প্রযুক্তির দুনিয়ায় পা রাখলেন আরেক ‘গেটস’, বাবার মতো কি সফল হতে পারবেন

বিল গেটসের মেয়ে ফিবি গেটসছবি: ইনস্টাগ্রাম

বিল গেটস ও মেলিন্ডা গেটসের সবচেয়ে ছোট ও সবচেয়ে ফ্যাশনসচেতন মেয়ে ফিবি গেটস। এখন তিনি নিজে একজন উদ্যোক্তা। তিনি নতুন একটি অনলাইন শপিং টুল চালু করেছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহর ইউনিয়ন স্কয়ারের কাছে একটি ভবনের ওপরতলায় ছোট্ট সাদা দেয়ালের অফিস। সেখানে কিছু ব্যস্ত তরুণ-তরুণী কাজ করছেন। কেউ সিরিল খাচ্ছেন, কেউ জেলি বিন। দেয়ালে লাল মার্কারে লেখা ক্ষণগণনার ক্যালেন্ডার। পাশে একটা রোমান মূর্তি, যার মুখে ফোলানো গোলাপি বেলুন। আর অফিসের বাইরে ঝোলানো নামফলক ‘ফিয়া (Phia)’।

এই নতুন অনলাইন শপিং প্ল্যাটফর্মের ভাবনা শুরু করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রী ফিবি গেটস ও সোফিয়া কিয়ানি। কলেজের আবাসিক হলের একটি কক্ষ থেকে এ ভাবনার সূচনা।

সব দিক থেকে দেখতে গেলে এটা একটা সাধারণ স্টার্টআপই। তবে একটা বড় পার্থক্য আছে; ফোয়েবের পদবি যে ‘গেটস’!

ফ্যাশনের জগতে Booking.com (বুকিং ডটকম) বানাতে চায় ফিয়া। ২৪ এপ্রিল ফিয়ার ব্রাউজারভিত্তিক অ্যাপ চালু হয়, যা ফ্যাশনের জন্য বুকিং ডটকমের মতো কাজ করবে। নতুন বা পুরোনো যেকোনো পোশাক বা ফ্যাশন আইটেমের দাম হাজারো ওয়েবসাইটে তুলনা করে দেখাবে, যাতে এক ক্লিকেই সবচেয়ে সাশ্রয়ী দামে কেনা যায়।

নতুন এই চিন্তার পেছনে আছেন ফিবি গেটস (২২) যিনি বিল গেটস ও মেলিন্ডা ফ্রেঞ্চ গেটসের ছোট সন্তান এবং তাঁর কলেজের রুমমেট সোফিয়া কিয়ানি (২৩)।

নারী হিসেবে নতুন উদ্যোগ শুরু করাটা বেশ কঠিন। তার ওপর যদি আপনি হন বিশ্বের অন্যতম ধনী প্রযুক্তি–উদ্যোক্তার মেয়ে, তাহলে তা আরও জটিল।

ফিবি বলেন, ‘আমি জানি, মানুষ সব সময় কিছু না কিছু বলবেই। আমাদের উদ্যোগ সফল হলে অনেকে বলবেন, ‘ও তো গেটসের মেয়ে, তাই পারছে। অনেকটা সত্যি। আমি হয়তো স্ট্যানফোর্ডে পড়তে পারতাম না, যদি আমার পরিবার না থাকত। কিন্তু এ নিয়ে আমার নিজের ভেতরেই একটা চাপ কাজ করে।’

২৪ এপ্রিল ফিয়ার ব্রাউজারভিত্তিক অ্যাপ চালু হয়, যা ফ্যাশনের জন্য বুকিং ডটকমের মতো কাজ করবে। নতুন বা পুরোনো যেকোনো পোশাক বা ফ্যাশন আইটেমের দাম হাজারো ওয়েবসাইটে তুলনা করে দেখাবে, যাতে এক ক্লিকেই সবচেয়ে সাশ্রয়ী দামে কেনা যায়।

ফোয়েবে বুঝে গেছেন, অনেকে ধরেই নেবেন যে তাঁর নামের জোরেই তাঁরা বিনিয়োগ পেয়েছেন, বড় বড় মেন্টর পেয়েছেন। যেমন ক্রিস জেনার (কার্দাশিয়ানের মা), সারা ব্ল্যাকলি (স্প্যানক্স) বা জোয়ান ব্র্যাডফোর্ড (হানির সাবেক প্রেসিডেন্ট)।

