ফিরে দেখা
ক্লিনটনের সঙ্গে সম্পর্কের কথা সহকর্মীকে বলে সর্বনাশ ডেকে আনলেন মনিকা
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সঙ্গে মনিকা লিউনস্কির যৌন কেলেঙ্কারির ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রসহ পুরো বিশ্বে হইচই ফেলে দিয়েছিল। এর জেরে ১৯৯৮ সালের ৮ অক্টোবর কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদে ক্লিনটনের বিরুদ্ধে অভিশংসনের তদন্ত শুরুর প্রস্তাব পাস হয়। অবশ্য সিনেটের ভোটাভুটিতে তিনি শেষ পর্যন্ত বেঁচে যান। সেই ঘটনা ধরে পাঠকদের জন্য আজ এই লেখা।
শুরুটা হয়েছিল ১৯৯৫ সালের জুন মাসে। ওয়াশিংটনে পা রাখেন ২১ বছরের সুন্দরী তরুণী মনিকা লিউনস্কি। ইন্টার্ন হিসেবে যোগ দেন হোয়াইট হাউসে। তখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন। দেশজুড়ে তুমুল জনপ্রিয়তা তাঁর। সে সময় কেউ কি ভেবেছিলেন, মনিকাকে ঘিরেই জীবনের সবচেয়ে বড় সংকটের মধ্যে পড়তে যাচ্ছেন প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন?
সংকটের মূলে ছিল বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক। তা–ও আবার ২৮ বছরের ছোট মনিকার সঙ্গে। দুজনের শারীরিক সম্পর্কও হয়েছিল। সবকিছু ঘটেছিল হোয়াইট হাউসেই—গোপনে। তবে সত্য তো চাপা থাকে না। একান-ওকান ঘুরে শেষ পর্যন্ত প্রকাশ পেয়েছিল। আর মনিকার নীল রঙের একটি পোশাক ঘিরে এমন এক প্রমাণ সামনে এসেছিল, যার ফলে চাইলেও সত্যটা ছুড়ে ফেলতে পারেননি ক্লিনটন।
মনিকার সঙ্গে ক্লিনটনের প্রণয় হয়েছিল প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর প্রথম মেয়াদে। দ্বিতীয় মেয়াদে ১৯৯৮ সালে তা চাউর হয়। যুক্তরাষ্ট্রে ঘরে-বাইরে, অফিস-আদালতে তখন আলোচনার যেন একটিই বিষয় ছিল—ক্লিনটন-মনিকা প্রেম। নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট ও টাইমের মতো নামীদামি পত্রিকায় দিনের পর দিন শিরোনাম হয়েছিল দুজনের এই সম্পর্কের খবর।
দুজনের প্রেম পরিচিতি পায় ‘ক্লিনটন-মনিকা স্ক্যান্ডাল’ বা ‘ক্লিনটন-মনিকা কেলেঙ্কারি’ নামে। এই কেলেঙ্কারি ঘিরে ১৯৯৮ সালের আজকের এই দিনে (৮ অক্টোবর) ক্লিনটনের অভিসংশনের জন্য তদন্ত শুরু করার প্রস্তাব পাস হয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদে। সে বছরের ১৯ ডিসেম্বর পরিষদে অভিশংসিত হন প্রেসিডেন্ট। যদিও শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা ছাড়তে হয়নি তাঁকে।
মনিকার সঙ্গে ক্লিনটনের প্রেমের বিষয়টি কে ফাঁস করলেন, কীভাবে এ তথ্য পেয়েছিলেন গোয়েন্দারা, কী ছিল সেই নীল পোশাকে, যা পুরো তদন্তের মোড় বদলে দিয়েছিল; আর কেনই–বা প্রতিনিধি পরিষদে অভিশংসিত হওয়ার পরও ক্ষমতায় টিকে গিয়েছিলেন ক্লিনটন—চলুন জেনে নেওয়া যাক এসব প্রশ্নের জবাব।
