এ যেন একটি প্রবাদের আবারও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠা, ‘আমার শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু’।
যেভাবেই দেখা হোক না কেন, এটা চীনের জন্য অপ্রত্যাশিত এক স্বস্তির খবর। কারণ, তাদের প্রধান বৈশ্বিক প্রতিদ্বন্দ্বী যুক্তরাষ্ট্র এখন এশিয়ায় বেইজিংয়ের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের সঙ্গে ঝগড়া শুরু করেছে।
ওয়াশিংটন ও নয়াদিল্লির সম্পর্কে এখন নতুন করে টানাপোড়েন চলছে। চলতি মাসের শুরুর দিকে ট্রাম্প প্রশাসন ভারতীয় পণ্যের ওপর শুল্ক দ্বিগুণ করে ৫০ শতাংশ করার ঘোষণা দিয়েছে। কারণ হিসেবে ওয়াশিংটন বলেছে, রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেলের আমদানি অব্যাহত রাখায় ‘জরিমানা’ হিসেবে ভারতের ওপর এই শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।
হঠাৎ তৈরি হওয়া এই ফাটল যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে নিরাপত্তা ও প্রযুক্তির মতো খাতগুলোতে তিলে তিলে গড়ে ওঠা সহযোগিতার সম্পর্ককে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। ওয়াশিংটন ও নয়াদিল্লির মধ্যে বৃদ্ধি পেতে থাকা এই সম্পর্কের মূল চালিকা শক্তি ছিল একটাই—চীনের বৈশ্বিক উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা।
যুক্তরাষ্ট্র-ভারতের সম্পর্কের ফাটল বেইজিং ও নয়াদিল্লির মধ্যে বিদ্যমান উত্তেজনা শিথিল করার পথে নতুন গতি সঞ্চার করেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রতিবেশী দেশ দুটিতে উত্তেজনা বেশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। এই দুই দেশের মধ্যে বরফ গলতে শুরু করেছিল মূলত গত বছরের অক্টোবরে, যখন রাশিয়ার কাজানে উদীয়মান অর্থনীতির (ব্রিকস) শীর্ষ সম্মেলনে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বৈঠক করেন। এর পর থেকে দুই দেশের সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে সফর, বাণিজ্যিক প্রতিবন্ধকতা কমানো এবং নাগরিক পর্যায়ে আসা-যাওয়া সহজ করা নিয়ে আলোচনা বৃদ্ধি পেয়েছে।
ভারতের বেঙ্গালুরুতে অবস্থিত তক্ষশীলা ইনস্টিটিউশনের ইন্দো-প্যাসিফিক–বিষয়ক গবেষণাপ্রধান মনোজ কেওলরামানি বলেন, ‘আমার ধারণা, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক টানাপোড়েন দেখে বেইজিংয়ের অনেকের মধ্যে অন্যের দুর্দশা দেখে আনন্দ (শাডেনফ্রয়ডে) হওয়ার মতো অনুভূতি হচ্ছে। নয়াদিল্লি ও ওয়াশিংটনের মধ্যে রাজনৈতিক আস্থার ফাটল চীনের পক্ষেই যাবে।’
এশিয়ার এই দুই বড় প্রতিবেশীর মধ্যে এখনো বিভক্তির অনেক কিছু রয়ে গেছে। বিভক্তির এসব কারণের মধ্যে প্রায় ২ হাজার ১০০ মাইল দীর্ঘ যৌথ সীমান্তের নিয়ন্ত্রণ, ভারতের প্রতিপক্ষ পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠতা এবং চীনের ওপর নির্ভারশীলতা কমাতে চাইছে, এমন বহুজাতিক উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোকে ভারতের আকর্ষণের চেষ্টা অন্যতম।
গত অক্টোবরে রাশিয়ায় মোদি ও সি–এর মধ্যে বৈঠকের আগে তাঁদের মধ্যে সর্বশেষ দেখা হয়েছিল ২০১৯ সালে। তখন তাঁরা ভারতে দ্বিতীয় অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করেছিলেন। এই বৈঠকের এক বছরের মাথায় হিমালয় সীমান্তে ভারত ও চীনের সেনাদের মধ্যে প্রাণঘাতী সংঘাত হয়েছিল, যার মধ্য দিয়ে দুই দেশের সম্পর্ক তলানিতে নেমে এসেছিল।
