সদ্য ৩৪-এ পা দিয়েছেন। ভারতীয় পিতা-মাতার সন্তান, গায়ের রং বাদামি, ধর্মে মুসলিম এবং রাজনীতিতে ঘোর বামপন্থী। সেই জোহরান মামদানি, ডোনাল্ড ট্রাম্পের চোখে যিনি শুধু বহিরাগত নন, সম্ভবত একজন অবৈধ অভিবাসী, নিউইয়র্ক সিটির তরুণতম মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। এটা এমন এক ঘটনা, যা রূপকথাকেও হার মানায়।
‘হ্যাঁ, আমি বয়সে নবীন। আমি মুসলিম এবং আমি একজন ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্ট। সবচেয়ে বড় কথা, এর কোনোটার জন্যই আমি লজ্জিত নই,’—মঙ্গলবার রাতে (নিউইয়র্ক সময়) ব্রুকলিনে তাঁর বিজয় ভাষণে কয়েক হাজার উৎফুল্ল সমর্থকের প্রতি সহাস্যে এ কথা বলেন মামদানি। উপস্থিত দর্শকদের অধিকাংশই তাঁর মতো নবীন ও অভিবাসী, যাঁদের ভোটে এমন অসম্ভব বিজয় সম্ভব হয়েছে। এক লাখের মতো তরুণ স্বেচ্ছাসেবক সারা শহরের প্রতিটি মহল্লায়, ঘরে হেঁটে মামদানির বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রে মামদানি নিজে তাঁদের সঙ্গ দিয়েছেন। তরুণ প্রজন্মের সদস্যদের নির্বাচনী রাজনীতিতে অংশগ্রহণের এমন নজির এই শহর আগে কখনো দেখেনি।
সেসব স্বেচ্ছাসেবকের দিকে তাকিয়ে মামদানি বলেন, ‘এই বিজয় আমার একার নয়, এই শহরের বহুভাষী, বহু ধর্মের, বহু সংস্কৃতির মানুষের, যাঁদের প্রত্যেকের পরিচয় অভিবাসী হিসেবে।’ নিউইয়র্ক আগে যেমন ছিল এখনো তেমনই অভিবাসীদের শহর। শুধু নতুন হচ্ছে এই যে এখন থেকে এই শহরের নেতৃত্বে থাকবে একজন অভিবাসী।
যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে অশ্বেতকায় অভিবাসীদের বিরুদ্ধে প্রবল প্রচারণার মুখে মামদানির এই বিজয় অনেকের চোখে একটি রাজনৈতিক ভূমিকম্প। শুধু ট্রাম্প প্রশাসন নয়, নিজ দলের নেতৃত্বের বিরোধিতা অগ্রাহ্য করে এই জয় পুরোনো সব হিসাব-নিকাশ উল্টে দিয়েছে।
সর্বশেষ গণনা অনুসারে, ৫০ শতাংশের সামান্য কিছু বেশি ভোটে মামদানি তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী নিউইয়র্কের সাবেক গভর্নর ও স্বতন্ত্র প্রার্থী অ্যান্ড্রু কুমো এবং রিপাবলিকান প্রার্থী কার্টিস স্লিওয়াকে পরাস্ত করেছেন। এই বিজয়কে নিজের প্রগতিশীল কর্মসূচির পক্ষে একটি স্পষ্ট ম্যান্ডেট হিসেবে দাবি করেন মামদানি। শহরের দরিদ্রতম জনগোষ্ঠীকে টেনে তুলতে নিজ কর্মসূচি বাস্তবায়নে গণপ্রশাসনকে ব্যবহার করতে তিনি বদ্ধপরিকর। বিজয় ভাষণে তিনি বলেন, ‘আমরা প্রমাণ করব যে এমন কোনো সমস্যা নেই, যা সরকার সমাধান করতে পারে না। এমন কোনো উদ্বেগ নেই, যা সরকার গুরুত্ব দিয়ে দেখবে না।’
মামদানির প্রচারণার কেন্দ্রে যে অর্থনৈতিক কর্মসূচি তার মূল লক্ষ্য নিউইয়র্ক শহরকে সাধারণ কর্মজীবীদের জন্য অধিক বসবাসযোগ্য করে তোলা। সাধারণ নিউইয়র্কবাসীর জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে এই নিবিড় মনোযোগই মামদানিকে বিজয়ে সাহায্য করেছে। অ্যান্ড্রু কুমো এবং ডেমোক্রেটিক এস্টাবলিশমেন্ট তাঁর কর্মসূচিকে ‘অতি বামপন্থী’ বলে শুধু প্রত্যাখ্যানই করেনি, নানাভাবে ঠেকানোর চেষ্টাও করেছে। তাঁকে ‘মারাত্মক’ ও ক্ষতিকর প্রমাণে প্রচারকাজে প্রায় ৪০ মিলিয়ন ডলার খরচ করা হয়। শহরের ধনীরা অতিরিক্ত করের ভয়ে শহর ছেড়ে পালাবে, এই ভয় অনেকেই দেখিয়েছেন। দেশের মধ্যপন্থী ভোটাররা দল থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, এই যুক্তিতে ডেমোক্রেটিক দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব থেকেও কোনো সমর্থন পাননি। সিনেটে দলের নেতা চাক শুমার তাঁকে অনুমোদন দেননি। প্রতিনিধি পরিষদে ডেমোক্রেটিক নেতা হাকিম জেফ্রিস শেষ মুহূর্তে শুকনো দুকথা বলে তাঁর পিঠ চাপড়ে দিয়েছেন বটে, কিন্তু ভুলেও কোনো নির্বাচনী সভায় মামদানির পাশে দাঁড়াননি।