সহকর্মীর সঙ্গে গল্পেই ‘সর্বনাশের’ সূত্রপাত
মনিকা লিউনস্কির জন্ম ১৯৭৩ সালের ২৩ জুলাই—ক্যালিফোর্নিয়ার সান ফ্রান্সিসকো শহরে। ১৯৯৫ সালে অরেগনের লুইস অ্যান্ড ক্লার্ক কলেজ থেকে মনোবিদ্যায় স্নাতক শেষ করে সে বছরেই ইন্টার্ন হিসেবে হোয়াইট হাউসে চাকরি শুরু করেন। সেখানে ছিলেন ১৯৯৬ সালের এপ্রিল পর্যন্ত। এই সময়ে প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের সঙ্গে তাঁর বেশ কয়েকবার শারীরিক সম্পর্ক হয়েছিল।
অনলাইন পোর্টাল দ্রুজ রিপোর্টের একটি প্রতিবেদন বেশ সাড়া ফেলে। তাতে বলা হয়েছিল, ক্লিনটনের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কের সময় পরে থাকা একটি পোশাক সংরক্ষণ করে রেখেছেন মনিকা।
কথা প্রচলিত আছে, মনিকার সঙ্গে কয়েকবার শারীরিক সম্পর্কের সময় হোয়াইট হাউসেই ছিলেন ক্লিনটনের স্ত্রী হিলারি ক্লিনটন। তবে বিষয়টি হয়তো জানতে পারেননি তিনি। ক্লিনটনের সঙ্গে মনিকার অত্যধিক মাখামাখির বিষয়টি চোখে পড়ে হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তাদের। এর জেরে হোয়াইট হাউস থেকে তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগনে। সেখানে তাঁর সখ্য হয় লিন্ডা ট্রিপ নামের একজন নারী সহকর্মীর সঙ্গে।
মনিকা-লিন্ডা বন্ধুত্ব এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে ব্যক্তিগত খুঁটিনাটি বিষয় নিয়েও আলাপ করতেন। ১৯৯৭ সালে এমনই এক আলাপে ভুল করে বসেন মনিকা। লিন্ডার কাছে নিজের প্রেমকাহিনি ফাঁস করেন তিনি। ক্লিনটনের সঙ্গে শারীরিক সর্ম্পকের সময় পরনে থাকা একটি নীল পোশাকের কথাও বলেন। লিন্ডা আবার সে কথা জানান লুসিয়ান গোল্ডবার্গ নামে তাঁর পরিচিত এক লেখিকাকে।
গোল্ডবার্গ ছিলেন ক্লিনটনবিরোধী, এরপর আবার ক্লিনটনের দল ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রতিপক্ষ রিপাবলিকান পার্টির সমর্থক। তাঁর পরামর্শেই ক্লিনটনকে নিয়ে মনিকার সঙ্গে নিজের ফোনালাপ রেকর্ড শুরু করেন লিন্ডা। এভাবে মোটমুটি ২০ ঘণ্টার ফোনালাপ রেকর্ড করেছিলেন তিনি। পাশাপাশি মনিকাকে পরামর্শ দেন, ওই নীল পোশাক যেন পরিষ্কার না করা হয়।
৩ আগস্ট ক্লিনটনের শরীর থেকে রক্তের নমুনা নিয়ে ডিএনএ পরীক্ষা করা হয়। ওই ডিএনএ মিলে যায় নীল পোশাকের ওপর পাওয়া শুক্রাণুর ডিএনএর সঙ্গে।
এভাবেই ক্লিনটন-মনিকা কেলেঙ্কারির তথ্য বাইরের মানুষদের মধ্যে প্রথম কানে গিয়েছিল লিন্ডার। ২০০১ সালে ক্লিনটনের ক্ষমতা ছাড়ার দিনই তাঁকে পেন্টাগনের চাকরি থেকে ছাঁটাই করা হয়। চাকরি হারানোর পর ভার্জিনিয়ায় স্বামীর সঙ্গে একটি দোকান খোলেন। ২০২০ সালে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় তাঁর।
