ভেনেজুয়েলা নিয়ে ট্রাম্প কী লক্ষ্য অর্জন করতে চান

শক্তি প্রদর্শনে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহী রণতরি ইউএস জেরাল্ড আর ফোর্ড (সিভিএন-১৮) ভেনেজুয়েলার জলসীমায় পাঠানো হচ্ছে।ফাইল ছবি: রয়টার্স

দুই মাস ধরে যুক্তরাষ্ট্র ক্যারিবীয় সাগরে কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় সামরিক সমাবেশ ঘটাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র বলছে, মাদকের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য এ আয়োজন। কিন্তু ওয়াশিংটনের প্রকৃত উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে কারাকাসকে বার্তা দিতে চায়।

যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে ছোট ছোট নৌযানে হামলা চালিয়ে কয়েকজনকে হত্যা করেছে। এই হামলাগুলোকে ঘিরে লাতিন আমেরিকা অঞ্চলজুড়ে নিন্দার ঝড় উঠেছে। বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলেছেন এর বৈধতা নিয়ে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকাণ্ড আসলে ইঙ্গিত দিচ্ছে—ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলা মাদুরোকে ভয় দেখাতে অভিযান চালানো হচ্ছে।

লন্ডনভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান চ্যাথাম হাউসের লাতিন আমেরিকা-বিষয়ক সিনিয়র ফেলো ক্রিস্টোফার সাবাতিনি বলেন, এটি মূলত সরকার পরিবর্তনের প্রচেষ্টা। তারা হয়তো সরাসরি আগ্রাসনে যাবে না, বরং শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে বার্তা দিতে চায়।

সাবাতিনির মতে, এই সামরিক আয়োজন আসলে শক্তি প্রদর্শন। এর উদ্দেশ্য ভেনেজুয়েলার সেনাবাহিনী ও মাদুরোর ঘনিষ্ঠ মহলে ভয় সৃষ্টি করা, যাতে তারা তাঁর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প
ফাইল ছবি: এএফপি

যুক্তরাষ্ট্র মাদুরোকে স্বীকৃতি দেয় না
যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন, বিশেষ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও, মাদুরোকে ক্ষমতায় দেখতে চান না। এ বছরের শুরুর দিকে ফক্স নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রুবিও মাদুরোকে ‘ভয়াবহ এক স্বৈরশাসক’ বলে অভিহিত করেছিলেন। যখন তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়, তিনি কি মাদুরোর পদত্যাগ দাবি করছেন? তখন রুবিও বলেন, ‘আমরা সেই নীতির ওপর কাজ করছি।’ তবে মাদুরোর কড়া সমালোচক রুবিওর মতো ব্যক্তির জন্যও সরাসরি সামরিক সমর্থনে সরকার পরিবর্তনের আহ্বান জানানো কঠিন।


ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৬ সালের নির্বাচনী প্রচারণায় সরকার পরিবর্তনের নীতি থেকে সরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন বিদেশি সরকার উৎখাতের দৌড়ে যুক্তরাষ্ট্র অংশ নেবে না।

যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য এখনো মাদুরোকে ভেনেজুয়েলার বৈধ প্রেসিডেন্ট হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না। ২০২৪ সালের সর্বশেষ নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। নির্বাচনের প্রক্রিয়া আন্তর্জাতিক মহল ও ভেনেজুয়েলার বিরোধী দল উভয়েই স্বাধীন ও সুষ্ঠু নয় বলে প্রত্যাখ্যান করেছে।

ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলা মাদুরো
ছবি: রয়টার্স

সেনাবাহিনী মাদুরোর পক্ষে
যুক্তরাষ্ট্র মাদুরোকে গ্রেপ্তারের তথ্যের জন্য ঘোষিত পুরস্কার বাড়িয়ে ৫ কোটি ডলার করেছে, যাতে তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা প্রলুব্ধ হয়ে তাঁকে ধরিয়ে দেয়। কিন্তু এতেও মাদুরো–ঘনিষ্ঠজনদের মধ্যে বিভাজন ঘটেনি। ভেনেজুয়েলার আইন অধ্যাপক হোসে ইগনাসিও হার্নান্দেজ বলেন, ৫ কোটি ডলার ভেনেজুয়েলার অভিজাতদের জন্য কিছুই না। তিনি বলেন, তেলসমৃদ্ধ ভেনেজুয়েলার মতো দেশে দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল অর্থ উপার্জনের সুযোগ রয়েছে।

