রাষ্ট্র কল্যাণমূলক কর্মসূচি গুটিয়ে নেওয়ায় উগ্র ডানপন্থার উত্থান হচ্ছে: জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ

ব্রিটিশ অভিবাসনবিরোধী আন্দোলনের নেতা স্টিভেন ইয়াক্সলি-লেনন (টমি রবিনসন নামে বেশি পরিচিত) আয়োজিত এক বিক্ষোভ সমাবেশের দিনে লন্ডনের রাস্তায় প্রতিবাদকারীদের মিছিল। ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ছবি: রয়টার্স।

জাতিসংঘের শীর্ষ এক বিশেষজ্ঞ বলেছেন, বিশ্বজুড়ে ডানপন্থী জনতুষ্টিবাদী ও উগ্র ডানপন্থী শক্তির উত্থানের পেছনে ‘অত্যন্ত বিপজ্জনক’ এক রাজনৈতিক বয়ানকে কাজে লাগানো হচ্ছে। তাঁর মতে, মূলধারার রাজনীতিকেরা কয়েক দশক ধরে কল্যাণমূলক কর্মসূচি গুটিয়ে নেওয়ার যে চেষ্টা চালিয়েছেন, সেটির কারণেই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

লন্ডন থেকে লিসবন—উদার ডানপন্থী ও বামপন্থী, উভয় ধারার রাজনীতিকরাই ধীরে ধীরে সামাজিক কর্মসূচিগুলো দুর্বল করেছেন বলে মন্তব্য করেছেন জাতিসংঘের বিশেষ র‍্যাপোর্টিয়ার অলিভিয়ে দে শুতার। তাঁর মতে, এতে সমাজে একধরনের অভাবের অনুভূতি তৈরি হয়েছে। যেটি অভিবাসীবিরোধী মনোভাব সৃষ্টিতে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করছে।

শুতার যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানকে বলেন, ‘রাষ্ট্র যদি আরও বেশি পদক্ষেপ নিত, তাহলে মানুষ হুমকির মুখে আছে বলে মনে করতেন না। তাঁরা পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা করতেন না। ডিজিটাল ও সবুজ রূপান্তর এবং বিশ্বায়ন যে বেদনাদায়ক হবে না, সেই নিশ্চয়তাও তাঁরা পেতেন। কারণ, তাঁদের দেখভাল করার জন্য একটি রাষ্ট্র সচেষ্ট রয়েছে।’

অলিভিয়ে দে শুতার বুধবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করবেন। সেখানে তিনি সর্বজনীন ও মানবাধিকারভিত্তিক সামাজিক সুরক্ষায় বিনিয়োগের গুরুত্ব তুলে ধরবেন। তাঁর যুক্তির মূলকথা হলো সরকারগুলোর উচিত কল্যাণরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিষয়—খাদ্যসহায়তা, স্বাস্থ্যসেবা ও বেকার ভাতা পুনর্বিবেচনা করা।

এ প্রসঙ্গে জাতিসংঘের কর্মকর্তা যুক্তরাজ্যের উদাহরণ টেনেছেন। সেখানে নাইজেল ফারাজের ‘রিফর্ম’ দল অভিবাসন ইস্যুতে কনজারভেটিভ দলকেও ছাড়িয়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘এ পরিস্থিতি অত্যন্ত ভীতিকর। রিফর্ম ইউকে ইতিহাসের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি সমর্থন পাচ্ছে। যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন অংশে অভিবাসনবিরোধী বিক্ষোভ দেখা যাচ্ছে...এর একমাত্র কারণ, আমরা কল্যাণরাষ্ট্রে যথেষ্ট বিনিয়োগ করিনি।’

