ইউরোপের প্রতি কেন এতটা ক্ষুব্ধ ট্রাম্প, এতে লাভ হচ্ছে কার
রাশিয়ার মস্কোয় গত সপ্তাহে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতিনিধিরা ইউক্রেন শান্তিচুক্তি–সংক্রান্ত আলোচনায় তেমন অগ্রগতি করতে পারেননি। তবে একটি বিষয় পরিষ্কার যে ওয়াশিংটন ও ইউরোপের মধ্যে দূরত্ব যত গভীর হচ্ছে, তা রাশিয়ার জন্যই লাভজনক হয়ে উঠছে।
গতকাল মঙ্গলবার মার্কিন সংবাদমাধ্যম পলিটিকোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প আবারও ইউরোপের সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেন, ইউরোপ তাদের অভিবাসন নীতির কারণে ‘দুর্বল’ হয়ে পড়ছে। অঞ্চলটি ক্রমেই পতনের দিকে যাচ্ছে।
ট্রাম্প আরও বলেন, ইউক্রেনে যুদ্ধের ক্ষেত্রে রাশিয়া সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। তিনি মনে করেন, যুদ্ধ বন্ধের জন্য এখন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকেই এগিয়ে আসতে হবে। তাঁকেই ‘বিভিন্ন বিষয় মেনে নেওয়া শুরু’ করতে হবে। কারণ, তিনি পরাজিত হতে যাচ্ছেন।
যুক্তরাষ্ট্র গত সপ্তাহে নতুন জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল প্রকাশ করেছে। সেখানে ইউক্রেনকে সমর্থন করার জন্য ইউরোপীয় দেশগুলোর সরকারের সমালোচনা করা হয়েছে। নথিতে বলা হয়েছে, ‘ইউরোপীয় কর্মকর্তারা যুদ্ধ নিয়ে বাস্তববাদী নন, তাঁরা শান্তিচুক্তির পথে বাধা তৈরি করছেন।’
নথিতে আরও বলা হয়েছে, বেশির ভাগ ইউরোপীয় মানুষ শান্তি চান। কিন্তু সে আকাঙ্ক্ষাটুকু নীতিতে রূপান্তর করা হয় না।
গতকাল জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মের্ৎস নিরাপত্তা কৌশলটির সমালোচনা করেছেন। এদিন এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘এর (নিরাপত্তা কৌশল) কিছু অংশ বোঝা যায়, কিছু অংশ গ্রহণযোগ্য, আর কিছু অংশ আমাদের জন্য ইউরোপীয় দৃষ্টিকোণ থেকে গ্রহণযোগ্য নয়।’
ফ্রিডরিখ আরও বলেন, ইউরোপের গণতন্ত্র রক্ষা করতে ইউরোপীয় দেশগুলোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্যের প্রয়োজন নেই।
রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের স্থিতিশীল সম্পর্কের পথে ইউরোপকে একটি অগণতান্ত্রিক বাধা হিসেবে দেখাতে চাইছে ট্রাম্প প্রশাসন। আর তা রাশিয়ার কর্মকর্তাদের জন্য আশীর্বাদ হয়েছে।
রাশিয়ার ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট ফান্ডের (ডিআইএফ) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কিরিল দিমিত্রিয়েভ এই সুযোগকে কাজেও লাগিয়েছেন। তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে একাধিক পোস্ট দিয়েছেন। তিনি ইউরোপকে নিয়ে ট্রাম্পের সমালোচনাগুলোকে সামনে নিয়ে এসেছেন।
ইউরোপীয় অনলাইন কনটেন্ট বিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে ইউরোপীয় নিয়ন্ত্রকেরা গত শুক্রবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সকে ১৪ কোটি ডলার জরিমানা করেছে। এ নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে ট্রাম্প ইউরোপকে নিয়ে নানা সমালোচনা করেন।
