ভয়াবহ দাবানলে জ্বলছে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া। যুক্তরাষ্ট্রের এই অঙ্গরাজ্যে নিয়মিতই দাবানল দেখতে পাওয়া যায়। যদিও গত কয়েক দশকে দাবানলের মৌসুম দীর্ঘায়িত হয়েছে। এর কারণ হিসেবে দেশটির পরিবেশ সুরক্ষা সংস্থা বলেছে, গ্রীষ্মের শুষ্ক মৌসুম লম্বা হওয়া এবং বসন্তের অপেক্ষাকৃত উষ্ণ আবহাওয়ার কারণে মৌসুমের আগেই দাবানল দেখা দিচ্ছে।
৮৫ শতাংশ ক্ষেত্রে দাবানলের কারণ মানুষ বলে জানিয়েছে ইউএস ফরেস্ট সার্ভিস। যদিও সেগুলোর বেশির ভাগই অনিচ্ছাকৃত। যেমন ক্যাম্পফায়ারের আগুন ঠিকমতো না নেভানো বা বৈদ্যুতিক তারের স্ফুলিঙ্গ থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়ে দাবানলের সৃষ্টি হয়। গত কয়েক দশকে দ্রুত নগরায়ণ ও প্রকৃতির গভীরে মানুষের বসতি স্থাপনকে এ জন্য দায়ী করা হয়েছে। ক্যালিফোর্নিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ১০ দাবানলের ৮টিই গত ৫ বছরে হয়েছে। পুড়ে যাওয়া ভূমির আয়তনের দিক দিয়ে ক্যালিফোর্নিয়ায় সবচেয়ে বড় ১০ দাবানল সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।
২০২০ সালের ১৬ ও ১৭ আগস্ট বজ্রপাত থেকে সূত্রপাত হয়েছিল ক্যালিফোর্নিয়ার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দাবানলের। ৩৮টি আলাদা আলাদা জায়গায় চার মাসের বেশি সময় ধরে এই দাবানল চলেছিল। পুড়ে গিয়েছিল ১০ লাখ ৩২ হাজার ৬০০ একর ভূমির গাছগাছালি ও স্থাপনা। এ দাবানল ছড়িয়েছিল একাধিক দেশে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন হাজার হাজার মানুষ।
ওই দাবানল ক্যালিফোর্নিয়ার মেনডোসিনো, শাসটেয়া-ট্রিনিটি এবং সিক্স রিভার্স জাতীয় উদ্যানজুড়ে ছড়িয়েছিল। সাতটি অগ্নিনির্বাপণ দল ওই দাবানল নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। আগস্ট কমপ্লেক্সে লাখ লাখ একর ভূমির গাছগাছালি ও স্থাপনা পুড়ে গেলেও মানুষ হতাহতের সংখ্যা কম ছিল। সেবার অগ্নিনির্বাপণ বাহিনীর একজন কর্মী দাবানল নেভাতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন। আর একজন আহত হয়েছিলেন। ৯৩৫টি অবকাঠামো পুড়ে যায়। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় ৩২ কোটি মার্কিন ডলার।
২০২১ সালে ডিক্সি দাবানলে ৯ লাখ ৬৩ হাজার ৩০৯ একর ভূমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ক্ষয়ক্ষতির আর্থিক পরিমাণ ছিল ৬৩ কোটি ৭০ লাখ মার্কিন ডলারের বেশি। ক্যালিফোর্নিয়ার ইতিহাসে দাবানলে এত বেশি আর্থিক ক্ষতি আর হয়নি। বিদ্যুৎ সরবরাহের তারের ওপর গাছ পড়ে আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল। ১০৫ দিন ধরে চলেছিল এই দাবানল। পুড়ে গিয়েছিল ১ হাজার ৩২৯টি অবকাঠামো। আগুন নেভাতে গিয়ে অগ্নিনির্বাপণ বাহিনীর এক সদস্য মারা যান এবং তিনজন আহত হন। তবে কোনো বেসামরিক মানুষ প্রাণ হারাননি।
ক্যালিফোর্নিয়ার উত্তরাঞ্চলে ২০১৮ সালে একই সময়ে শুরু হওয়া দুটি দাবানলকে একত্রে মেনডোসিনো কমপ্লেক্স বলে। ওই দুই দাবানলের নাম ছিল রিভার ফায়ার ও র্যাঞ্চ ফায়ার। ২৭ জুলাই প্রথম দাবানলের খবর প্রকাশ পায়। ১৮ সেপ্টেম্বর দাবানল দুটি নিয়ন্ত্রণে আসে। যদিও ওই আগুন পুরোপুরি নিভতে পরের বছর জানুয়ারি পর্যন্ত সময় গড়িয়েছিল। দুই দাবানলে মোট ৪ লাখ ৫৯ হাজার ১২৩ একর জমির ক্ষতি হয়। দাবানলে একজন নিহত এবং তিনজন আহত হন।
এসসিইউ (স্যান্টা ক্লারা ইউনিট) লাইটনিং কমপ্লেক্সের নাম থেকেই এই দাবানলের সূত্রপাত হওয়ার কারণ জানা যায়। ২০২০ সালের ১৬ আগস্ট বজ্রপাত থেকে ক্যালিফোর্নিয়ায় এই দাবানলের সূত্রপাত হয়েছিল। ১ অক্টোবর দাবানল নিয়ন্ত্রণে আসে। দাবানলে স্যান্টা ক্লারা, আলামেডা, কন্ট্রা কোস্টা, সান জোয়াকুইন, মারসেড ও স্ট্যানিসলাউস কাউন্টির ৩ লাখ ৯৬ হাজার ৬২৪ একর ভূমির গাছগাছালি ও স্থাপনা পুড়ে গিয়েছিল। কেউ প্রাণ হারাননি, আহত হয়েছিলেন ৬ জন।