অনেক বিশ্লেষকের মতে, ভেনেজুয়েলায় সরকার পরিবর্তনের মূল চাবিকাঠি হলো সেনাবাহিনী। তবে সেনারা মাদুরোর বিরুদ্ধে অবস্থান নেবেন কেবল তখনই, যদি তাঁদের বিচার থেকে অব্যাহতির নিশ্চয়তা দেওয়া হয়।

হার্নান্দেজ বলেন, ‘তাঁরা ভাববেন, কোনো না কোনোভাবে আমিও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত।’

শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিজ্ঞানের অধ্যাপক ও লাতিন আমেরিকা বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মাইকেল আলবার্টাস মনে করেন, এমনকি ৫০ কোটি ডলার পুরস্কার ঘোষণাও মাদুরোর ঘনিষ্ঠ মহলকে তাঁর বিরুদ্ধে নিতে পারবে না। তিনি বলেন, ‘স্বৈরশাসক নেতারা সব সময় তাঁদের ঘনিষ্ঠদের প্রতিও সন্দেহপ্রবণ থাকেন, আর সেই কারণেই তাঁরা আনুগত্য নিশ্চিত করতে নজরদারি ব্যবস্থাও গড়ে তোলেন।’

ভেনেজুয়েলার ওপর আরোপিত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দেশটির ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকট আরও তীব্র করেছে, কিন্তু তাতে উচ্চপর্যায়ের কেউই প্রেসিডেন্ট মাদুরোর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়নি।

মাদক নয়, লক্ষ্য অন্য কিছু
ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছেন, এটি মাদক পাচারকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। তবে চ্যাথাম হাউসের গবেষক সাবাতিনি বলেন, এটা আসলে মাদক নিয়ে নয়। ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার বিরোধীদের ভাষা নিজেদের কাজে লাগিয়েছেন। মাদুরো বিরোধীরা বলে থাকেন, সেখানে শুধু স্বৈরশাসন নয়, অপরাধী শাসনব্যবস্থা বিদ্যমান রয়েছে।

সামরিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, সমুদ্রের পথে মাদক আটকাতে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র যে বিশাল বাহিনী মোতায়েন করেছে, তার প্রয়োজন নেই।

সিআইএর লক্ষ্য কী
সিআইএকে মাদুরোকে সরাতে কর্তৃত্ব দেওয়া হয়েছে কি না—এমন প্রশ্ন করা হলে ডোনাল্ড ট্রাম্প তা এড়িয়ে যান এবং জবাবে বলেন, এটা বলা অযৌক্তিক হবে। ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার স্থলভাগে সম্ভাব্য সামরিক অভিযানকে ইঙ্গিত করেছেন।
সিআইএকে লাতিন আমেরিকার অনেকেই সন্দেহের চোখে দেখে—কারণ গোপন হস্তক্ষেপ, সরকার উত্থাপনের চেষ্টা এবং অতীতের ডানপন্থী সামরিক কর্তৃত্ববাদী শাসকদের সমর্থনের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে, বিশেষ করে চিলি ও ব্রাজিলে।

জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি সদস্যের উপ-প্রতিনিধি নেড প্রাইস বলেছেন, সিআইএর গোপন অভিযান বহু রূপ নিতে পারে। এটি তথ্য-অভিযান হতে পারে। এটি ধ্বংসাত্মক অপারেশনও হতে পারে। এটি বিরোধী দলগুলোকে অর্থায়ন করাও হতে পারে। এমন এক পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে, যেখানে একটি শাসনব্যবস্থার উৎখাত পর্যন্ত হয়ে যায়।