একমাত্র ব্যতিক্রম দলের প্রগতিশীল ধারার দুই কণ্ঠস্বর সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স ও কংগ্রেস সদস্য আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও-কর্তেজ। স্টেডিয়াম-ভর্তি জনতাকে নিয়ে তাঁরা মামদানির জনসভায় যোগ দিয়েছেন। ওকাসিও-কর্তেজ ও স্যান্ডার্স উভয়েই বলেছেন, তরুণদের অংশগ্রহণে যে অভাবিত রাজনৈতিক আন্দোলন মামদানি গড়ে তুলেছেন, তার ভিত্তিতে ডেমোক্রেটিক পার্টিকে গড়ে তুলতে হবে। সেটি হবে ট্রাম্পের কর্তৃত্ববাদী রাজনীতির সঠিক জবাব। মঙ্গলবার মামদানির বিজয় সভায় সিএনএনকে ওকাসিও-কর্তেজ বলেন, ‘আমরা ট্রাম্পকে ভয় করি না, মামদানির বিজয় তারই প্রমাণ।’
অনেকেই বলছেন, মামদানির উত্থানের ভেতর দিয়ে ডেমোক্রেটিক পার্টির অতি-সতর্ক ও মধ্যপন্থী রাজনীতি প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। এর ফলে দলীয় নেতৃত্বেও বড় ধরনের প্রজন্মগত পরিবর্তনের দাবি এখন আরও জোরদার হবে।
যে কর্মসূচির প্রস্তাব মামদানি করেছেন, তার মধ্যে রয়েছে সরকারি অনুদানে নির্মিত বাড়িভাড়া চার বছরের জন্য বাড়তে না দেওয়া, স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য নতুন ২ লাখ অ্যাপার্টমেন্ট নির্মাণ, সবার জন্য শিশু পরিচর্যা নিশ্চিত করা ও বিনা ভাড়ায় বাসের ব্যবস্থা। তিনি সরকারি ব্যবস্থাপনায় সবজি ও নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যের সরবরাহের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন। এই উচ্চাভিলাষী কর্মসূচির জন্য যে অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন, তা সংগ্রহে মামদানি শহরের অতি ধনী ও করপোরেট ব্যবসায়ের ওপর অতিরিক্ত কর আরোপের কথা বলেছেন।
এই কর্মসূচির জন্য মামদানিকে কমিউনিস্ট ও বদ্ধ উন্মাদ বর্ণনা করে তাঁকে কঠোর ভাষায় আক্রমণ করেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। অবৈধ অভিবাসী সন্দেহে মামদানিকে দেশ থেকে বহিষ্কারের হুমকিও দিয়েছেন তিনি। বলেছেন, এই মামদানি যদি মেয়রের দায়িত্ব পান, তাহলে তিনি নিউইয়র্কের জন্য সব ফেডারেল অনুদান বন্ধ করে দেবেন। যেকোনো উপায়ে তাঁর বিজয় ঠেকাতে ট্রাম্প ভোটের এক দিন আগে অ্যান্ড্রু কুমোর প্রতি সমর্থন জানান। নারীঘটিত কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত হয়ে কুমো গভর্নর পদ থেকে ২০২১ সালে পদত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন।
এ মুহূর্তে ট্রাম্প নিউইয়র্কে তো বটেই, সারা দেশেই প্রবলভাবে সমালোচিত। সর্বশেষ জনমত জরিপ অনুসারে তাঁর নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করেছে ৬৩ শতাংশ আমেরিকান। কুমোর প্রতি তাঁর অনুমোদন সম্ভবত মামদানির জন্য শাপে বরই হয়েছে।
মঙ্গলবার শুধু ভার্জিনিয়া ও নিউ জার্সিতেও নির্বাচন হয়েছে। এই দুই অঙ্গরাজ্যে গভর্নর পদে জয় পেয়েছেন ডেমোক্রেটিক প্রার্থীরা। অন্যদিকে ক্যালিফোর্নিয়ার নির্বাচনী ম্যাপ পরিবর্তনের প্রস্তাব নিয়ে ডেমোক্রেটিক গভর্নর গেভিন ন্যুসামের প্রস্তাবিত একটি গণভোটও জয়যুক্ত হয়েছে। পর্যবেক্ষকদের চোখে প্রতিটি বিজয়ই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রতি মার্কিন ভোটারদের অনাস্থা। এক বছর আগে যে ‘লাল ঢেউ’ ট্রাম্পের বিজয়কে সম্ভব করে, মঙ্গলবার দেশব্যাপী অনুষ্ঠিত ভোটে সেই ঢেউ মিলিয়ে গেছে।
