ট্রাম্পের বিজয়ের এক বছরের মধ্যেই সবখানে প্রতিরোধ
এক পার্কিং এলাকায় মুখোশ পরা আইসিই সদস্যদের গালাগাল করছেন যোগব্যায়ামের পোশাক পরা একজন শ্বেতাঙ্গ নারী। একজন পোপ বারবার অভিবাসীদের পক্ষে কথা বলছেন। মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন, অঙ্গরাজ্য, নগর ও নাগরিকদের করা মামলার ঝড় উঠেছে। কঠোর ভর্ৎসনা করে ট্রাম্প প্রশাসনের বিরুদ্ধে একের পর এক রায় দিচ্ছেন বিচারকেরা। একজন সিনেটর টানা ২৫ ঘণ্টা ধরে অবিরাম কথা বলছেন। আরেকজন তাঁর অপহৃত সংবিধানের কী হয়েছে, তা জানার জন্য এল সালভাদরে উড়ে যাচ্ছেন।
১৮ অক্টোবর ডেমোক্র্যাটদের বড় বড় নীল শহরের পাশাপাশি রিপাবলিকানদের ছোট ছোট লাল শহরেও সব মিলিয়ে ৭০ লাখের মতো মানুষ ‘রাজা চাই না’ আন্দোলনে শরিক হন। রচিত হয় যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে বিক্ষোভের সবচেয়ে বড় দিন।
চলতি বছরে টেসলার শোরুমগুলোর সামনে হওয়া বিক্ষোভ ব্র্যান্ডটির এমন ক্ষতি করে যে এর বৈশ্বিক বিক্রি কমে যায় এবং সিইও ইলন মাস্ক তাঁর সরকারি কর্মদক্ষতা বিভাগ (ডিইওজি) থেকে নেওয়া চাকরিচ্যুতির কঠোর প্রকল্প থেকে পিছু হটেন। কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মীরা কখনো কখনো কেবল আইন, সত্য ও তথ্য মেনে চলার মাধ্যমেই প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। কখনো তাঁরা হুইসেলব্লোয়ার হিসেবে সত্য ফাঁস করছেন, কখনো প্রতিবাদে মুখর হচ্ছেন। যেমন গত আগস্টে সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) কর্মীরা ওয়াকআউট করে জ্যেষ্ঠ কর্মীদের বিক্ষোভে সংহতি জানান। ওই জ্যেষ্ঠ কর্মীরা স্বাস্থ্য ও মানবসেবামন্ত্রী রবার্ট এফ কেনেডি জুনিয়রের টিকাবিরোধী নীতির প্রতিবাদে পদত্যাগ করেছিলেন।
অভিবাসী, শরণার্থী এবং চেহারার কারণে রাস্তায়, শিকাগোর পাড়া-মহল্লায়, হোম ডিপো পার্কিং লটে, স্কুলের আশপাশে ও আদালতে হেনস্তার শিকার হওয়া ব্যক্তিদের নিয়ে তাঁদেরই জন্য অসাধারণ সংহতি গড়ে উঠছে।
ডেমোক্রেটিক পার্টির রাজ্য অ্যাটর্নিরা স্বতন্ত্র ও যৌথভাবে একের পর এক মামলা করছেন। ইলিনয় ও ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নররা লাগাতার সমালোচনায় ট্রাম্পকে ঝাঁজরা করে দিচ্ছেন। কংগ্রেসে বিল আটকে যাওয়ায় সৃষ্ট অচলাবস্থা নিয়ে হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিষয়ক মন্ত্রী ক্রিস্টি নোয়েমের দলীয় প্রচারণামূলক ভিডিও চালাতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে বিমানবন্দরগুলো। যুক্তরাষ্ট্রের সাতটি প্রধান বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাসংক্রান্ত স্বাধীনতায় ছাড় দেওয়ার শর্তে অর্থনৈতিক প্রণোদনা পাওয়ার চুক্তি করতে ট্রাম্প প্রশাসনের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছে।
