ফেসবুকের কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা কেলেঙ্কারির কথা মনে আছে নিশ্চয়ই? ২০১৮ সালে ফেসবুক থেকে অনৈতিকভাবে লাখো গ্রাহকের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহের অভিযোগ উঠেছিল প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। যুক্তরাজ্যের এ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় ফেসবুকের তথ্য হাতিয়ে ট্রাম্পের পক্ষে কাজে লাগানোর অভিযোগ ছিল। সেই কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা কেলেঙ্কারির একটি মামলার নাটকীয় সমাপ্তি হতে যাচ্ছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান বলছে, অর্থের বিনিময়ে আলোচিত এক মামলার সমঝোতা করছে ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান মেটা। তবে এ জন্য কী পরিমাণ অর্থ খরচ করছে, তা জানানো হয়নি।
চার বছরের পুরোনো ‘ক্লাস অ্যাকশন’ মামলাটি করেছিলেন একদল ফেসবুক ব্যবহারকারী। তাঁদের অভিযোগ ছিল, কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার মতো অন্যান্য সংস্থাকে ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্য সরবরাহ করে ফেসবুক সেবাগ্রহীতাদের গোপনীয়তা আইন লঙ্ঘন করেছে। কেমব্রিজ অ্যানালিটিকাকে ব্যক্তিগত তথ্য ব্যবহার করার অনুমতি দেওয়ার জন্য ফেসবুকের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণের এ মামলা হয়।
কেলেঙ্কারির ঘটনাটি জানাজানি হওয়ার দুই মাস পরে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করে।
গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সম্প্রতি আদালতে জমা দেওয়া এক নথিতে ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান মেটা জানিয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে চলা মামলাটি সমঝোতা করতে তারা সম্মত হয়েছে। তবে কী পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে মামলায় সমঝোতা হচ্ছে, তা প্রকাশ করা হয়নি।
ফেসবুক ব্যবহারকারীদের তথ্য বেহাত হওয়ার ঘটনাটি সামনে নিয়ে আসেন যুক্তরাজ্যের লন্ডনভিত্তিক কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার সাবেক কর্মী ক্রিস্টোফার উইলি।
তিনিই প্রথম জানান, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এবং যুক্তরাজ্যের ব্রেক্সিট (ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছেদ) প্রশ্নে গণভোটে ভূমিকা ছিল তাঁর সাবেক কর্মস্থলের। এ ব্যাপারে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকাকে সহযোগিতা করেছিলেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক আলেকসান্দ্র কোগান। তিনি বিশেষ অ্যাপ তৈরি করে ফেসবুকের প্ল্যাটফর্মে ছেড়েছিলেন। এর মাধ্যমে তিনি কোটি কোটি ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করে তা বিক্রি করে দিয়েছিলেন কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার কাছে।
ক্রিস্টোফার উইলির ভাষ্যমতে, কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা ওই সব তথ্য ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রচারশিবিরকে সরবরাহ করেছিল। শুধু তা-ই নয়, ওই তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করে সম্ভাব্য রিপাবলিকান ভোটারও চিহ্নিত করা হয়।
প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল, সম্ভবত পাঁচ কোটি ফেসবুক ব্যবহারকারীর তথ্য হাতিয়ে নিয়েছে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা। তবে পরে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ স্বীকার করে, ৮ কোটি ৭০ লাখ ব্যবহারকারীর তথ্য বেহাত হয়েছে।