ট্রাম্প অবশ্য এই বিপর্যয়ে নিজের কোনো দোষ দেখতে পাচ্ছেন না। ভোটের ফলাফল দেখে ট্রুথ সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে তিনি বড় বড় অক্ষরে লেখেন, রিপাবলিকানদের ভরাডুবির কারণ দুটি—ব্যালটে ট্রাম্পের নাম না থাকা ও ফেডারেল সরকারের অব্যাহত ‘শাটডাউন’।
এ কথা ঠিক ব্যালটে কোথাও তাঁর নাম ছিল না, কিন্তু অধিকাংশ ভোটার যে ভোট প্রদানের সময় ট্রাম্পের কথা ভেবেছেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ক্ষমতা গ্রহণের সময় তিনি রাতারাতি দ্রব্যমূল্য কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। বাস্তবে ঘটেছে উল্টো, নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্রের দাম মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। এর অন্যতম কারণ ট্রাম্পঘোষিত বাণিজ্যযুদ্ধ। অভিবাসনবিরোধী অভিযানের নামে যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় শহরে ট্রাম্প যেভাবে সামরিক বাহিনী পাঠিয়েছেন, ভোটারদের মনে সেটিও প্রবল প্রত্যাখ্যানের জন্ম দিয়েছে। কংগ্রেসে রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটিক দলের দর-কষাকষির কারণে এক মাসের অধিক সময় ধরে ফেডারেল সরকারের অধিকাংশ কাজকর্ম বন্ধ হয়ে আছে। লাখ লাখ সরকারি কর্মচারীকে বিনা বেতনে ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ভোটারদের চোখে ফেডারেল সরকারের এই অচলাবস্থা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নেতৃত্বের ব্যর্থতা। নির্বাচনী ফলাফলে এই মনোভাবের প্রতিফলন ঘটেছে।
তাঁর বিজয় যে ট্রাম্পের পরাজয়, মামদানি তাঁর বিজয় ভাষণে সে কথা উল্লেখ করতে ভোলেননি। কিছুটা শ্লেষের সঙ্গেই তিনি বলেন, কীভাবে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে পরাস্ত করা যায়, তা যদি কেউ দেখাতে পারে তাহলে সেটি হচ্ছে এই নিউইয়র্ক, যেখানে তাঁর উত্থান হয়েছিল। মামদানির ভাষায়, ‘আমরা শুধু ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ঠেকাতে পারি তা নয়, আমরা ভবিষ্যতের অন্য কোনো ডোনাল্ড ট্রাম্পের উত্থানকেও ঠেকিয়ে দেব।’
এখন থেকে ৫৮ দিন পর আগামী ১ জানুয়ারি মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেবেন মামদানি। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাঁর বিপক্ষে। নিজ দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব তাঁর বিপক্ষে। এই শহরের ধনিক শ্রেণি তাঁর বিপক্ষে। মামদানি সে কথা জানেন। বিজয় ভাষণে তিনি নিজেই স্বীকার করেন, ‘সবাই অনেক আশা নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমরা সে আশা পূরণে প্রস্তুত।’ অ্যান্ডু কুমোর পিতা সাবেক গভর্নর মারিও কুমো একসময় বলেছিলেন, রাজনৈতিক ক্যাম্পেইন করতে চাই কবিতা, কিন্তু প্রশাসনে সফল হতে হলে চাই গদ্য। সে কথা উদ্ধৃত করে মামদানি বলেন, ‘আমরা গদ্যই লিখব, কিন্তু তা লেখা হবে ছন্দে।’
‘যে কথা আমরা সমস্বরে বলেছি, যে স্বপ্ন আমরা যৌথভাবে দেখেছি, সেটাই হবে আমাদের কর্মসূচি, আর তা আমরা বাস্তবায়িত করব সম্মিলিতভাবে। এই শক্তি আপনাদের, এই শহর আপনাদের।’ বলেছেন মামদানি।
তরুণ মামদানি নিজে স্বপ্ন দেখছেন, স্বপ্ন দেখাচ্ছেন নিউইয়র্ক শহরের ৮৫ লাখ মানুষকে।