‘ভ্যাম্পায়ার ফেশিয়াল’ করে যেভাবে এইচআইভি সংক্রমিত হলেন তিন নারী

প্রতীকী ছবি

‘ভ্যাম্পায়ার ফেশিয়াল’ নেওয়ার পর কয়েকজন নারী এইচআইভিতে সংক্রমিত হয়েছেন। সম্প্রতি এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এই প্রতিবেদন প্রকাশের পর কিছু কসমেটিক পদ্ধতির নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি)-এর প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৮ সালে দেশটির নিউ মেক্সিকো অঙ্গরাজ্যের একটি স্পা সেন্টারে কমপক্ষে তিনজন নারী এইচআইভিতে সংক্রমিত হয়েছিলেন।

সিডিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, এসব ঘটনা এইচআইভিতে সংক্রমণ ছড়ানোর নতুন কারণ সামনে এনেছে।

আরও পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে নথিভুক্ত হওয়া তথ্যমতে, এই নারীরা প্রথম কসমেটিক পদ্ধতি নেওয়ার পর এইচআইভিতে সংক্রমিত হয়েছেন বলে মনে করা হয়।

কিন্তু ‘ভ্যাম্পায়ার ফেশিয়াল’ আসলে কী? এই ফেশিয়াল নেওয়ার পর নারীরা কীভাবে এইচআইভিতে সংক্রমিত হয়েছিলেন?

একই সঙ্গে প্রশ্ন উঠেছে, কসমেটিক চিকিত্সা নেওয়ার সময় লোকজন সংক্রমণ থেকে নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে ঠিক কী করতে পারেন?

এসব প্রশ্নের বিষয়ে যেসব তথ্য আছে, তা তুলে ধরেছে বিবিসি। পাশাপাশি বিশেষজ্ঞদের সুপারিশও তুলে ধরেছে সংবাদমাধ্যমটি।

ভ্যাম্পায়ার ফেশিয়াল কী

প্লাটিলেট রিচ প্লাজমা (পিআরপি) ফেশিয়ালের ক্ষেত্রে ‘ভ্যাম্পায়ার ফেশিয়াল’ শব্দদ্বয় ব্যবহার করা হয়।

এই পদ্ধতিতে রোগীর রক্ত নেওয়া হয়। একটি সেন্ট্রিফিউজ ব্যবহার করে রক্ত থেকে প্লাটিলেট রিচ প্লাজমা আলাদা করা হয়। এরপর ছোট সুইয়ের মাধ্যমে মুখমণ্ডলে ইনজেকশন দিয়ে প্লাজমা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়।

বলা হয়, পদ্ধতিটি নতুন কোলাজেন ও ইলাস্টিন উৎপাদনকে উদ্দীপিত করে। ত্বকের সবচেয়ে বাইরের স্তর মেরামত করতে সাহায্য করে। যা বলিরেখা ও ব্রণের দাগ কমাতে পারে।

পদ্ধতিটি নেওয়ার পর টেলিভিশনের রিয়েলিটি শো তারকা কিম কার্দাশিয়ান ২০১৩ সালে একটি সেলফি পোস্ট করেছিলেন। এতে তাঁর মুখ রক্তাক্ত দেখা যায়।

কয়েক বছর পর কার্দাশিয়ান বলেছিলেন, তিনি আর এই চিকিত্সা নেবেন না। তিনি তাঁর ওয়েবসাইটে লিখেছিলেন, এটি তাঁর জন্য সত্যিই কঠিন ও কষ্টকর ছিল।

এই সেবা নিতে খরচ কত, সে সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায় অনলাইন দেওয়া সেবাপ্রদানকারীদের তথ্য থেকে। লাইসেন্সধারী মেডিকেল স্পা সেন্টারে এই চিকিৎসার জন্য ১ থেকে ২ হাজার ডলার খরচ হতে পারে।

তিন নারী কীভাবে সংক্রমিত

২০১৮ সালের গ্রীষ্মে সিডিসি এক মার্কিন নারীর বিষয়ে তথ্য পায়। তাঁর বয়স ৪০ থেকে ৫০ বছর। তিনি বিদেশে থাকাকালে এইচআইভি পরীক্ষা করেছিলেন। পরীক্ষায় তাঁর পজেটিভ আসে। অর্থাৎ, তিনি সংক্রমিত।

এই নারী উল্লেখ করেন, ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদক নেওয়ার কোনো ইতিহাস তাঁর নেই। সম্প্রতি রক্ত ​​​​সঞ্চালনের কোনো ইতিহাস নেই তাঁর। তা ছাড়া তিনি তাঁর বর্তমান সঙ্গী ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে সম্প্রতি যৌনসঙ্গম করেননি।