গত ২০ জানুয়ারি থেকে আমরা ট্রাম্প প্রশাসন এবং এর নীতির বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ দেখছি, এগুলো তারই অংশ। এসব নিয়ে নির্বাচনের বর্ষপূর্তিতে জরিপ হওয়া প্রয়োজন।
যখন কেউ আমাকে বলেন ট্রাম্প প্রশাসনের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিরোধই নেই, আমি ভাবি তারা কি এক ধাক্কায় সরকার ফেলে দেওয়ার মতো গেরিলা বিপ্লবের আশা করছে, নাকি পরিস্থিতির দিকে যথেষ্ট মনোযোগ দিচ্ছে না। কারণ, বাস্তবে নানা ধরনের ব্যাপক প্রতিরোধ ও বিরোধিতা রয়েছে, এগুলো বড় ধরনের প্রভাবও ফেলেছে। কখন এটি যথেষ্ট হবে, সেটি একটি প্রশ্ন। এই প্রশ্নের উত্তর তখনই দেওয়া যাবে, যখন এসবের ইতি হবে, যদি আদৌ তা হয়। এরপর কী ঘটে, সেটাও দেখতে হবে।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রত্যাশা থেকেও বোধ হয় নিরাশা জন্মেছে। মানুষ ভেবেছে, স্বভাবতই একটা বদলের সূচনা হবে। কিন্তু ইতিহাসের মোড়বদল আর গতি যে কখনো অনুমান করা যায় না, সেই বাস্তবতার কথা মানুষ মাথায় রাখেনি।
প্রতিরোধ গড়ে উঠছে সর্বত্র, সব এলাকায় এবং সব ধরনের ভোটারদের মধ্যে। আছে নাগরিক সমাজ ও সরকারি কর্মচারীরা। রয়েছে মানবাধিকার, জলবায়ু ও পরিবেশ নিয়ে কাজ করা গোষ্ঠীগুলো, যারা নির্বাচনের আগেই আটঘাট বেঁধে রেখেছিল আর নতুন প্রশাসন আসার পরই মাঠে নেমে পড়ে। আরও আছে ধর্মীয় নেতা ও প্রতিষ্ঠান, সব স্তরের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, সামরিক কর্মকর্তা, আইনজীবী ও বিচারক। আরও আছে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী, গ্রন্থাগারিক, চিকিৎসক, সাংবাদিক, সম্পাদক, প্রকাশক, শিল্প-সংস্কৃতির জগতের মানুষ।
অবশ্যই এই মানুষদের মধ্যেও লজ্জাজনক দালালি, আত্মসমর্পণ ও নীরবতার দৃষ্টান্ত রয়েছে। লক্ষণীয় যে এই সংকটকালে প্রায়ই সবচেয়ে ধনী এবং ক্ষমতাবানেরা সবার আগে আত্মসমর্পণ করেছেন। অভিজাত নন এমন মানুষেরাই নীতিতে অটল থেকেছেন, এমনকি ঝুঁকি নিয়ে হলেও।
বিরোধীদের বিরোধিতার কেন্দ্র কী হবে, সেটি আগে স্পষ্ট ছিল না। চাকরিচ্যুতি নিয়ে ডিওজিইর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ এবং টেসলা প্রত্যাহারের দাবিতে কর্মসূচিগুলো ছিল মূলত কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর প্রশাসন ও মাস্কের আক্রমণের প্রতিক্রিয়া। আন্দোলনে অংশ নেওয়া ব্যক্তিবর্গ ও সংগঠনগুলো নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে শুরু করে প্রজনন অধিকার পর্যন্ত সবকিছুই রক্ষার চেষ্টা করছে। তবে সক্রিয় প্রতিরোধের কেন্দ্রে রয়েছে সেই সব মানুষের সঙ্গে সংহতি, যারা সীমান্তরক্ষী, আইসিই এবং অন্যান্য সংস্থার নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। এই সংস্থাগুলোকে ত্রাস সৃষ্টি, নির্মমতা, অপহরণ ও দেশজুড়ে অধিকার লঙ্ঘনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