অলিভিয়ে দে শুতার আজ বুধবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করছেন। সেখানে তিনি সর্বজনীন ও মানবাধিকারভিত্তিক সামাজিক সুরক্ষায় বিনিয়োগের গুরুত্ব তুলে ধরবেন। তাঁর মূলকথা হলো, সরকারগুলোর উচিত কল্যাণরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিষয়—খাদ্যসহায়তা, স্বাস্থ্যসেবা ও বেকার ভাতা পুনর্বিবেচনা করা। এসবকে সামাজিক কাঠামো টিকিয়ে রাখার অপরিহার্য হাতিয়ার হিসেবে দেখা উচিত, কেবল ব্যয় বা বোঝা হিসেবে নয়।

বিশেষ র‍্যাপোর্টিয়ার হলেন জাতিসংঘের নিযুক্ত স্বাধীন বিশেষজ্ঞ। তাঁরা নির্দিষ্ট পরিস্থিতি বা বিষয়ে পরামর্শ প্রদান ও প্রতিবেদন তৈরি করেন।

অলিভিয়ে দে শুতার বলেন, বিশ্বজুড়ে মূলধারার রাজনীতিকেরা কয়েক দশক ধরে ভাতা বা সুবিধা পাওয়ার প্রক্রিয়া কঠিন করেছেন। নজরদারি বাড়িয়েছেন এবং ভাতা পাওয়া ব্যক্তিদের কলঙ্কিত করেছেন। তাঁদের বার্তা ছিল—এসব সমাজের জন্য একটি বোঝা, ভবিষ্যতের জন্য বিনিয়োগ নয়।’

শুতার বলেন, ‘রাষ্ট্র যদি আরও বেশি পদক্ষেপ নিত, তাহলে মানুষ হুমকির মুখে আছে বলে মনে করত না। তারা পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা করত না। ডিজিটাল ও সবুজ রূপান্তর এবং বিশ্বায়ন যে বেদনাদায়ক হবে না—সেই নিশ্চয়তাও তারা পেত। কারণ, তাদের দেখভাল করার জন্য একটি রাষ্ট্র সচেষ্ট রয়েছে।’

শুতার বলেন, এর ফলে এমন একটি ধারণা জন্ম নিয়েছে যে এ ধরনের সম্পদের সুবিধা নেওয়ার সুযোগ কঠোরভাবে সীমিত রাখতে হবে। ‘বার্তাটা হলো এমন “আমরা বনাম ওরা”। এক গোষ্ঠী যা পায়, অন্যদের তা থেকে বঞ্চিত করতে হবে। কারণ, সবার জন্য যথেষ্ট নেই। এটি এমন একটি আলোচনা, যা মানুষকে পরস্পরের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেয়। আর এটি অত্যন্ত বিপজ্জনক। আমি মনে করি, চরম ডানপন্থীরা এখন সেটিরই সুবিধা ভোগ করছে।’

জাতিসংঘের র‍্যাপোর্টিয়ারের বক্তব্যের সপক্ষে ২০২১ সালের একটি গবেষণা রয়েছে। সেখানে ইউরোপের ১৪টি দেশের তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, আয়ের বৈষম্য এক ঘর বৃদ্ধি পেলে জনতুষ্টিবাদী দলগুলোর প্রতি সমর্থনও এক ঘর বেড়ে যায়। একই সঙ্গে, পেনশনের হার বৃদ্ধি, ন্যূনতম মজুরির বিধান ও শিশু ভাতা বাড়ানো চরম ডানপন্থী দলগুলোর প্রতি ভোট দেওয়ার সম্ভাবনাকে কমিয়ে দেয় বলে গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে।

অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও পিছিয়ে পড়া অঞ্চলে বসবাসরত পুরুষদের মধ্যে চরম ডানপন্থী দলগুলোর বার্তা গভীরভাবে সাড়া জাগায়।
জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদক অলিভিয়ে দে শুতার

অলিভিয়ে দে শুতার বলেন, জনতুষ্টিবাদী দলগুলো প্রায়ই দাবি করে, অভিবাসন সামাজিক সেবার ওপর চাপ তৈরি করে থাকে। তাই সমাজ তা বহন করতে পারবে না। অথচ অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (ওইসিডি) সদস্যদেশগুলোর তথ্য বলছে, অভিবাসীরা যে ব্যক্তিগত সুবিধা পান, তাঁর চেয়ে আয়কর ও সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থায় বেশি অবদান রাখেন।