লিন্ডার ওই ফোনকল রেকর্ডের সূত্র ধরেই ক্লিনটনের কেলেঙ্কারির বিষয়টি সামনে এসেছিল। এ জন্য তিনি রিপাবলিকান সমর্থকদের কাছে নায়ক বনে গিয়েছিলেন। বিভিন্ন দিক থেকে হুমকিও পেতে হয়েছিল। পেন্টাগনের চাকরি হারানোর দিন এক সাক্ষাৎকারে লিন্ডা বলেছিলেন, ‘দেশপ্রেমিক হিসেবে যা নিজের কর্তব্য বলে মনে করেছি, তা করতে পারাটা আমার কাছে সার্থকতা ছিল।’
‘কাঠগড়ায়’ মনিকা
ক্লিনটন-মনিকা প্রেমকাহিনি যখন সবে একান-ওকান হওয়া শুরু করেছে, তখন কিন্তু ক্লিনটনের বিরুদ্ধে আরও একটি যৌন হয়রানির অভিযোগ ছিল। ১৯৯৪ সালে ওই অভিযোগ এনেছিলেন পলা জোনস নামের একজন সরকারি কর্মচারী। তখনো প্রেসিডেন্টের পদে বসেননি ক্লিনটন। দায়িত্বে ছিলেন আরকানসাসের গভর্নর হিসেবে। বিষয়টি আদালতে গড়িয়েছিল।
আদালতে পলা জোনস অভিযোগ করেছিলেন, ১৯৯১ সালের মে মাসে আরকানসাসের একটি হোটেলের কক্ষে তাঁকে যৌন হয়রানি করেছিলেন ক্লিনটন। এতে মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তিনি। এ মামলায় পলা জোনসের আইনজীবীরা লিন্ডা ট্রিপের রেডর্ক করা সেই ফোনালাপগুলো আদালতে উপস্থাপন করেন। এর পেছনেও ছিলেন লিন্ডার পরিচিত ক্লিনটনবিরোধী লেখিকা লুসিয়ান গোল্ডবার্গ।
কেলেঙ্কারির মধ্যেও কিন্তু তখন ক্লিনটনের জনপ্রিয়তা কমেনি। সে বছরের সেপ্টেম্বর মাসেই একটি জরিপ চালিয়েছিল সিএনএন, ইউএসএ টুডে ও গ্যালপ। তাতে দেখা যায়, এমন ডামাডোলের মধ্যেও প্রেসিডেন্টে জনপ্রিয়তা বেড়ে বরং ৬৪ শতাংশ হয়েছে।
এর জেরে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয় মনিকাকে। তবে ১৯৯৮ সালের ৭ জানুয়ারি এক হলফনামায় তিনি জানান, ক্লিনটনের সঙ্গে কখনোই তাঁর যৌন সম্পর্ক হয়নি। দিন দশেক পর আদালতে দেওয়া এক জবানবন্দিতে একই কথা বলেন ক্লিনটনও। সে মাসের শেষের দিকে পলা জোনসের মামলা থেকে ক্লিনটন-মনিকা কেলেঙ্কারির বিষয়টি বাদ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন আদালত।
জানুয়ারি মাসেই অনলাইন পোর্টাল দ্রুজ রিপোর্টের একটি প্রতিবেদন বেশ সাড়া ফেলে। তাতে বলা হয়েছিল, ক্লিনটনের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কের সময় পরে থাকা একটি পোশাক সংরক্ষণ করে রেখেছেন মনিকা। সেটি যে মনিকার সেই নীল পোশাক, তা নিয়ে অবশ্য কিছু বলা হয়নি প্রতিবেদনে। দ্রুজ রিপোর্টের ওই খবর ফলাও করে প্রকাশ করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের মূলধারার গণমাধ্যমগুলো।
এমন খবর প্রকাশের পর মনিকার বেশ কিছু পোশাকের ডিএনএ পরীক্ষা করে দেখেছিল গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই। তবে সেগুলোয় শারীরিক সম্পর্কের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। দ্রুজের খবর নাকচ করে দিয়ে ক্লিনটনও তখন জোর গলায় বলেছিলেন, ‘লিউনস্কি নামের ওই নারীর সঙ্গে আমার যৌন সম্পর্ক হয়নি।’ আর একে ‘ডানপন্থীদের ষড়যন্ত্র’ বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন হিলারি।