তবে এই নারী অবশ্য সে বছরের শুরুতে নিউ মেক্সিকোর একটি স্পা সেন্টারে ভ্যাম্পায়ার ফেশিয়াল করার কথা বলেছিলেন।

স্পা সেন্টারটি নিয়ে তদন্ত করে সিডিসি। সেন্টারটি অন্যান্য ইনজেকশন পরিষেবাও দিয়ে থাকে। তদন্তে দেখা যায়, স্পা সেন্টারটির লাইসেন্স ছিল না। সেখানে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের চর্চা ছিল না।

যেমন রক্তের লেবেলবিহীন টিউব ও মেডিকেল ইনজেকশন রান্নাঘরের ফ্রিজে খাবারের পাশাপাশি সংরক্ষণ করা। আবার ড্রয়ার ও কাউন্টারে খোলা সিরিঞ্জ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা।

কিছু রক্তের শিশি পুনর্ব্যবহারের আলামতও দেখা গেছে। সিডিসি অন্তত একজন গ্রাহককে (ক্লায়েন্ট) চিহ্নিত করেছিল, যিনি এই স্পা সেন্টারে সেবা নিতে যাওয়ার আগে এইচআইভি পরীক্ষায় পজেটিভ শনাক্ত হয়েছিলেন।

মার্কিন স্বাস্থ্য সংস্থাটি তখন থেকে এইচআইভির পাঁচটি ঘটনার ক্ষেত্রে এই স্পা সেন্টারটির সংশ্লিষ্টতা নথিবদ্ধ করে। এর মধ্যে চারজন নারী, যাঁরা ২০১৮ সালের মে থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে এই সেন্টারে ‘ভ্যাম্পায়ার ফেশিয়াল’ চিকিৎসা নিয়েছিলেন। অপর ব্যক্তি একজন পুরুষ। তিনি এই স্পা সেন্টারে ‘ভ্যাম্পায়ার ফেশিয়াল’ নেওয়া এক নারীর (চার নারীর মধ্যে একজন) সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্কে যুক্ত।

সিডিসি বলেছে, এই পুরুষ ও নারীর এইচআইভি সংক্রমণের শেষ পর্যায় ইঙ্গিত দেয়, ফেশিয়ালের আগেই এই রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন তাঁরা।

২০১৮ সালের শেষ দিকে স্পা সেন্টারটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এটির সাবেক মালিক ৬২ বছর বয়সী মারিয়া ডি লর্ডেস রামোস ডি রুইজ সাড়ে তিন বছরের কারাদণ্ড ভোগ করছেন। লাইসেন্স ছাড়া সেবা দেওয়ার অভিযেগে তিনি ২০২২ সালে দোষী সাব্যস্ত হন।

ভ্যাম্পায়ার ফেশিয়ালের মতো কসমেটিক পদ্ধতি কি নিরাপদ

ইতিমধ্যে প্রকাশিত শত শত চিকিৎসা গবেষণাপত্র ও পরীক্ষা–নিরীক্ষা ইঙ্গিত দেয়, কিছু খেলার আঘাত, ব্রণ, একজিমাসহ অন্যান্য ত্বকের সমস্যার চিকিত্সায় এই পদ্ধতি (পিআরপি) কার্যকর।

দ্য আমেরিকান একাডেমি অব ডার্মাটোলজি অ্যাসোসিয়েশন বলছে, পদ্ধতিটি সঠিকভাবে করা হলে তা নিরাপদ বলেই মনে হয়।

অ্যাসোসিয়েশন বলছে, পদ্ধতিটি গ্রহণ করা পরে কিছুটা ব্যথা, কালশিটে দাগ, ফোলাভাব হতে পারে। তবে এগুলো কয়েক দিনের মধ্যে চলে যায়।

চিকিৎসাসেবা প্রদানকারী কর্তৃপক্ষের রক্ত ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি থেকেই সবচেয়ে বড় ঝুঁকি তৈরি হয় বলে উল্লেখ করেছে অ্যাসোসিয়েশন।

অ্যাসোসিয়েশন বলছে, শরীর থেকে সংগ্রহ করা রক্ত ​​জীবাণুমুক্ত রাখাটা অপরিহার্য। অন্যথায় সেবাগ্রহণকারী ব্যক্তির সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

এটাও নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ যে পরবর্তীতে ইনজেকশন দেওয়া রক্ত গ্রাহকেরই। অন্য কারও নয়। তা নাহলে গ্রাহক খুব অসুস্থ হয়ে যেতে পারেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যাঁরা কসমেটিক চিকিত্সা নিতে চান, তাঁদের আগেই নিশ্চিত হওয়া দরকার, সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানটির লাইসেন্স আছে কি না। সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানে চিকিত্সা সরঞ্জাম (যেমন-সুই) কীভাবে ব্যবহার করা হয়, সে বিষয়েও আগে ভালো করে খোঁজখবর নেওয়া দরকার।