জাতিসংঘের কর্মকর্তা বলেন, ‘এই প্রতিবেদন একটি সতর্কবার্তা দিচ্ছে। যুক্তরাজ্যে রিফর্ম ইউকের জরিপে শীর্ষে থাকা কোনো আকস্মিক বিষয় নয়। একই চিত্র জার্মানিতে অল্টারনেটিভ ফর ডয়েচল্যান্ড, নেদারল্যান্ডসে ফ্রিডম পার্টি এবং ফ্রান্সে ন্যাশনাল র‍্যালির ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে। তারা সরকার গঠনের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে।’

বিক্ষোভকারীদের ব্রিটিশ ইউনিয়ন জ্যাক বা যুক্তরাজ্যের জাতীয় পতাকা এবং সেন্ট জর্জ বা ইংল্যান্ডের পতাকা ওড়াতে দেখা গেছে
ছবি: রয়টার্স

শুতার বলেন, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও পিছিয়ে পড়া অঞ্চলে বসবাসরত পুরুষের মধ্যে চরম ডানপন্থী দলগুলোর বার্তা গভীরভাবে সাড়া জাগিয়ে থাকে। তিনি উল্লেখ করেন, ‘উদাহরণস্বরূপ, জার্মানির পূর্বাঞ্চল এবং গ্রামীণ এলাকায় অল্টারনেটিভ ফর ডয়েচল্যান্ডের কথা ধরা যাক। সেখানে তাদের পক্ষে সর্বোচ্চ ভোট পড়ে। এসব এলাকায় সরকারি সেবার মান খুবই দুর্বল। ইন্টারনেট–সুবিধা সীমিত এবং পরিবহন ব্যবস্থার সুবিধা পাওয়া কঠিন। ফলে মানুষ নিজেদের পরিত্যক্ত মনে করে... ফ্রান্সের অবস্থাও প্রায় একই রকম। ন্যাশনাল র‍্যালি সবচেয়ে বেশি ভোট পায় এসব উপেক্ষিত গ্রামীণ অঞ্চল থেকেই।’

জাতিসংঘের র‍্যাপোর্টিয়ার আরও বলেন, চরম ডানপন্থী ও ডানপন্থী জনতাবাদী দলগুলো ক্ষমতায় এলে (যেমন যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সরকার বা আর্জেন্টিনার হাভিয়ের মিলেইর সরকার) তাঁদের কার্যক্রম থেকে বোঝা যায়, তাঁদের লক্ষ্য সামাজিক সুরক্ষাব্যবস্থাকে আরও ভেঙে দেওয়া।

শুতার বলেন, ক্ষমতায় পৌঁছানোর পর তাঁরা তাঁদের বক্তৃতায় সমালোচিত অর্থনৈতিক অভিজাত শ্রেণির সুবিধা রক্ষায় কাজ করে। একই সঙ্গে খাদ্যসহায়তা, স্বাস্থ্যসেবা ও অন্যান্য জীবন রক্ষাকারী সুবিধা কমিয়ে দেয়। তাঁরা নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাখেনি; বরং পরিস্থিতি আরও খারাপ করেছে। ফলে ওই দুই দেশে বৈষম্য ও দারিদ্র্যের মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।

শুতার আশা প্রকাশ করেন, তাঁর প্রতিবেদনটি সামাজিক কর্মসূচিগুলোর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরবে। তিনি বলেন, ‘আমার আহ্বান, আমাদের জেগে উঠতে হবে। সরকারি অর্থের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার আড়ালে যেন আমরা সমাজকে অস্থির হয়ে যেতে এবং সীমিত সম্পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠীতে বিভক্ত হতে না দিই।’

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান–এ প্রকাশিত প্রতিবেদনটির বাংলা অনুবাদ করেছেন এস এম জারিফ।