আসল বিপদ
পলা জোনসের মামলাটি ক্লিনটন চাপা দিয়েছিলেন আদালতের বাইরে। মামলার রায় হওয়ার আগে ১৯৯৮ সালের নভেম্বরে ৮ লাখ ৫০ হাজার ডলারের বিনিময়ে জোনসের সঙ্গে একটি সমঝোতায় পৌঁছান তিনি। ফলে জোনস মামলাটি তুলে নেন। আর মনিকার সঙ্গে প্রেমের জেরে এই মামলায় তাঁর জড়িয়ে পড়ার যে ঘটনা ঘটেছিল, তা আগেই খারিজ করে দিয়েছিলেন আদালত।
তবে ক্লিনটনের বিপদ ঘনিয়ে আসছিল আরও একদিক দিয়ে। পলা জোনসের মামলা যখন চলছিল, তখন ‘হোয়াইটওয়াটার’ নামে একটি ব্যবসা উদ্যোগে ক্লিনটন ও হিলারির সংশ্লিষ্টতা নিয়ে তদন্ত করছিলেন স্বাধীন কাউন্সেল কেনেথ স্টার। তবে তেমন একটা সুবিধা করে উঠতে পারছিলেন না। তখন লিন্ডা ট্রিপের মাধ্যমে তাঁর হাতে আসে ক্লিনটনকে নিয়ে মনিকার সেই কলরেকর্ডগুলো।
নড়েচড়ে বসেন স্টার। ওই কলরেকর্ডগুলো থেকে প্রমাণ মেলে, এত দিন শারীরিক সম্পর্ক নিয়ে ক্লিনটন ও মনিকা যা বলে আসছেন, তার সবই মিথ্যা। আদালতের সামনেও তাঁরা মিথ্যা জবানবন্দি দিয়েছেন। এরপর মনিকাকে ঘিরে আরও বড় জাল পাতেন স্টার। সে অনুযায়ী ভার্জিনিয়ার আর্লিংটন এলাকায় রিজ-কার্লটন হোটেলে মনিকাকে ডেকে নেন লিন্ডা ট্রিপ।
ওই হোটেলে মনিকার পেট থেকে ক্লিনটনের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে আরও হাঁড়ির খবর বের করে নেন লিন্ডা। তাঁর সঙ্গে ছিল গোপন একটি মাইক্রোফোন। দুজনের পুরো কথোপকথনই রেকর্ড করে এফবিআই। কেনেথ স্টারই তাঁদের সে নির্দেশ দিয়েছিলেন। পরে প্রেসিডেন্টের প্রেমের বিষয়টি আদালতে তোলেন তিনি।
পলা জোনসের মামলায় আদালতে মনিকা মিথ্যা হলফনামা দিয়েছেন কি না, তা খতিয়ে দেখার অনুমতি চান। আদালতের সায় মেলে। তারিখটা ১৯৯৮ সালের ১৬ জানুয়ারি।
এবার মনিকাকে বেশ আঁটসাঁট করে ধরার পরিকল্পনা করা হয়। তাঁর মা মার্সিয়া লুইসকে টানা তিন দিন ধরে জেরায় জেরায় জেরবার করে ছাড়ে কেনেথ স্টারের দল। অভিযোগ তোলা হয়, পলা জোনসের মামলায় মনিকা যে মিথ্যা হলফনামা দিয়েছেন, তার জন্য লুইসই দায়ী।
মনিকা ও তাঁর মা–বাবাকে বিচারের মুখোমুখি করার হুমকিও দেয় কেনেথ স্টারের দল। এমন পরিস্থিতিতে স্টারের সঙ্গে একটি চুক্তিতে যান মনিকা। সে অনুযায়ী ক্লিনটনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিলে পূর্ণ দায়মুক্তি পাবেন তিনি। ১৯৯৮ সালের ৬ আগস্ট থেকে আদালতে সাক্ষ্য দেওয়া শুরু করেন মনিকা।
নীল পোশাকে মিলল হিসাব
চুক্তি মেনে ক্লিনটনের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কের প্রমাণ হিসেবে সেই নীল পোশাকও কেনেথ স্টারের কাছে তুলে দেন মনিকা। সেটাও সাক্ষ্য শুরুর আগেই, ২৯ জুলাই। লিন্ডা ট্রিপের পরামর্শে ওই পোশাক একবারও পরিষ্কার করেননি মনিকা।
