কমলা হ্যারিসের সামনে এখন কী

ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পাওয়ার পর প্রথম বক্তৃতা দেওয়ার আগে কমলা হ্যারিস। ওয়াশিংটন ডিসিতে, ২২ জুলাই ২০২৪ফাইল ছবি: রয়টার্স

ঠিক দুই মাস আগে ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে নির্বাচনে হারের পর যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস গত সোমবার (৬ জানুয়ারি) আদতে নিজের পরাজয়ের প্রত্যয়ন বা সার্টিফিকেশনের সভাপতিত্ব করলেন।

যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ সিনেটের প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি সোমবার হাউস স্পিকারের বেদিতে দাঁড়িয়ে ইলেকটোরাল কলেজ ভোট গণনায় নেতৃত্ব দিলেন। এর মধ্য দিয়ে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ট্রাম্পের বিজয় আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত হলো। এই ভোট গণনার দুই সপ্তাহ পর হোয়াইট হাউসে ফিরবেন ট্রাম্প।

পুরো ব্যাপারটাই কমলার জন্য বেদনাদায়ক ও বিব্রতকর। প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি ট্রাম্পকে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের জন্য বড়সড় হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করে আসছিলেন।

অবশ্য এমনটা নয় যে এই প্রথম যুক্তরাষ্ট্রে কোনো পরাজিত প্রেসিডেন্ট প্রার্থী তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীকে নির্বাচনকারীদের সংখ্যা গুনতে কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে নেতৃত্ব দিলেন। ২০০১ সালে এই অমর্যাদা হজম করেছেন আল গোর। তারও আগে করেছেন রিচার্ড নিক্সন, ১৯৬১ সালে।

তবে এবারের ঘটনাটিকে দোলাচলের এক নির্বাচনের উপযুক্ত সমাপন হিসেবে দেখা যায়। কমলা যুক্তরাষ্ট্রের প্রবীণতম প্রেসিডেন্টের সহচর থেকে হঠাৎ ডেমোক্রেটিক পার্টির নির্বাচনী পতাকা হাতে সামনে চলে এসেছিলেন। পরাজয়ের ধসে ভিতের গভীর দুর্বলতাগুলো ফুটে ওঠার আগ পর্যন্ত তাঁর অল্প দিনের প্রচারণা দলটিকে একঝলক আশা দেখিয়েছিল।

নির্বাচনী প্রচারণায় বক্তৃতা রাখছেন কমলা হ্যারিস। উইসকনসিন অঙ্গরাজ্যের ওয়েস্ট অ্যালিস শহরে, ২৩ জুলাই ২০২৪
ছবি : রয়টার্স

কমলা ও তাঁর সঙ্গীরা এখন তাঁর পরবর্তী করণীয় নিয়ে ভাবছেন। তাঁদের চিন্তার কেন্দ্রে রয়েছে দুটি বিষয়। এক. তিনি কি ২০২৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফের লড়বেন? দুই. নাকি তিনি নিজের অঙ্গরাজ্য ক্যালিফোর্নিয়ায় গভর্নর প্রার্থী হবেন?

ডেমোক্রেটিক পার্টির সাম্প্রতিক প্রার্থীদের মধ্যে আল গোর, জন কেরি ও হিলারি ক্লিনটন হেরে গিয়ে আর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি। তবে কমলার সহকারী, মিত্র ও অর্থদাতাদের যুক্তি, তিনি প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি বটে; কিন্তু বিপুল জনসমর্থন আদায় করেছেন। তাঁর সংক্ষিপ্ত প্রচারণার অসাধারণ আবহও বলছে, আরেকবার প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হওয়ার আশা তিনি করতে পারেন।

কমলার সঙ্গীরা ডোনাল্ড ট্রাম্পের রাজনৈতিক বাঁক ঘোরার নজিরও টানছেন। ট্রাম্প ২০১৬ সালে প্রথমবার জিতে ২০২০ সালে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচন করে হেরে যান। সেই তিনিই ২০২৪ সালের নির্বাচনে আবার বাজিমাত করলেন।

ট্রাম্পের জয়ের জন্য ডেমোক্রেটিক পার্টির বেশির ভাগ সদস্য কমলাকে দায়ী করেননি। তবে দলটির কিছু সদস্য তাঁর আবার প্রার্থিতার বিষয়ে গভীরভাবে সন্দিহান। অন্যদিকে দলটির বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের যে গভর্নরেরা ২০২৪ সালে ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলার পেছনে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁদের অনেকের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হওয়ার ইচ্ছা আছে। কিছু রাজনৈতিক কৌঁসলি প্রার্থী হিসেবে তাঁদের জিতে আসার সম্ভাবনা বেশি দেখছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ও ক্লাইমেট রিয়্যালিটি প্রজেক্টের চেয়ারম্যান আল গোর। সুইজারল্যান্ডের দাভোসে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের বার্ষিক বৈঠকে, ২২ জানুয়ারি ২০১৯
ফাইল ছবি : রয়টার্স

