ট্রাম্পকে ‘আমেরিকার হিটলার’ বলা জেডি ভ্যান্সই এখন তাঁর রানিং মেট
সময়টা ২০১৬ সাল। ডোনাল্ড ট্রাম্প তখনো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হননি। নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ওই সময় বিভিন্ন সাক্ষাৎকার ও টুইটে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে তোপ দাগেন দেশটির তরুণ রাজনীতিক জেডি ভ্যান্স। নিজেকে একজন ট্রাম্পবিরোধী হিসেবে পরিচয় দিতেন তিনি। তাঁকেই আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী ট্রাম্প নিজের রানিং মেট বা নিজের পরবর্তী প্রশাসনের ভাইস প্রেসিডেন্ট মনোনীত করে শোরগোল ফেলে দিয়েছেন।
ওই সময় জেডি ভ্যান্স বলেছিলেন, ‘আমি কখনোই ট্রাম্পের লোক নই। আমি কখনোই তাঁকে পছন্দ করিনি। আমি তাঁকে নিন্দার যোগ্য মনে করি। হায় ঈশ্বর, তিনি (ট্রাম্প) একজন নির্বোধ মানুষ।’
একই সময় জেডি ভ্যান্সের একটি স্মৃতিকথা প্রকাশিত হয়। নাম ‘হিলবিলি এলিজি’। এ বই তাঁকে দেশজুড়ে খ্যাতি এনে দেয়। একই বছর ট্রাম্পকে ‘আমেরিকার হিটলার’ আখ্যা দিয়েও ফেসবুকে লিখেছিলেন ভ্যান্স।
তবে কয়েক বছরের মধ্যেই ট্রাম্পকে নিয়ে ভ্যান্সের মনোভাব বদলে যায়। কট্টর সমালোচক থেকে শুভাকাঙ্ক্ষী বনে যান তিনি। হয়ে ওঠেন ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ মিত্রদের একজন। গতকাল সোমবার উইসকনসিন অঙ্গরাজ্যের মিলওয়াকিতে রিপাবলিকান পার্টির জাতীয় সম্মেলনে রানিং মেট হিসেবে ভ্যান্সের নাম ঘোষণা করেন ট্রাম্প।
ভ্যান্সের বয়স এখন ৩৯ বছর। ওহাইওর সিনেটর তিনি। ২০২২ সালে তিনি এ অঙ্গরাজ্যের সিনেটর নির্বাচিত হন।
স্মৃতিকথা থেকে জনপ্রিয়তা
ওহাইওর মিডলটাউনে ভ্যান্সের জন্ম। পুরো নাম জেমস ডেভিড বওম্যান ভ্যান্স। তাঁর মা মাদকাসক্ত ছিলেন। ভ্যান্স ছোট থাকতেই বাবা পরিবার ছেড়ে চলে যান। পরে নানা–নানির কাছে বড় হন ভ্যান্স। নিজের স্মৃতিকথায় বেশ সহানুভূতির সঙ্গে নানা–নানির কথা উল্লেখ করেছেন তিনি।
কাজের ক্ষেত্রে বিচিত্র অভিজ্ঞতা রয়েছে ভ্যান্সের ঝুলিতে। মার্কিন মেরিন সেনা হিসেবে ইরাকে কাজ করেছেন। পরে দেশে ফিরে ওহাইও ইউনিভার্সিটি ও ইয়েল ল স্কুলে পড়াশোনা করেন। এরপর ক্যালিফোর্নিয়ায় একজন বিনিয়োগকারী হিসেবে কাজ করেন। সেখান থেকে রাজনীতির মাঠে।
‘হিলবিলি এলিজি’ ভ্যান্সকে সর্বোচ্চ বিক্রীত (বেস্টসেলার) বইয়ের একজন লেখক হিসেবে পরিচিতি এনে দেয়। সেই সঙ্গে তিনি ভাষ্যকার হিসেবে কাজ শুরু করেন। ট্রাম্পের সমালোচনা করার সুযোগ খুব কমই হাতছাড়া করতেন তিনি।
২০১৬ সালের অক্টোবরে (ট্রাম্পের প্রথম দফায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে) এক সাক্ষাৎকারে ভ্যান্স বলেছিলেন, ‘আমি মনে করি, এ নির্বাচন সত্যিকারের নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বিশেষত শ্বেতাঙ্গ শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে। এ নির্বাচন অন্যের দিকে (মেক্সিকান অভিবাসী, চীনা বাণিজ্য, অভিজাত ডেমোক্রেটিক বা অন্যান্য) আঙুল তোলার অজুহাত তৈরি করছে।’
বিনিয়োগকারী থেকে রাজনীতিক
সময়টা ২০১৭ সাল। ওহাইওতে ফিরে আসেন ভ্যান্স। বিনিয়োগকারী হিসেবে কাজ শুরু করেন। এরপর ইয়েল ল স্কুলে পড়ার সময় উষা চিলুকুরির সঙ্গে পরিচয়। সেখান থেকে বিয়ে। তাঁদের তিন সন্তান রয়েছে।
