ছে এই রুটে।

নিউইয়র্ক রাজ্যের হর্নেল শহরের সাবেক মেয়র শান ডি হোগান বলেন, ২০১৫–১৬ সালে যখন অ্যাল্সটমকে আমট্রাক কাজ দিয়েছিল, তখন হর্নেলে কোম্পানির প্রায় ২০০ কর্মী ছিল। এখন এই সংখ্যা প্রায় ৯০০। ২০১৬ সাল থেকে এই শহরে হোটেল, হাসপাতাল, আবাসন ইত্যাদি খাতে সরকারি–বেসরকারি পর্যায়ে প্রচুর বিনিয়োগ হয়েছে।

সাবেক মেয়র বলেন, গ্রামীণ আমেরিকায় যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে, পুরো দেশে তা হতে পারে।

অ্যাল্সটম উচ্চগতির ট্রেন সরবরাহে প্রায় ৬০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। প্রায় ৮০ ভাগ ট্রেন তৈরি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। ইতিমধ্যে ২৭ অঙ্গরাজ্যে ১৭০টি ট্রেন সরবরাহ করা হয়েছে।

শেরিন বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে ইতিমধ্যে উচ্চগতির ট্রেন আছে। আভেলিয়া লিবার্টির নকশা করা হয়েছে আমাদের ইউরোপীয় সহকর্মীদের নিয়ে। সুতরাং টিজিভি–ইউএসএর জন্য যা যা দরকার, তা আমাদের আছে। বিদ্যমান ট্রেন প্রযুক্তির মধ্যে এটি প্রমাণিত প্রযুক্তি। অবকাঠামো হয়ে গেলে আমরা ট্র্যাকে নামতে প্রস্তুত।’

ক্যালিফোর্নিয়ায় আরেকটি প্রকল্প
সান জোয়াকুইন ভ্যালির মধ্য দিয়ে আরেকটি উচ্চগতির রেললাইন নির্মাণের কাজ চলছে। ২০৩০ সাল নাগাদ মার্সিড থেকে ব্যাকার্সফিল্ড পর্যন্ত (১৭১ মাইল) ২২০ মাইল গতিতে এই ট্রেন চলবে। এই প্রকল্পের আওতায় লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে সান ফ্রান্সিসকো নগর পর্যন্ত আরেক লাইনে ৩৫০ মাইল বেগে ছুটবে আরেকটি ট্রেন। উচ্চগতির ট্রেনে এই দুই নগরের মধ্যে যাতায়াতে ২ ঘণ্টা ৪০ মিনিট লাগবে।

সিএইচএসআর নামের এই প্রকল্প ১৯৯৬ সালে প্রথম টেবিলে এসেছিল। তবে এর বাস্তবায়ন নিয়ে তখন বিতর্ক উঠেছিল। প্রকল্পের চূড়ান্ত সম্প্রসারণের ওপর ভিত্তি করে ৬ হাজার ৩০০ কোটি থেকে থেকে ৯ হাজার ৮০০ কোটি ডলার ব্যয় ধরা হচ্ছে। সিএইচএসআর প্রকল্পের আওতায় বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পে অঙ্গরাজ্যের ৬ থেকে ১০টি বৃহত্তম শহরকে সংযুক্ত করা হবে।

শেরিন বলছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র এখনো দেশব্যাপী উচ্চগতির রেল নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। গত কয়েক দশকে মহাসড়কে যাতায়াত খুব বেশি কষ্টদায়ক ছিল না। তবে এখন মহাসড়কে যানজটে কষ্ট বাড়ছে। এখন আমাদের বিকল্প ভাবনার সময় এসেছে।