বলা হচ্ছে, ভবিষ্যতের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে কমলার নিজের কোনো তাড়াহুড়া নেই। তিনি উপদেষ্টা ও সমর্থকদের বলছেন, ২০ জানুয়ারি অভিষেকের দিনটির পর সব রকম সম্ভাবনার জন্যই তাঁর মন খোলা রয়েছে।

কমলা এখন তাঁর গত কয়েক মাসের কাজগুলো খতিয়ে দেখছেন। মাত্র ১০৭ দিনে তিনি একাধারে নির্বাচনী প্রচারণা ঢেলে সাজিয়েছেন, রানিং মেট বা ভাইস প্রেসিডেন্ট ঠিক করেছেন, দলের জাতীয় সম্মেলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং দেশজুড়ে চষে বেড়িয়েছেন।

তা ছাড়া কমলার সহকারীরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, তিনি এখনো অন্তত দুই সপ্তাহ, অর্থাৎ ২০ জানুয়ারি ট্রাম্প আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করা পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকছেন।

কমলার ঘনিষ্ঠ মিত্র ও নির্বাচনী প্রচারণায় তাঁর উপদেষ্টা ডোনা ব্রাজিল বলেন, ‘তাঁকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে; কিন্তু যতক্ষণ আপনি একটা দায়িত্বের চাকায় ঘুরছেন, ততক্ষণ সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। সে ঘোরার গতি হয়তো কমেছে, কিন্তু ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত এই চাকার পাঁকেই তিনি বাঁধা আছেন।’

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নিজের প্রতিকৃতি উন্মোচন অনুষ্ঠানে, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩
ছবি : রয়টার্স

ডোনা ব্রাজিল বলেন, ‘কাউকেই আপনি ছাঁচে ফেলে বিচার করতে পারেন না। আমরা আল গোরকে তেমনটা করিনি, যদিও এটা স্পষ্ট ছিল যে ২০০০ সালের নির্বাচনের পর দেশে বড় রকমের বিভক্তি দেখা দিয়েছিল।’

২০০০ সালে রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী জর্জ ডব্লিউ বুশের বিরুদ্ধে আল গোরের নির্বাচনী প্রচারশিবিরের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ডোনা ব্রাজিল। সেবার জর্জ ডব্লিউ বুশের কাছে হেরে গিয়েছিলেন আল গোর। তারপর তিনি পরিবেশ অধিকারকর্মী হিসেবে দ্বিতীয় জীবন বেছে নেন, বলেন ডোনা।

ডোনা আরও বলেন, ‘সব সুযোগ নিয়েই চিন্তাভাবনা চলছে। কারণ, পরিবর্তনের জন্য একটা তাড়না তৈরি হয়েছে। আমি বিশ্বাস করি, ভবিষ্যতে তিনি সেই পরিবর্তনের প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন।’

বেসরকারি খাত আরেকটি সুযোগ

যুক্তরাষ্ট্রের রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর আমেরিকান উইমেন অ্যান্ড পলিটিকসের পরিচালক ডেবি ওয়ালশ বলেন, ‘নারীরা নির্বাচনে হেরে গেলে পুরুষদের তুলনায় কখনো কখনো তাঁদের সামনে তত বেশি সুযোগ থাকে না। (নির্বাচনে পরাজিত) পুরুষেরা কোনো আইনপ্রতিষ্ঠান বা বিমা ব্যবসায় সহজে কাজ পান। এতে করে তাঁরা দম ফেলার সুযোগ পান, কিছু টাকা কামান এবং এরপর কী করবেন ভেবেচিন্তে সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।’

তবে ডেবি বলেন, ‘আমার মনে হয় না কমলা হ্যারিসের জন্য এটা কোনো সমস্যার ব্যাপার হবে। আমার বিশ্বাস, তিনি খুলতে চাইলে যেকোনো দরজা তাঁর জন্য খুলে যাবে।’

কিন্তু কমলার মতো ব্যক্তি, যিনি দুই দশক নির্বাচিত পদে ছিলেন এবং তার আগে সরকারি কৌঁসুলি হিসেবে কাজ করেছেন, তাঁর জন্য গভর্নর হওয়াটাই সবচেয়ে উপযুক্ত সুযোগ হতে পারে।