গাজায় জাতিসংঘ কেন এত অক্ষম, এত অসহায়

গাজা সিটির বাসিন্দারা নিজেদের মালপত্র নিয়ে গাজা উপত্যকার দক্ষিণে চলে যাচ্ছেন। নুসেইরাত শরণার্থীশিবিরের কাছাকাছি উপকূলীয় সড়ক, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫ছবি: এএফপি

১৯৫৬ সাল। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো জাতিসংঘের সশস্ত্র শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করা হয়। তাদের গন্তব্য ছিল মিসরের নিয়ন্ত্রণে থাকা সিনাই উপদ্বীপ ও গাজা উপত্যকা। আর পাঠানোর কারণ, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ইসরায়েল মিলে মিসরের সুয়েজ খাল আক্রমণ করেছিল।

এখন ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলের হত্যাযজ্ঞ চলছে এবং জাতিসংঘের ৮০তম সাধারণ অধিবেশন সামনে। ফলে প্রশ্ন উঠছে, জাতিসংঘ এখন গাজায় কী করতে পারে কিংবা কেন কিছুই করছে না?

যদিও সুয়েজ সংকট ও বর্তমান গাজা পরিস্থিতি আলাদা। তবু ১৯৫৬ সালের জাতিসংঘ জরুরি বাহিনীর অভিজ্ঞতা এটাই দেখায়, জাতিসংঘ চাইলে কীভাবে ভূমিকা রাখতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের গাজা দখল অভিযানে নিঃশর্ত সমর্থন দিয়েছে। ক্রমেই বেশিসংখ্যক আইনজ্ঞ ও গবেষক বলছেন, ইসরায়েলের এমন কর্মকাণ্ড জাতিহত্যা। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্র অন্তত ছয়বার ভেটো দিয়েছে। সর্বশেষ শুক্রবারও; যাতে নরকে পরিণত হওয়া গাজায় যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠা বা মানবিক সাহায্যের পথ খোলার প্রস্তাব পাস না হয়।

তবে ১৯৫৬ সালেও নিরাপত্তা পরিষদ অচল হয়ে পড়েছিল। কারণ, তখনকার দুই আগ্রাসী দেশ ব্রিটেন ও ফ্রান্স ভেটো ক্ষমতা রাখত। ওই সময় জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ১৯৫০ সালের ‘ইউনাইটিং ফর পিস’ প্রস্তাব ব্যবহার করে সশস্ত্র শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠায়।

জাতিসংঘ সনদের অধ্যায়-৭ অনুযায়ী, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ শান্তিরক্ষী মোতায়েন বা নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।

তবে তখন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনও বড় ভূমিকা রেখেছিল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোয়াইট ডি আইজেনহাওয়ার ব্রিটেন-ফ্রান্স-ইসরায়েলের মিসর আক্রমণের বিরোধিতা করেছিলেন।

যদিও সুয়েজ সংকট ও বর্তমান গাজার পরিস্থিতি আলাদা। তবু ১৯৫৬ সালের জাতিসংঘ জরুরি বাহিনীর অভিজ্ঞতা এটাই দেখায়, জাতিসংঘ চাইলে কীভাবে ভূমিকা রাখতে পারে।

জাতিসংঘ তখন একজন বলিষ্ঠ মহাসচিবও পেয়েছিল—দ্যাগ হ্যামারশোল্ডকে। তিনি জোটভুক্ত নয়, এমন দেশগুলোকে শান্তিরক্ষী পাঠাতে রাজি করাতে সক্ষম হন। মিসরও স্বেচ্ছায় তা গ্রহণ করে।

কিন্তু কূটনীতিক ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র আজ গাজাকে আন্তর্জাতিক ইস্যু করতে মোটেই রাজি নয়।

আজকের শিক্ষাটা হলো, সাধারণ পরিষদ চাইলে নিরাপত্তা পরিষদকে পাশ কাটাতে পারে। তবে দিন শেষে জাতিসংঘ কার্যকর হয় শুধু তখনই, যখন সদস্যরাষ্ট্রগুলো রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেখায়।

নিউইয়র্ক সিটিতে জাতিসংঘ সদর দপ্তরের সামনে ফিলিস্তিনপন্থীদের বিক্ষোভ। ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫
ছবি: এএফপি

জাতিগত নিধন

জাতিগত নিধন বন্ধে জাতিসংঘের সদস্যদেশগুলোর সম্মিলিত রেকর্ড একেবারেই ভালো নয়।

রুয়ান্ডা ও বসনিয়ায় জাতিগত নিধনের ক্ষেত্রে জাতিসংঘ শুধু ঘটনার পর আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেছিল যে সেখানে জাতিগত নিধন হয়েছে।

