যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু থেকে শত্রু হলো যেভাবে ভেনেজুয়েলা

ভেনেজুয়েলা ঘিরে অবস্থান নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীফাইল ছবি: রয়টার্স

ভেনেজুয়েলা সফরে গিয়ে মবের শিকার হয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন। সময়টা ১৯৫৮ সালের মে মাস। ভেনেজুয়েলার ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরশাসককে যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় দেওয়ার কারণে ব্যাপক চটেছিল লাতিন আমেরিকার দেশটির মানুষ। তবে কোনো ক্ষতি ছাড়াই সেবার সফর শেষ করতে পেরেছিলেন নিক্সন।

ভেনেজুয়েলা তখন গণতন্ত্রের উত্তরণের পথে ছিল। মবের ওই ঘটনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে ভেনেজুয়েলার কমিউনিস্টদের ওপর দায় চাপান নিক্সন। ওয়াশিংটনের বিশেষ নজরে আসে কারাকাস। এর পর থেকে দুই দেশের চার দশক ধরে উষ্ণ সম্পর্ক ছিল। তবে ভেনেজুয়েলায় নাটকীয় রাজনৈতিক পরিবর্তনের কারণে গত ২৫ বছরে সেই সম্পর্কে ভাটা পড়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ব্রিয়ান ফনসেকা বলেন, বিশ শতকের শেষের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভেনেজুয়েলার ব্যাপক বোঝাপড়া ছিল। এই সম্পর্কের পেছনে ওয়াশিংটনের উদ্দেশ্য ছিল ভেনেজুয়েলার বিশাল জ্বালানি তেলের ভান্ডার এবং স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে দ্বন্দ্ব।

যা হোক, ষাটের দশকে ভেনেজুয়েলার নতুন সরকার ছিল কমিউনিস্টবিরোধী। বন্ধু হিসেবে ভেনেজুয়েলার কাছে অস্ত্র বিক্রি শুরু করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। এর বিনিময়ে দেশটি থেকে তেল উত্তোলন শুরু করে মার্কিন কোম্পানিগুলো। তবে ভেনেজুয়েলার তেল নিয়ে মার্কিন স্বার্থে বড় আঘাত আসে কয়েক বছর পর। তখন নিজেদের তেল খাতকে রাষ্ট্রীয়করণ করেছিল কারাকাস।

এরপরও ওপেকের সদস্য হিসেবে ভেনেজুয়েলার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রেখেছিল যুক্তরাষ্ট্র। অধ্যাপক ব্রিয়ান ফনসেকা বলেন, কৌশলগত স্বার্থের কারণে যুক্তরাষ্ট্র প্রায়ই ভেনেজুয়েলার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুর্বলতাকে এড়িয়ে যেত। ভেনেজুয়েলা সরকারের প্রতি অনুরাগের কারণে দেশটির দুর্নীতি বা মানবাধিকার নিয়ে ততটা চিন্তিত ছিল না ওয়াশিংটন।

১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর লাতিন আমেরিকার প্রতি আগ্রহ কমে যায় মার্কিনদের। তবু ভেনেজুয়েলা তাদের গুরুত্বপূর্ণ তেল সরবরাহকারী হিসেবে থেকে যায়। কিন্তু এই সময়টাতে ওয়াশিংটনে খুব কম মানুষই বামপন্থী বিপ্লবী হুগো শাভেজের উত্থানের দিকে নজর দিয়েছিল। ১৯৯৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচনে জয় পান তিনি।

তবে ২০০২ সালে শাভেজকে উৎখাতের এক ব্যর্থ চেষ্টা সবকিছু বদলে দেয়। তিনি অভিযোগ করেন, যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ প্রশাসন তাঁকে উৎখাতের চেষ্টা করেছিল। হোয়াইট হাউস তা অস্বীকার করলেও ২০০৪ সালে অবমুক্ত নথিতে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্র আগে থেকেই ওই ষড়যন্ত্রের কথা জানত।

২০০৭ সালে শাভেজ ভেনেজুয়েলার তেলশিল্পে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ পুনর্বহাল করেন। বিদেশি কোম্পানিগুলোকে রাষ্ট্রায়ত্ত তেল কোম্পানির অধীনে আসতে বাধ্য করা হয়। এই পদক্ষেপগুলো দেশে জনপ্রিয় হয় এবং শাভেজের ক্ষমতা আরও পোক্ত করে। ২০১৩ সালের মার্চে তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর শিষ্য নিকোলা মাদুরো একই নীতি চালু রাখেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভেনেজুয়েলার বিচ্ছিন্নতা বাড়তে থাকে।

এখন ট্রাম্পের আমলে উত্তেজনা চরমে। ট্রাম্প দাবি করেন, অভিবাসন ও মাদক পাচারে ভেনেজুয়েলার ভূমিকা যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি। মাদুরোর পতন চান তিনি। ভেনেজুয়েলায় আক্রমণ করতে যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তুত বলেও মনে হচ্ছে। ৫০ বছর আগে নিক্সন যখন ভেনেজুয়েলায় মবের মুখে পড়েছিলেন, তখনো এমন প্রস্তুতি নিয়েছিল ওয়াশিংটন। এবার কী হয়, তা সামনের দিনগুলোতেই বোঝা যাবে।