উষা ভারতীয় অভিবাসী পরিবারের সন্তান। যুক্তরাষ্ট্রের সান দিয়াগোতে তাঁর বেড়ে ওঠা। ইয়েল থেকে স্নাতক করার পর কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতকোত্তর করেছেন। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি জন রবার্টসের দপ্তরে কাজের অভিজ্ঞতা আছে তাঁর। এখন তিনি মামলায় আইনি সহায়তাকারী হিসেবে কর্মরত।
২০২২ সালে ওহাইওর সিনেট নির্বাচনে লড়াই না করার ঘোষণা দেন রিপাবলিকান সিনেটর রব পোর্টম্যান। তখন তরুণ রাজনীতিক হিসেবে ভ্যান্সের নাম সামনে আসে। রিপাবলিকান প্রার্থী হিসেবে ভোটের লড়াইয়ে উতরেও যান। নির্বাচিত হন সিনেটর।
তবে শুরু থেকে বেশ ধীরগতিতে এগোচ্ছিল ভ্যান্সের নির্বাচনী প্রচার। এরপর পিটার থিয়েলের কাছ থেকে এক কোটি ডলারের অনুদান পান তিনি। এতে গতি পায় প্রচার। একসময় বিনিয়োগকারী পিটারের প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন ভ্যান্স।
ট্রাম্পের সমালোচনা করার রেকর্ড ওই সময় নির্বাচনী লড়াইয়ে ভ্যান্সকে বেশ ভুগিয়েছিল। তিনি ট্রাম্পকে নিয়ে আগের মন্তব্যগুলোর জন্য ক্ষমা চান। সক্ষম হন ট্রাম্পের সমর্থন আদায়ে। পরিবর্তিত এ অবস্থান ভোটের লড়াইয়ে জয় পেতে তাঁকে সহায়তা করে। সিনেটর নির্বাচিত হওয়ার পর রিপাবলিকান পার্টির শীর্ষ রাজনীতিতে ক্রমেই তাঁর উত্থান ঘটে।
রাজনীতির মাঠেও চমক দেখান ভ্যান্স। বিশ্বজুড়ে ট্রাম্পের ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ প্রচারণার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি মনে করা হয় তাঁকে। একসময়ের বিরোধীতাকারীর পরিচয় ঝেড়ে ফেলে ট্রাম্পের নীতি বাস্তবায়নের অন্যতম মুখ হয়ে ওঠেন তিনি।
গাজা ও ইউক্রেন নিয়ে অবস্থান
ভ্যান্স একজন নির্ভরযোগ্য রক্ষণশীল সিনেটর। জনতুষ্টিবাদী অর্থনৈতিক নীতি ও ইউক্রেনে মার্কিন সহায়তা নিয়ে একজন সংশয়বাদী হিসেবে সিনেটে ভূমিকা রাখেন তিনি।
গাজা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভ ছড়িয়েছিল, সেসব প্রতিষ্ঠানের ফেডারেল সহায়তা প্রত্যাহারে একটি বিল উত্থাপনে সাম্প্রতিক মাসগুলোয় কাজ করেন ভ্যান্স। সেই সঙ্গে যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনিবন্ধিত অভিবাসীদের কাজে নিযুক্ত করে, সেগুলোর সহায়তা বাতিলের পক্ষে তিনি।
গত মার্চে সিনেটে একটি বিলের পক্ষে জোরালো অবস্থান নেন ভ্যান্স। তাতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য আইন অনুসরণ না করলে মার্কিন পুঁজিবাজার থেকে চীনকে বিচ্ছিন্ন করার কথা বলা হয়েছে।
ভ্যান্স বলেন, রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততার পেছনে সুস্পষ্ট কোনো উদ্দেশ্য কিংবা এর উপসংহার টানার ক্ষেত্রে অর্জনের কাছাকাছি কোনো অবস্থান নেই।
একজন ক্যাথলিক খ্রিষ্টান হিসেবে ভ্যান্স নারীদের গর্ভধারণের ১৫ সপ্তাহ পরে গর্ভপাতের পক্ষে ছিলেন। কিন্তু এটা নিয়েও অবস্থান বদলেছেন তিনি। এখন ট্রাম্পের মতো তিনিও বলছেন, বিষয়টি অঙ্গরাজ্যগুলো নিষ্পত্তি করবে।
‘ট্রাম্পের ক্লোন’
ট্রাম্পের রানিং মেট হিসেবে গতকাল ভ্যান্সের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। এদিনই প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তাঁকে নিয়ে মন্তব্য করেছেন। বাইডেন তাঁকে ‘ট্রাম্পের ক্লোন’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এ থেকেই বোঝা যায়, নির্বাচনী প্রচারকালে বাইডেন শিবির ভ্যান্সকে কীভাবে মূল্যায়ন করবে।