রুয়ান্ডার ক্ষেত্রে কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ার বিষয়টি বিশেষভাবে চোখে পড়েছিল। তখন দেশটিতে অবস্থানকারী জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনের কমান্ডার রোমিও ড্যালেয়ার বারবার সতর্ক করেছিলেন, জাতিগত নিধনের ঘটনা ঘটতে চলেছে। তবে এ ব্যাপারে জাতিসংঘ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।

গাজায় জাতিগত নিধন ও আধুনিক ইতিহাসের অন্যান্য জাতিগত নিধনের ঘটনার মধ্যে এটি (যুক্তরাষ্ট্রের প্রচ্ছন্ন অংশগ্রহণ) মূল পার্থক্যের জায়গা।
—মার্টিন শ, সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক

ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাসের নেতৃত্বে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর দক্ষিণ ইসরায়েলে হামলা হয়। জবাবে সেদিন থেকেই গাজা উপত্যকায় হামলা শুরু করেছে ইসরায়েল। তখন থেকে এ পর্যন্ত ইসরায়েলের হামলায় অন্তত ৬৫ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। তাঁদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু।

ইসরায়েলি হামলায় গাজা উপত্যকা প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। বোমা হামলা ও ফিলিস্তিনি বাড়িঘর ধ্বংস করার বিষয়ে ইসরায়েলের অর্থমন্ত্রী প্রকাশ্যে গর্ব করেছেন। গাজার বাড়িঘরকে ধ্বংস করে দেওয়ার মধ্য দিয়ে আবাসিক খাতের উন্নয়ন ও গাজা পুনর্গঠনের পথ পরিষ্কার করছে ইসরায়েল।

জাতিসংঘের ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল–বিষয়ক সর্বোচ্চ তদন্ত সংস্থা গত মঙ্গলবার ঘোষণা দিয়েছে, গাজায় জাতিগত নিধনের ঘটনায় ইসরায়েল দোষী।

সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক এবং ‘জাতিগত নিধন’–সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ মার্টিন শ বলেছেন, গাজায় জাতিগত নিধন ও আধুনিক ইতিহাসের অন্যান্য জাতিগত নিধনের ঘটনার মধ্যে এটি (যুক্তরাষ্ট্রের প্রচ্ছন্ন অংশগ্রহণ) মূল পার্থক্যের জায়গা।

এ সপ্তাহে সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ফিলিস্তিন প্রশ্নে আলোচনা হবে। তবে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদেশ ফ্রান্স ও সৌদি আরব সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগটি নেবে। ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য সদস্যরাষ্ট্রগুলোকে উদ্বুদ্ধ করবে তারা।

মার্টিন শ মিডল ইস্ট আইকে বলেন, গাজা আলাদা। এখানে জাতিগত নিধন হয়েছে বলে স্বীকার করতে জাতিসংঘ যে দেরি করেছে, তা নয়। এটা সত্যি, অস্ত্রশস্ত্র ও রাজনৈতিক সহায়তার মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কার্যত অংশীদারের ভূমিকায় (জাতিগত নিধনের ক্ষেত্রে) থেকেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, দুটি কারণে জাতিসংঘ গাজায় জাতিগত নিধন বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছে। এ ছাড়া এখন ছোট–বড় দেশগুলোর মধ্যে বিদেশে হস্তক্ষেপ করার আগ্রহ কম।

ইসরায়েলের হামলায় গাজা উপত্যকা অনেকটাই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে
ফাইল ছবি: রয়টার্স

২০০০-এর দশকের শুরুর দিকে দারফুরে এমনটাই হয়েছিল। তখন সুদান সরকার ও তাদের মিত্র হিসেবে পরিচিত আরব মিলিশিয়া গোষ্ঠী জাঞ্জাউইদ অনারব জাতিগোষ্ঠীর মানুষকে হত্যা করেছিল।

গাজায় ইসরায়েলি নৃশংসতার দায় জাতিসংঘের নয়; বরং ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ সমর্থক যুক্তরাষ্ট্রের। জাতিসংঘের নিজস্ব কোনো বাহিনী নেই। এটি রুয়ান্ডার জাতিগত হত্যা, সুদানের গণহত্যা বা লাইবেরিয়ার হত্যাযজ্ঞ থামাতে পারেনি। তাই গাজায় যা চলছে, তা জাতিসংঘ একা থামাতে পারবে বলে আশা করার কোনো কারণ নেই।
—ডাগ ব্যান্ডো, গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ক্যাটো ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ ফেলো

তখন যুক্তরাষ্ট্র খুব দ্রুতই স্বীকার করেছিল যে দারফুরে জাতিগত নিধনের ঘটনা ঘটছে। ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বরে তারা এ–সংক্রান্ত একটি বিবৃতি দিয়েছিল। এরপর এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ কমে যায়। তারা দারফুরের ঘটনায় হস্তক্ষেপ করা বন্ধ করেনি, আবার জাতিগত নিধন বন্ধে সহযোগিতাও করেনি।