৩ আগস্ট ক্লিনটনের শরীর থেকে রক্তের নমুনা নিয়ে ডিএনএ পরীক্ষা করা হয়। ওই ডিএনএ মিলে যায় নীল পোশাকের ওপর পাওয়া শুক্রাণুর ডিএনএর সঙ্গে। এরপর মনিকার সঙ্গে প্রেমের বিষয়টি অস্বীকার করার আর উপায় ছিল না ক্লিনটনের।
ওই নীল পোশাক কেনেথ স্টারের দপ্তরেই ছিল। ১৯৯৯ সালে এক সাক্ষাৎকারে সংবাদমাধ্যম এবিসিকে মনিকা বলেছিলেন, পোশাকটিকে নিজের জন্য বড় অপমান হিসেবে দেখেন তিনি। কখনো যদি সেটি ফেরত পান, পুড়িয়ে ফেলবেন। ফিরে তিনি অবশ্য পেয়েছিলেন। সেটি ২০০১ সালের জুলাই মাসে। সঙ্গে পেয়েছিলেন আরও কিছু জিনিস।
সেগুলোর মধ্যে ছিল ক্লিনটনের দেওয়া আরও কিছু উপহার—একটি হ্যাটের পিন, একটি কম্বল, মার্বেল পাথরের তৈরি একটি ভালুকের মুর্তি এবং মার্কিন কবি ওয়াল্ট হুইটম্যানের কাব্যগ্রন্থ ‘লিভস অব গ্রাস’-এর একটি বিশেষ সংস্করণ।
তবে যে নীল পোশাক নিয়ে আলোচনা, সেটির শেষ পর্যন্ত কী গতি হয়েছিল, তা জানা যায়নি। সর্বশেষ ২০১৪ সালে ভ্যানিটি ফেয়ার সাময়িকীতে মনিকা লিখেছিলেন, ‘নীল পোশাকটি কবর দেওয়ার সময় এসেছে।’
এবং অভিশংসন
মনিকার পর ১৯৯৮ সালের ১৭ আগস্ট আদালতে জবানবন্দী দেন ক্লিনটন। তবে পলা জোনসের মামলার মতো এবার আর প্রেমের সম্পর্কের বিষয়টি অস্বীকার করার উপায় ছিল না। বড় মুখ করে নিজের পক্ষে সাফাইও গাননি। হোয়াইট হাউসের ম্যাপরুমে বসে চার ঘণ্টা ধরে দেওয়া ওই সাক্ষাৎকারে মনিকার সঙ্গে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের বিষয়টি স্বীকার করে নেন।
সেদিন সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন ক্লিনটন। সেখানেও প্রেমের বিষয়টি তুলে ধরেন তিনি। তবে একবারের জন্যও ‘শারীরিক সম্পর্ক’ শব্দটি ব্যবহার করেননি তিনি। আর এর জন্য অনুতাপ—সে তো দূরের বিষয়। ভাষণে মাত্র একবার ‘অনুতপ্ত’ হওয়ার কথা বলেছিলেন তিনি। তা–ও জাতি ও নিজ পরিবারকে ভুল পথে নেওয়ার জন্য।
এরপর এক মাসের কম সময়ের মধ্যে মার্কিন কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন কেনেথ স্টার। তা ছিল আকারে বিশাল। প্রতিবেদনের নথিপত্র বহন করতে ১৮টি বাক্স লেগেছিল। প্রতিবেদনে ১১টি অভিযোগের ভিত্তিতে ক্লিনটনকে অভিশংসন করার প্রস্তাব দেওয়া হয়।
এসব অভিযোগের মধ্যে ছিল মিথ্যা জবানবন্দি দেওয়া, বিচারকাজে বাধা দেওয়া, সাক্ষীদের প্ররোচিত করা এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের মতো বিষয়। পাশাপাশি তুলে ধরা হয় ক্লিনটন-মনিকা প্রেমকাহিনির আদ্যোপান্ত।
এমন কেলেঙ্কারির মধ্যেও কিন্তু ক্লিনটনের জনপ্রিয়তা কমেনি। সে বছরের সেপ্টেম্বর মাসেই একটি জরিপ চালিয়েছিল সিএনএন, ইউএসএ টুডে ও গ্যালপ। তাতে দেখা যায়, এমন ডামাডোলের মধ্যেও প্রেসিডেন্টে জনপ্রিয়তা বেড়ে বরং ৬৪ শতাংশ হয়েছে। এর বিপরীতে ৩১ শতাংশ মার্কিন মনে করতেন, তাঁকে অভিশংসন করা উচিত। ৩৬ শতাংশ ছিলেন পদত্যাগের পক্ষে।