তথ্য চুরির কেলেঙ্কারিতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নীতিনির্ধারকদের তোপের মুখে পড়েন ফেসবুকের প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গ। পরে বিষয়টি নিয়ে মার্কিন সিনেটের শুনানিতে হাজির হতে হয় ফেসবুকের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গকে। ওই শুনানিতে কয়েকবার মাফ চাওয়ার পাশাপাশি গোপনীয়তা নীতিমালা নতুন করে করার প্রতিশ্রুতিও দেন জাকারবার্গ।
এদিকে ফেসবুক নিয়ে এই মামলার ক্ষেত্রে দফায় দফায় জাকারবার্গকে রক্ষার চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে তাঁর প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। এর আগে গত বছর কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা কেলেঙ্কারি ঘিরে পৃথক আরেকটি মামলায় জাকারবার্গকে রক্ষার চেষ্টা করে মেটা। ওই মামলায় যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ট্রেড কমিশন (এফটিসি) ৪৯০ কোটি মার্কিন ডলার দাবি করে। এই কেলেঙ্কারি প্রকাশের পরপর ফেসবুকের শেয়ারের দাম ব্যাপকভাবে কমে যায়।
দ্য অবজারভারের সাংবাদিক ক্যারল ক্যাডওয়ালাডার কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা কেলেঙ্কারি নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করেছিলেন। তিনি গার্ডিয়ানকে বলেন, জাকারবার্গকে কেলেঙ্কারিসংক্রান্ত প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া থেকে সরিয়ে রাখতে ফেসবুক যেকোনো পরিমাণ অর্থ দিতে প্রস্তুত, তা প্রমাণিত হয়েছে।
ধারণা করা হচ্ছে, মেটার প্রধান নির্বাহী এবং মেটা থেকে সদ্য পদত্যাগ করা প্রতিষ্ঠানটির প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা শেরিল স্যান্ডবার্গকে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের করা মামলায় শিগগিরই আইনজীবীদের শুনানির মুখে পড়তে হতো। আগামী মাসে তাঁদের ছয় ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করতে চেয়েছিলেন আইনজীবীরা। মামলায় সমঝোতার উদ্যোগ নেওয়ায় তাঁরা এই শুনানি থেকে বেঁচে যাবেন।
ক্যারল ক্যাডওয়ালাডার আরও বলেন, কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার তথ্য কেলেঙ্কারি ঢাকা দেওয়ার বিষয়সংক্রান্ত প্রশ্ন এড়াতে জাকারবার্গ কতটা মরিয়া, তার প্রমাণ এটা।
কিছুদিন পরেই আইনজীবীদের ছয় ঘণ্টার জন্য জেরার মুখোমুখি হওয়ার কথা ছিল তাঁর।
তবে শুক্রবার আদালতে জমা দেওয়া নথিতে আর্থিক শর্তাবলি বা প্রাথমিক নিষ্পত্তির বিশদ বিবরণ দেওয়া হয়নি। তাতে সান ফ্রান্সিসকো ফেডারেল আদালতের বিচারককে এই ক্লাস অ্যাকশন মামলাটি লিখিত নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ৬০ দিন পর্যন্ত অপেক্ষমাণ রাখতে অনুরোধ করা হয়েছে।
২০১৮ সালে বিশ্বজুড়ে ফেসবুক ও কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা ঘিরে তদন্তের দাবি ওঠে। ফেসবুকের এই কেলেঙ্কারিতে সরব হন সরকার ও রাজনীতির বাঘা বাঘা ব্যক্তি। এ ঘটনা জানাজানি হওয়ার পরপরই কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা তাদের নির্বাহী আলেকজান্ডার নিক্সকে বরখাস্ত করে। রাজনীতিবিদদের ফাঁসাতে ঘুষ দেওয়া, যৌনকর্মী ব্যবহারসহ কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার গোপন কৌশল ছদ্মবেশী সাংবাদিকদের কাছে প্রকাশ করেন তিনি। পরে সে তথ্য জনসমক্ষে চলে আসে।
কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার পক্ষ থেকে অবশ্য এসব অভিযোগ অস্বীকার করা হয়। এ ঘটনার জের ধরে বন্ধ হয়ে যায় কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা। বিশ্বজুড়ে কঠোর সমালোচনা ছাড়াও কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে কয়েকটি দেশ। কিন্তু বরাবরই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছেন জাকারবার্গ।