এমনকি জনপ্রিয় পডকাস্ট নির্মাতা অ্যালেক্স কুপার তাঁদের নিজস্ব পডকাস্ট ‘দ্য বার্নআউটস উইথ ফিবি অ্যান্ড সোফিয়া’র জন্য চুক্তিবদ্ধ করেছেন। এসবও অনেকে নামের কারণেই হয়েছে বলে ধরে নেবেন।

বিল গেটসের ছোট মেয়ে বলেন, ‘আমরা দুই রুমমেট আসলে জামাকাপড় নিয়ে ঝগড়া করি, অনলাইন শপিং সাইটে ঘেঁটে ঘেঁটে অফার খুঁজি। আমাদের মতো হাজারো মেয়ে আছেন।’

হ্যাঁ, হয়তো ফিবির জীবনযাপন একটু আলাদা, কিন্তু চিন্তাভাবনায় অনেকেই কাছাকাছি।

ফিবি গেটস
ছবি: ইনস্টাগ্রাম

শিন থেকে সেকেন্ডহ্যান্ড চ্যানেল

‘দ্য ক্যাচার ইন দ্য রাই’ উপন্যাসের ‘ফোয়েবে’ চরিত্রের নামে নাম রাখা ফিবি গেটস বড় হয়েছেন সিয়াটলে। তিন ভাইবোনের মধ্যে তিনি সবচেয়ে ছোট। বড় বোন শিশুচিকিৎসক, ভাই কংগ্রেসের একটি কমিটিতে কাজ করেন।

স্কুলজীবনে ফিবি গ্রীষ্মকাল কাটাতেন রুয়ান্ডায়। তিনি ও তাঁর পরিবার খুব প্রতিযোগিতাপ্রবণ। বাবার মতোই তাঁর এডিএইচডি আছে। কথা বলেন দেড় গুণ দ্রুতগতিতে, বসে বসে পা নাচাতে থাকেন।

ফিবির পরিবারে মাইক্রোসফট নয়, বরং সমাজসেবার বিষয়টি শেখানো হয়েছে। যখন ফোয়েবে ছয় বছরের, তখনই বাবা মাইক্রোসফট থেকে অবসর নিয়ে গেটস ফাউন্ডেশনে পুরো মনোযোগ দেন।

তবে পরিবারের অন্য সদস্যদের চেয়ে ফিবি আলাদা, তিনি কিছুটা বহির্মুখী।

বিল গেটস বলেন, ‘ফিবিই আমাদের মধ্যে সবচেয়ে আলাদা। কারণ, সে মানুষের সঙ্গে দারুণ মিশে যেতে পারে। ছুটিতে গেলে আমরা বাকি সবাই নিরিবিলি থাকতে চাইতাম আর ফোয়েবে গিয়ে নতুন মানুষের সঙ্গে আলাপ করে তাঁদের আমাদের কাছে নিয়ে আসত।’

এমনকি তাঁর ভাই এখন তাঁর কাছ থেকে ফ্যাশন টিপস নেন।

প্রতি রোববার ফিবি সপ্তাহের জামাকাপড় ঠিক করে র‍্যাকে ঝুলিয়ে রাখেন, যাতে সকালে সময় নষ্ট না হয়।

ফিবি ফ্যাশনের দারুণ ভক্ত

ফিবি এখন নিউইয়র্কে একটি অ্যাপার্টমেন্টে থাকেন, সঙ্গে দুটি র‍্যাগডল বিড়াল। বসার ঘর, রান্নাঘর, ডাইনিং সব একসঙ্গে। ২০ ফুট উঁচু চাঁদ। বাসায় রং অনুযায়ী সাজসজ্জা করা হয়েছে।

ফিবি বলেন, ‘আগে আমি খুব বাজে জামাকাপড় পরতাম।’

ফিবি এখন পরেন রিফরমেশন ড্রেস, নিলি লোটন ব্লেজার (পশমার্ক থেকে কেনা), ভিনটেজ চ্যানেল বুট আর টিফানি গয়না (রিয়েলরিয়েল থেকে)। আগে শিন বা ফরএভার ২১-এ কেনাকাটা করতেন। তখন তাঁকে নাকি সোফিয়া বলতেন, ওহ গার্ল, নো!