নানাভাবে এই সংহতির প্রকাশ ঘটছে। স্বেচ্ছাসেবকেরা অভিবাসী ও শরণার্থীদের সুরক্ষা দিতে তাঁদের সঙ্গে অভিবাসন আদালতে যাচ্ছেন। প্রতিবেশীরা ঘর থেকে বের হতে ভয় পাওয়া অভিবাসীদের ছেলে-মেয়েদের স্কুলে পৌঁছে দিচ্ছেন। এ ছাড়া পোর্টল্যান্ডে আইসিএয়ের সামনে, ওরেগনে বিক্ষোভ এবং লস অ্যাঞ্জেলেস, ওয়াশিংটন ডিসি ও শিকাগোজুড়ে মহল্লাভিত্তিক কর্মসূচি পালিত হচ্ছে।
নিউইয়র্ক ম্যাগাজিনের প্রতিবেদনে সারাহ কনওয়ে লিখেছেন, শিকাগোর সাধারণ বাসিন্দারা তাঁদের অবসর সময়ে বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে ছুটি নিয়ে দ্রুত সাড়া দেওয়ার দল গড়ে তুলেছেন। তাঁরা রাস্তায় নজর রাখেন এবং ফেডারেল এজেন্টদের গতিবিধি অনুসরণ করেন। কেউ কেউ পানশালায় ও লন্ড্রিতে বাঁশি বাজিয়ে সতর্ক করেন। অন্যরা হোম ডিপো আর মেক্সিকান রেস্তোরাঁর বাইরে তীক্ষ্ণ নজর রাখেন।
আন্দোলনকর্মীরা শহরতলির যেসব হোটেলে কেন্দ্রীয় সরকারের এজেন্টরা থাকেন, সেগুলো খুঁজে বের করছেন এবং সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করছেন। কেউ কেউ পায়ে হেঁটে, গাড়িতে এবং বাইকে চড়ে পালা করে তাঁদের মহল্লা পাহারা দিচ্ছেন, ফেডারেল এজেন্টদের উপস্থিতির ব্যাপারে প্রতিবেশীদের সতর্ক করছেন। তাঁরা এজেন্টদের আগ্রাসী কৌশল এবং গ্রেপ্তার নিয়ে প্রমাণ সংরক্ষণ করছেন।
ক্যাথলিক চার্চও মাঠে নেমেছে। চার্চে আসতে ভয় পাওয়া অভিবাসীদের প্রতিনিধিত্ব বোঝাতে বেঞ্চে কার্ডবোর্ডে তৈরি প্রতিকৃতি রেখেছে মিডওয়েস্টার্ন চার্চ। শিকাগোতে জন্ম নেওয়া পোপ লিও চতুর্দশ সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছেন বলে মনে হচ্ছে। তিনি বারবার দরিদ্র ও অভিবাসীদের পক্ষে কথা বলেছেন। যদিও শুধু ক্যাথলিকরাই নন, অন্যান্য চার্চের যাজকেরা, ইহুদি যাজকেরাও বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন। ২০০ জনের বেশি পাদরি একটি চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন, যার শিরোনাম হলো, ব্রডভিউতে যিশুর ওপর কাঁদানে গ্যাস ছোড়া হচ্ছে। বহু নগর কর্তৃপক্ষ নিজেদের শরণার্থীদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র ঘোষণা করেছে এবং আইসিএর সঙ্গে সহায়তা করা তাদের নীতি নয় বলে ঘোষণা দিয়েছে।
রিপাবলিকান দলের একজন তহবিল সংগ্রাহকের পদ ত্যাগ করার সময় মাইলস ব্রুনার বুলওয়ার্কে লিখেছেন, ‘আমি রিপাবলিকান পার্টি ত্যাগ করছি এবং কর্তৃত্ববাদী সংঘে পরিণত হতে যাওয়া দলকে সহায়তা করার চাকরি ছেড়ে দিচ্ছি।’ সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগের ব্যাখ্যায় মেরিন কর্নেল ডাউগ ক্রুগম্যান ওয়াশিংটন পোস্টে লিখেছেন, ‘সংবিধান মেনে কাজ করা বা এটিকে সংশোধনের বদলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পরীক্ষা করতে চাইছেন, তিনি কত দূর পর্যন্ত এটিকে উপেক্ষা করে চলতে পারেন।’