সে যা–ই হোক, ১৯৯৮ সালের ১৯ ডিসেম্বর প্রতিনিধি পরিষদে অভিশংসিত হন ক্লিনটন। এরপর সিনেটের পালা। পরের বছরের ৭ জানুয়ারি ক্লিনটনের অভিশংসন নিয়ে সিনেটে শুনানি শুরু হয়। একে ঐতিহাসিক দিন বলা চলে। কারণ, ১৮৬৮ সালে প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রু জনসনের অভিশংসনের শুনানির পর যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে এমন ঘটনা আর কখনো ঘটেনি।
পাঁচ সপ্তাহ পর ১২ ফেব্রুয়ারি দুটি অভিযোগের ভিত্তিতে ক্লিনটনের অভিশংসনের বিষয়ে সিনেটে ভোটাভুটি হয়। মিথ্যা সাক্ষ্যের অভিযোগে তিনি দোষী সাব্যস্ত হননি বলে ভোট দেন সিনেটের ১০০ সদস্যের মধ্যে ৫৫ জন। তাঁদের মধে ৪৫ জন ছিলেন ডেমোক্র্যাট, আর ১০ জন ছিলেন রিপাবলিকান।
বিচারকাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে ক্লিনটনের পক্ষে-বিপক্ষে ভোট পড়ে সমান সমান ৫০টি করে। ফলে শেষ পর্যন্ত মুখ রক্ষা হয় তাঁর। অভিশংন থেকে বেঁচে যান তিনি। পরদিন সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্ট প্রথম পাতাজুড়ে এই খবর প্রকাশ করেছিল। শিরোনাম ছিল—‘ক্লিনটন খালাস পেয়েছেন’।
‘বলির পাঁঠা’ মনিকা
এরপর নিজের মেয়াদের শেষ সময় ২০০১ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন ক্লিনটন। ২০০৪ সালে সিবিএসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার এ কাজ (মনিকার সঙ্গে প্রেম) করার পেছনের কারণ ছিল খুবই বাজে। সুযোগ ছিল বলেই এমন কাজটি করেছি। মনে করি, কোনো কাজ করার সুযোগ আছে বলেই সেটি করে ফেলা সবচেয়ে বাজে কাজ।’
মনিকার সঙ্গে প্রেমের সময় ক্লিনটনের বয়স ছিল ৪৯ বছর। ৩০ বছর পর এখন বয়স ৭৯। বিংশ শতাব্দীতে দায়িত্ব পালন করা একমাত্র জীবিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট তিনি। এত বয়সেও নিজের প্রতিষ্ঠিত সংগঠন ক্লিনটন ফাউন্ডেশন ও ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভের পেছনে সময় দিয়ে যাচ্ছেন। এ ছাড়া ‘সিটিজেন: মাই লাইফ আফটার দ্য হোয়াইট হাউস’ শিরোনামে গত বছর তাঁর লেখা একটি বইও প্রকাশিত হয়েছে।
আর মনিকার বয়স এখন ৫১ বছর। লেখিকা, চলচ্চিত্র প্রযোজক ও অধিকারকর্মী হিসেবে কাজ করছেন। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ‘কল হার ড্যাডি’ শিরোনামে একটি পডকাস্টে কথা বলেছিলেন তিনি।
সেখানে পুরোনো দিনের স্মৃতিচারণা করে মনিকা বলেছিলেন, ক্লিনটনের সত্যবাদী হওয়া উচিত ছিল। স্বার্থপরভাবে তাঁকে বলির পাঁঠা না বানিয়ে অন্য একটি উপায় খুঁজে বের করা উচিত ছিল তৎকালীন প্রেসিডেন্টের।
তথ্যসূত্র: টাইম সাময়িকী, হিস্টোরি চ্যানেল, হিস্টোরি ডটকম, এবিসি নিউজ, বিবিসি