রাশিয়ায় সি-মোদির বৈঠকের পর দুই দেশ ভ্রমণ ভিসার বিধিনিষেধ শিথিল করেছে এবং সরাসরি ফ্লাইট আবার চালু করতে কাজ শুরু করেছে। গত জুনে ভারতীয় তীর্থযাত্রীদের তিব্বতের পবিত্র স্থানে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে বেইজিং। গত সপ্তাহে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল জানিয়েছেন, ভারত ও চীন তাদের পার্বত্য সীমান্ত অঞ্চলের তিনটি বাণিজ্য বন্দর (পোস্ট) আবার চালু করা নিয়ে আলোচনা শুরু করেছে।
চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই গত সোমবার ভারত সফরে গেছেন। সফরে সীমান্ত, অর্থনীতি ও বাণিজ্য–সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনা হয়। এটি তিন বছরের বেশি সময়ের মধ্যে ওয়াংয়ের প্রথম ভারত সফর।
ওয়াংয়ের সফর উপলক্ষে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বলেন, ‘আমাদের দুই দেশ এখন জটিল সম্পর্ককে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে চায়।’
জয়শঙ্কর বলেন, ‘বিশ্বের দুই বৃহত্তম দেশ যখন আলোচনায় বসে, তখন আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হওয়াটা স্বাভাবিক। আমরা একটি ন্যায্য, সুষম এবং বহুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা চাই, যেখানে এশিয়াতেও ক্ষমতার একাধিক কেন্দ্র থাকবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এবং তা উন্নত করার প্রয়োজনীয়তাও সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে।’
চলতি মাসেই মোদি সাত বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো চীনের সফরে যাচ্ছেন। দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলের শহর তিয়ানজিনে অনুষ্ঠেয় সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার (এসসিও) শীর্ষ সম্মেলনে তিনি অংশ নেবেন। সি চিন পিং ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও সেখানে উপস্থিত থাকবেন। ফলে এখানে এমন তিন নেতার মধ্যে দেখা হবে, যাঁদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন মাত্রায় মতবিরোধ রয়েছে।
বেইজিংয়ের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে মোদি সরকারকে সতর্ক থাকতে হচ্ছে, যাতে মে মাসে ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের সংঘর্ষে চীনের সহায়তার বিষয়টি নিয়ে জনগণের মধ্যে ক্ষোভ না বাড়ে। ভারতের এই সতর্কতা বেইজিংয়ের সঙ্গে নয়াদিল্লির সম্পর্ক মসৃণ রাখার প্রতিশ্রুতির ইঙ্গিত।
চীনে নিয়োজিত ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত বিজয় গোখলে গত মঙ্গলবার দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়ায় প্রকাশিত একটি মতামতে লিখেছেন, চীন ও ভারতের স্বার্থের মধ্যে এখনো অনেকগুলো ভিন্নতা রয়ে গেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ভারত ও অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশকে ‘ট্রাম্পীয় বিশৃঙ্খলা’ মোকাবিলায় চীন গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা দিতে পারে। এসব সহায়তার মধ্যে মূলধন ও প্রযুক্তি থেকে শুরু করে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অংশীদারত্ব অন্যতম।
বিজয় গোখলে লিখেছেন, ‘চীনকে এখন গত পাঁচ বছরের যেকোনো সময়ের চেয়ে ভালো মনে হচ্ছে।’
বিশ্লেষকদের মতে, ভারতের বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব নিয়ে সতর্ক আশাবাদ ব্যক্ত করেছে চীন। নয়াদিল্লির সম্পর্ক নতুন করে শুরুর এই ইচ্ছা কেবল ট্রাম্পকে মোকাবিলার কৌশল কি না, তা ভেবে দেখছে চীন।