২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে দাবানলের মৌসুমে ক্যালিফোর্নিয়ার মধ্যাঞ্চলের সিয়েরা ন্যাশনাল ফরেস্ট এবং মাডেরা কাউন্টিতে ভয়াবহ দাবানল ছড়িয়ে পড়েছিল। ৪ সেপ্টেম্বর দাবানল শুরু হয়। কয়েক মাস ধরে জ্বলার পর ওই বছরের ২৪ ডিসেম্বর সেটি শতভাগ নিয়ন্ত্রণে আসার ঘোষণা দেওয়া হয়। মাঝে এই কয়েক মাসে পুড়ে যায় ৩ লাখ ৭৯ হাজার ৮৯৫ একর ভূমি। পুড়ে গিয়েছিল ৮৫৬টি অবকাঠামো। কেউ মারা যাননি, তবে আহত হয়েছিলেন ২৬ জন। কী কারণে আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল, তা জানা যায়নি।
২০২০ সালের ১৬ আগস্ট ভোর থেকেই ক্যালিফোর্নিয়ার উত্তরের বেশির ভাগ অঞ্চলজুড়ে অস্বাভাবিক বজ্রঝড় শুরু হয়েছিল। প্রায় ৭২ ঘণ্টা ধরে ওই ঝড় চলেছিল এবং ১০ হাজার ৮৪৯টি বজ্রপাতের খবর পাওয়া গিয়েছিল। ওই সব বজ্রপাতের কারণে ক্যালিফোর্নিয়াজুড়ে প্রায় ৩৭৬টি স্থানে ছোট–বড় দাবানলের সূত্রপাত হয়েছিল। এলএনইউ (সোনোমা-লেক-নাপা ইউনিট) লাইটনিং কমপ্লেক্স দাবানলে ৩ লাখ ৬৩ হাজার ২২০ একর ভূমি পুড়ে গিয়েছিল। প্রাণ হারিয়েছিলেন ছয় বেসামরিক নাগরিক। আহত হয়েছিলেন আরও পাঁচজন।
১৭ আগস্ট ২০২০ সালের বজ্রঝড়ের কারণে হওয়া বজ্রপাতে উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ার প্লুমাস জাতীয় উদ্যানের ২১টি জায়গায় আগুন জ্বলতে শুরু করে, যা একসময় ভয়াবহ এক দাবানলে পরিণত হয়। ক্যালিফোর্নিয়া অগ্নিনির্বাপণ অধিদপ্তর ওই দাবানলের নাম দেয় নর্থ কমপ্লেক্স ফায়ার। ১০৯ দিন ধরে জ্বলার পর সে বছর ৩ ডিসেম্বর এটি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসে। পুড়ে যায় ৩ লাখ ১৮ হাজার ৯৩৫ একর ভূমি। এই দাবানলে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ হতাহত হন। প্রাণ হারান ১৬ জন, আহত হয়েছিলেন শতাধিক মানুষ।
২০১২ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার সবচেয়ে বড় দাবানল ছিল এটি। লাসেন কাউন্টি থেকে এই দাবানল শুরু হয়েছিল। পরে সেটি নেভাদা অঙ্গরাজ্যের ওয়াশু কাউন্টিতে ছড়িয়ে পড়ে। দুই অঙ্গরাজ্য মিলিয়ে রাশ দাবানলে ৩ লাখ ১৫ হাজার ৫৭৭ একর ভূমি পুড়ে যায়। পুড়ে যাওয়া ভূমির আয়তন বিচারে ২০১২ সাল পর্যন্ত এটি ছিল ক্যালিফোর্নিয়ার ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ দাবানল। ১৯৩২ সাল থেকে ক্যালিফোর্নিয়ায় দাবানলের হিসাব রাখা শুরু হয়। ১২ আগস্ট শুরু হওয়া এই দাবানল ৩০ আগস্ট পর্যন্ত জ্বলেছিল।
২০১৭ সালের ডিসেম্বরে দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ায় জ্বলতে থাকা একাধিক দাবানলের একটি ছিল টমাস ফায়ার। টমাস ফায়ার ভেন্টুরা ও স্যান্টা বারবারা কাউন্টিজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল এই দাবানল। এতে পুড়ে গিয়েছিল প্রায় ২ লাখ ৮১ হাজার ৮৯৩ একর ভূমি। পরের বছর ১২ জানুয়ারি দাবানলটি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসে।
ক্যালিফোর্নিয়ার সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক দাবানলগুলোর একটি ছিল সিডার ফায়ার। ২০০৩ সালের অক্টোবর ও নভেম্বরে ওই দাবানলে ক্যালিফোর্নিয়ার সান ডিয়েগো কাউন্টির ২ লাখ ৭৩ হাজার ২৪৬ একর ভূমি পুড়ে গিয়েছিল। ঝোড়ো বাতাসের কারণে দাবানলটি খুব ছড়িয়েছিল। এটির গতি ছিল প্রতি ঘণ্টায় গড়ে ৩ হাজার ৬০০ একর। ওই বছর ৪ নভেম্বর দাবানলটি নিয়ন্ত্রণে আসে। কিন্তু তার আগে ধ্বংস করে ২ হাজার ৮২০টি অবকাঠামো। প্রাণ হারান ১৫ জন। তাদের মধ্যে একজন অগ্নিনির্বাপণ বাহিনীর সদস্য ছিলেন।
তথ্যসূত্র: ক্যালিফোর্নিয়া ডিপার্টমেন্ট অব ফরেস্টি অ্যান্ড ফায়ার প্রটেকশন