২০০৪ সালের শেষ নাগাদ আফ্রিকান ইউনিয়ন কয়েক শ শান্তিরক্ষী মোতায়েন করে। পরে ২০০৬ সালে নৃশংসতার মাত্রা কমার আগপর্যন্ত জাতিসংঘ আনুষ্ঠানিকভাবে শান্তি রক্ষা মিশন সেখানে পাঠানোর অনুমোদন দেয়নি।

বিভক্ত সাধারণ পরিষদ

ফরাসি গবেষণা সংস্থা সেন্টার তুসিদিদের জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা–বিষয়ক বিশেষজ্ঞ আলেক্সান্দ্রা নোভোসেলফ মিডল ইস্ট আইকে বলেন, জাতিগত নিধন ও তা মোকাবিলায় জাতিসংঘের চেষ্টা–সংক্রান্ত পূর্ববর্তী নজিরগুলো জাতিরাষ্ট্রের গুরুত্বকে তুলে ধরে।

নোভোসেলফ মনে করেন, এটা সংস্থা হিসেবে জাতিসংঘের ব্যর্থতা নয়; বরং তা জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্রগুলোর ব্যর্থতা। জাতিসংঘের বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে। তারা নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে, শান্তি রক্ষা অভিযান চালাতে ইচ্ছুক দেশগুলো নিয়ে একটি জোট গঠন করতে পারে।

নোভোসেলফ আরও বলেন, গাজা শহরে ইসরায়েলের ধ্বংসাত্মক হামলা বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সদস্যদেশগুলোর মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।

এ সপ্তাহে সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ফিলিস্তিন প্রশ্নে আলোচনা হবে। তবে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদেশ ফ্রান্স ও সৌদি আরব সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগটি নেবে। ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য সদস্যরাষ্ট্রগুলোকে উদ্বুদ্ধ করবে তারা।

নোভোসেলফ বলেন, ‘এটা ঠিক যে নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের ভেটো দেওয়ার হুমকির কারণে গাজা–সংক্রান্ত পদক্ষেপগুলো এগিয়ে নেওয়া যাচ্ছে না। তবে আপনাদের তো সাধারণ পরিষদও আছে। এখন পর্যন্ত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার মতো কোনো প্রস্তাব সেখানে জমা পড়েনি। সাধারণ পরিষদ বিভক্ত।’

তবে ইতিহাস থেকে একটা শিক্ষা নেওয়ার আছে। তা হলো মহাশক্তিধর দেশগুলো সামরিক শক্তি ব্যবহার করে হস্তক্ষেপ না করলে জাতিগত নিধনের ঘটনা মোকাবিলা করাটা জাতিসংঘের একার জন্য খুবই কঠিন।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বসনিয়ায় ১৯৯৫ সালে স্রেব্রেনিৎসা হত্যাযজ্ঞের পর যুক্তরাষ্ট্র হস্তক্ষেপ শুরু করে। জাতিসংঘ এর আগেই সার্বিয়ার ওপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। তবে তা করেও মুসলিম বসনীয়দের হত্যা করা ঠেকাতে পারেনি জাতিসংঘ।

আরও পড়ুন

১৯৯৫ সালে সার্বদের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা খ্রিষ্টান ক্রোয়েশীয় ও মুসলিম বসনীয়দের কাছে অস্ত্র সরবরাহ শুরু করে। এরপর ন্যাটো জোট নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন নিয়ে সার্বিয়ার ওপর বিমান হামলা শুরু করে।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ক্যাটো ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ ফেলো ডাগ ব্যান্ডো বলেন, গাজায় ইসরায়েলি নৃশংসতার দায় জাতিসংঘের নয়; বরং ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ সমর্থক যুক্তরাষ্ট্রের। তিনি বলেন, জাতিসংঘের নিজস্ব কোনো বাহিনী নেই। এটি রুয়ান্ডার জাতিগত হত্যা, সুদানের গণহত্যা বা লাইবেরিয়ার হত্যাযজ্ঞ থামাতে পারেনি। তাই গাজায় যা চলছে, তা জাতিসংঘ একা থামাতে পারবে বলে আশা করার কোনো কারণ নেই।

ডাগ ব্যান্ডো আরও বলেন, গাজা পরিস্থিতির দায় প্রায় পুরোপুরি যুক্তরাষ্ট্রের। দেশটি ইসরায়েলকে অস্ত্রের জোগান ও সমর্থন দিয়ে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র প্রথমত ইসরায়েলকে অর্থায়ন করে এবং দ্বিতীয়ত, জাতিসংঘকে পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে বাধা দেয়।

আরও পড়ুন