গত মাসে কোনো কারণ জানানো ছাড়াই পদত্যাগ করেন নৌবাহিনীর দক্ষিণাঞ্চলীয় কমান্ডের অ্যাডমিরাল। তবে ব্যাপকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, ক্যারিবীয় সাগরে ছোট ছোট নৌকায় মানুষ হত্যার হামলার প্রতিক্রিয়ায় তিনি এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সাবেক সেনাদের সংগঠন ‘এবাউট ফেইস’ ৪ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা দিবসে নতুন একটি প্রচারণা শুরু করেছে। এর উদ্দেশ্য হলো বেআইনি আদেশ পালনে অস্বীকৃতি জানানো সেনাদের পাশে থাকা এবং তাদের উৎসাহিত করা।
অহিংস আন্দোলনে বর্জন বা বয়কট সব সময়ই শক্তিশালী কৌশল। টেসলা, টার্গেট ও ডিজনিকে বর্জন কার্যকর প্রভাব ফেলেছে। আইসিইতে যোগ দেওয়ার বিজ্ঞাপন চালানোয় স্পটিফাইয়ের বিরুদ্ধে বয়কট কর্মসূচি চালু করেছে ইনিডিভিজিবল নামের প্রগতিশীল আন্দোলন। অতি ডান অধিকারকর্মী চার্লি কার্কের হত্যাকাণ্ড নিয়ে মৃদু মন্তব্য করে চাকরি হারান লেটনাইট হোস্ট জিমি কিমেল।
কখনো কখনো প্রশাসনের কাছে আত্মসমর্পণ ভেতরে প্রতিরোধ উসকে দেয়। যেমন কিছু আইনজীবী বড় আইনি প্রতিষ্ঠান থেকে চাকরি ছেড়েছেন, কেননা প্রতিষ্ঠানগুলো চলতি বছরের শুরুতে প্রশাসনের প্রতি নুয়ে পড়েছিল। ওয়াশিংটন পোস্ট এবং আরও কিছু প্রকাশনা ডানপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়ায় অনেক সাংবাদিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে চাকরি ছেড়েছেন। জনগণকে তথ্য জানাতে ও সম্পৃক্ত রাখতে স্বাধীন, ছোট, বিকল্প গণমাধ্যমগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
নতুন প্রশাসন ক্ষমতা নেওয়ার পর থেকে ইনডিভিজিবল আন্দোলনে সদস্যসংখ্যা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। ট্রাম্পের শপথ নেওয়ার পরপর আরও বেশি আন্দোলনের লক্ষ্যে যাত্রা শুরু করে ৫০৫০১ নামে আরেকটি সংগঠন। আরও অনেক স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে উঠেছে। ট্রাম্প প্রতিরোধ আন্দোলন ও প্রগতিশীলদের ঢালাওভাবে ‘অভ্যন্তরীণ শত্রু’ আখ্যা দিয়েছেন। অথচ মানবাধিকার, আইনের শাসন, ক্ষমতার ভারসাম্য এবং সংবিধান, ভোটাধিকার ও সুষ্ঠু নির্বাচনের, বিজ্ঞান ও ইতিহাসের শত্রুরা আসলে রয়েছে আংশিকভাবে ধসে পড়া হোয়াইট হাউসের ভেতরে। এই দেশের যদি কোনো ভবিষ্যৎ থাকে, তবে সেটি রাস্তায়, আদালতে, আন্দোলনে এবং এই প্রশাসনের বিরুদ্ধে অব্যাহত বাক্স্বাধীনতা ও জনসমাবেশের স্বাধীনতা চর্চায়।
রেবেকা সোলনিট দ্য গার্ডিয়ানের যুক্তরাষ্ট্র-বিষয়ক একজন কলামিস্ট। তিনি ‘অরওয়েল’স রোজেস’ বইয়ের লেখক এবং ‘নট টু লেইট: চেঞ্জিং দ্য ক্লাইমেট স্টোরি ফ্রম ডেসপায়ার টু পসিবিলিটি’ বইয়ের সহসম্পাদক।