চলতি বছরের শুরুতে সি চিন পিং বেইজিং-নয়াদিল্লির সম্পর্ককে একটি সংগীতময় ‘ড্রাগন-হাতির নাচের’ সঙ্গে তুলনা করেছেন। এখানে ড্রাগন ও হাতির মাধ্যমে প্রতীকীভাবে ভারত ও চীনকে বোঝানো হয়েছে। সি–এর এই সদিচ্ছা সত্ত্বেও ভারতীয় সীমান্তে নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করতে নতুন রাস্তা, রেল নেটওয়ার্ক এবং গ্রাম তৈরি অব্যাহত রেখেছে চীন। এসব অবকাঠামো চীনা সেনাবাহিনীর ব্যবহারের মতো উপযোগী করে তৈরি করা হচ্ছে।
এই দুই শক্তি ভারত মহাসাগরজুড়েও নিজেদের প্রভাব বিস্তারের জন্য প্রতিযোগিতা করছে। ভারত মহাসাগর বেইজিংয়ের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ জলপথ। বিআরআই এমন একটি বৈশ্বিক অবকাঠামো প্রকল্প, চীনের সরবরাহ শৃঙ্খলাকে আরও শক্তিশালী করাই যার লক্ষ্য।
বেইজিং মনে করে, নয়াদিল্লি তার ঐতিহাসিক জোট নিরপেক্ষ নীতি ত্যাগ করে ওয়াশিংটনের প্রভাববলয়ের দিকে এগোচ্ছে। এর উদাহরণ হিসেবে বেইজিং কোয়াডে প্রতিরক্ষা গোষ্ঠীর (গ্রুপ) কথা বলে। ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে গঠিত এই গোষ্ঠীর অন্যতম উদ্দেশ্য, চীনের সামরিক উত্থান মোকাবিলা করা।
ভারতের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, চলতি বছরের শেষে ভারতে কোয়াড নেতাদের পরবর্তী বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু তা ট্রাম্প প্রশাসন ও নয়াদিল্লির মধ্যে বাণিজ্যবিরোধ মিটিয়ে আস্থা পুনর্নির্মাণ করতে পারার ওপর নির্ভর করছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে উত্তেজনার কারণে চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যম খুশি। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির ট্যাবলয়েড গ্লোবাল টাইমস বলেছে, মোদির আসন্ন চীন সফর বেইজিংকে ‘আটকানোর’ কৌশলে নয়াদিল্লিকে টানতে ওয়াশিংটনের ব্যর্থতার প্রতীকে পরিণত হয়েছে।
সংবাদমাধ্যমটির প্রতিবেদনে অনুযায়ী, ‘চীন ও ভারত প্রতিবেশী। তারা যেসব ক্ষেত্রে সহযোগিতা করতে পারে, সেটার তালিকা বেশ দীর্ঘ।’
কিন্তু বিশ্লেষকদের মতে, ভারতীয় কর্মকর্তারা চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করতে চাইলে, তা বেইজিংয়ের শর্তেই করতে হবে।
এর অর্থ হলো, চীনা কোম্পানি ও বিনিয়োগের জন্য ভারতকে আরও দরাজ দিল হতে হবে। চীনা ব্যবসায়ীদের জন্য ভিসার কড়াকড়ি শিথিল করা অব্যাহত রাখতে হবে। চীনা গাড়ি নির্মাতা কোম্পানি বিওয়াইডিকে কারখানা স্থাপনের অনুমতি দেয়নি ভারত। তা ছাড়া চীনের টিকটিকের মতো অ্যাপগুলো নিষিদ্ধ করেছে।
সাংহাইয়ের ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে চীনের সম্পর্ক বিষয়ে বিশেষজ্ঞ লিন মিনওয়াং বলেন, ‘ভারত চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করতে চাইলে চীন তাকে স্বাগত জানাবে। কিন্তু চীন এ জন্য ভারতের তথাকথিত কূটনৈতিক অবস্থান মেনে নিতে বড় ধরনের ছাড় বা ত্যাগ স্বীকার করবে না।’
লিন মিনওয়াং বলেন, চীন জাতীয় স্বার্থের বিষয়ে কোনো ছাড় দেবে না। সেসব বিষয় নয়াদিল্লিকে সবচেয়ে বেশি বিরক্ত করলেও তাতে কোনো ছাড় দেবে না বেইজিং। যেমন পাকিস্তানের প্রতি বেইজিংয়ের অকুণ্ঠ সমর্থন।
অন্য বিশ্লেষকদের মতে, ভারতও যথেষ্ট সতর্ক রয়েছে। কারণ, মোদি একবার সি চিন পিংকে অতিরিক্ত বিশ্বাস করে সমস্যায় পড়েছিলেন।
লিন মিনওয়াং বলেন, ‘ভারতের বর্তমান দৃষ্টিভঙ্গি মূলত কৌশলগত হিসাব-নিকাশভিত্তিক। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক অবনতি হওয়ায় তারা চীনের প্রতি অনুকূল কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। আমার মতে, চীন অন্তত এসব বিষয় সতর্কভাবে মূল্যায়ন করবে।