জরিমানা করার প্রতিক্রিয়ায় এক্সের মালিক ইলন মাস্ক ইউরোপীয় ইউনিয়নকে ‘বিলুপ্ত’ করার আহ্বান জানিয়ে পোস্ট দিয়েছেন।
ইউরোপীয়রা গণতন্ত্র চর্চার দিক থেকে পিছিয়ে পড়ছে বলে ট্রাম্প প্রশাসন যে অভিযোগ তুলেছে, তাকে রাশিয়ার কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে জোরালোভাবে উপস্থাপন করাটা একটু হাস্যকরই বলা চলে। কেননা, দীর্ঘ সময় ধরে রাশিয়ার ক্ষমতায় থাকাকালে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রায় সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত করেছেন।
সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাকেও নাই করে দিয়েছেন পুতিন। তার ওপর রাশিয়া কার্যত ফেসবুক ও এক্সের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোয় প্রবেশাধিকার বন্ধ করে রেখেছে। অথচ দিমিত্রিয়েভের মতো প্রভাবশালী রুশ কর্মকর্তারা ইংরেজিতে নিজেদের বক্তব্য ছড়িয়ে দিতে এসব প্ল্যাটফর্মই ব্যবহার করেন।
মনে হচ্ছে এখানে রাশিয়ার একটি পরিকল্পিত কৌশল আছে। তারা ইউক্রেনের প্রতি ইউরোপের সমর্থন কমাতে চাচ্ছে এবং ন্যাটো জোটের শক্তি নিয়ে সন্দেহ তৈরি করছে। ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন নিরাপত্তা কৌশল মস্কোকে তথ্যযুদ্ধের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মানুষের মনোভাব প্রভাবিত করতে পারার মতো সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে।
এদিকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ইউরোপীয় নেতাদের সমর্থন দৃঢ় করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। একই সময়ে ইউরোপকে উদ্দেশ করে রুশ সতর্কবার্তার সুর আরও জোরালো হচ্ছে।
রুশ রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কট্টরপন্থী রুশ রাজনীতি বিশ্লেষক সের্গেই কারাগানভ বলেন, ‘রাশিয়া ইউরোপের সঙ্গে যুদ্ধ করছে, কোনো দুর্দশাগ্রস্ত, করুণ অবস্থায় থাকা, ভুল পথে চালিত ইউক্রেনের সঙ্গে নয়।’
কারাগানভের দাবি, তিনি পুতিনের হয়ে কথা বলেন না, তাই নির্দ্বিধায় নিজের মত জানাতে পারেন। তিনি বলেন, ‘এই যুদ্ধ শেষ হবে না, যতক্ষণ না আমরা ইউরোপকে নৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে পরাজিত করতে পারছি।’
তবে কারাগানভ রুশ সরকারের হয়ে কথা না বললেও এটা পরিষ্কার যে তিনি আসলে পুতিনেরই হুমকির ভাষারই পুনরাবৃত্তি করছেন।
গত সপ্তাহে মস্কোয় ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ ও জামাতা জারেড কুশনারের সঙ্গে সাক্ষাতের আগেই পুতিন সতর্ক করে বলেছিলেন, এখনই ইউরোপের সঙ্গে যুদ্ধ করার মতো প্রস্তুতি রাশিয়ার আছে। তবে দেশটি যুদ্ধ শুরুর পরিকল্পনা করছে না।
পুতিন বলেন, ‘আমরা ইউরোপের সঙ্গে যুদ্ধের পরিকল্পনা করছি না। আমি এ বিষয়ে শতবার কথা বলেছি। কিন্তু ইউরোপ যদি হঠাৎ আমাদের সঙ্গে যুদ্ধে জড়াতে চায় এবং যুদ্ধ শুরু করে, তাহলে বলব আমরা এখনই প্রস্তুত।’
এই হুমকির ভাষা কাকে উদ্দেশ করে বলা হচ্ছে, তা স্পষ্ট। ক্রেমলিন চাচ্ছে ইউরোপীয়রা আতঙ্কিত হোক। কারণ, এসব কথা তাদের ট্রান্স–আটলান্টিক সম্পর্ককে নড়বড় করে দিচ্ছে।