‘দ্য ক্যাচার ইন দ্য রাই’ উপন্যাসের ‘ফিবি’ চরিত্রের নামে নাম রাখা ফোয়েবে গেটস বড় হয়েছেন সিয়াটলে। তিন ভাইবোনের মধ্যে তিনি সবচেয়ে ছোট। বড় বোন শিশুচিকিৎসক, ভাই কংগ্রেসের একটি কমিটিতে কাজ করেন।

ফিবি এখন বেশির ভাগ জামাকাপড় কিনে থাকেন রিসেল সাইট থেকে। যেমন একবার ২০০ ডলারে প্রাদা প্যান্ট পেয়ে প্রতিদিন পরে ফেলতেন। এখন তাঁর ভাইও পোশাক নিয়ে তাঁর কাছে পরামর্শ চান। সপ্তাহজুড়ে কী পরবেন, তা প্রতি রোববার ঠিক করে একটি র‍্যাকে সাজিয়ে রাখেন।

ফিবি অনলাইনে খুবই সক্রিয়। ইনস্টাগ্রামে তাঁর প্রায় ৫ লাখ ও টিকটকে প্রায় ২ লাখ ৪০ লাখ অনুসারী আছেন।

গোলাপি প্রেম, ইনস্টাগ্রাম আর বিখ্যাত প্রেমিক

ফিবির প্রিয় রং গোলাপি। তাঁর শোবার ঘরের রং হালকা গোলাপি। দেয়ালে টাঙানো গোলাপি ক্যাসেটের ছবি, যা তিনি মাত্র ২০ ডলারে একটি মার্কেট থেকে কিনেছিলেন। তাঁর প্রেমিক আর্থার ডোনাল্ড (পল ম্যাককার্টনির নাতি) ছবিটি পছন্দ করেন না।

ফিবি আর তাঁর প্রেমিকের মধ্যে প্রায় দুই বছর ধরে সম্পর্ক চলছে। দেখা হয়েছিল স্টেলা ম্যাককার্টনির সঙ্গে ফ্যাশন ক্যাম্পেইনে কাজ করতে গিয়ে। আর্থার ক্যালিফোর্নিয়ায় থাকেন, তবে সুযোগ পেলেই নিউইয়র্কে আসেন। যখন আসেন, গোলাপি ছবিটা দেয়াল থেকে খুলে রাখেন। তাঁরা এখন এর বিকল্প কিছু খুঁজছেন।

দুজনই বুঝতে পারেন, তাঁদের মতো অনেক মেয়ে আছে, যাঁরা চান বুদ্ধিমানের মতো কেনাকাটা করতে, এক ক্লিকে সবচেয়ে সাশ্রয়ী দামে ভালো জিনিস কিনতে।
বাবা বিল গেটসের সঙ্গে ফিবি
ছবি: ইনস্টাগ্রাম

অভিনব আইডিয়া, নতুন পরিকল্পনা

ফিবি ও সোফিয়া প্রথমে একটি উদ্যোক্তা ক্লাসে ঢোকার জন্য আইডিয়া খুঁজছিলেন।

প্রথমে ভাবলেন এমন একটি স্মার্ট ট্যাম্পন বানাবেন, যা শরীরের হরমোন বা আয়রনের মাত্রা বুঝে ফেলতে পারবে। পরে ভাবলেন, জেনারেশন জেডের (জেন-জি) জন্য নতুন ধরনের লিংকডইন (LinkedIn) বানাবেন।

শেষ পর্যন্ত দুজন ভাবলেন, নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে—যেমন ফিবি একবার ৫০০ ডলার দিয়ে কেনা একটি পোশাক পরে দেখেন, সেটা রিয়েলরিয়েলে ১৫০ ডলারে বিক্রি হচ্ছে। মনে হয়েছিল, ‘কী বোকামি করেছি!’

দুজনই বুঝতে পারেন, তাঁদের মতো অনেক মেয়ে আছে, যাঁরা চান বুদ্ধিমানের মতো কেনাকাটা করতে, এক ক্লিকে সবচেয়ে সাশ্রয়ী দামে ভালো জিনিস কিনতে।

দুজন এতটাই উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়েন যে পড়াশোনা ছেড়ে পুরো সময়টা দিতে চান ফিয়া গড়তে। কিন্তু দুজনের মায়েরা নিষেধ করে দেন।

তবু ফিবি তিন বছরে ডিগ্রি শেষ করেন (চার বছর নয়), যাতে নিউইয়র্কে এসে কাজ শুরু করতে পারেন। কারণ, এখানে ফ্যাশন আছে।