ট্রাম্পের মতো দুবারের বেশি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়েছেন যাঁরা

বিতর্কের মঞ্চে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও কমলা হ্যারিস
ফাইল ছবি: এএফপি

ডোনাল্ড ট্রাম্প নাকি কমলা হ্যারিস—কে যাচ্ছেন হোয়াইট হাউসে? কার ভাগ্য সুপ্রসন্ন হতে যাচ্ছে? রীতি মেনে নভেম্বরের প্রথম সোমবারের পরদিন, অর্থাৎ আগামী ৫ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ভোটে জানা যাবে, কে হচ্ছেন সেই ভাগ্যবান। নিজেদের পরবর্তী কান্ডারি বেছে নিতে এ নির্বাচনে ভোট দেবেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ১৮ কোটি ৬৫ লাখ ভোটার।

রিপাবলিকান পার্টির ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট। এর আগে ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন তিনি। আর কমলা হ্যারিস বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট। লড়ছেন ডেমোক্রেটিক পার্টির হয়ে। কৃষ্ণাজ্ঞ নারী হিসেবে এবারই প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন কমলা। আর ট্রাম্প এবার নিয়ে তৃতীয়বার ভোটে দাঁড়িয়েছেন।

২০১৬ সালের নির্বাচনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পর হিলারি ক্লিনটনকে হারিয়ে হোয়াইট হাউসের বাসিন্দা হন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ২০২০ সালের নির্বাচনে নানা নাটকীয়তার পর বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছে হেরে যান তিনি। তবে ট্রাম্প দ্বিতীয় দফায় হোয়াইট হাউসে যাওয়ার স্বপ্ন কখনোই ছাড়েননি। নানা বিতর্ক, সমালোচনা ও আইনি ঝামেলায় জড়িয়েও এবারের নির্বাচনে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ার প্রত্যয় তাঁর।

যুক্তরাষ্ট্রে পরপর দুই মেয়াদের বেশি কেউ প্রেসিডেন্ট হতে পারেন না। এটাই দেশটির নিয়ম। সাধারণত পরপর তিনবার (ব্যতিক্রম রয়েছে) নির্বাচনে লড়ার কোনো সুযোগ নেই। তবে দ্বিতীয় মেয়াদে হেরে গেলে আরেক মেয়াদে ভোটের লড়াইয়ে নামা যায়। এবার ট্রাম্প সেটাই করছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে দুইয়ের বেশিবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া ব্যক্তি ট্রাম্প একাই নন। এর আগেও কয়েকজন একই কীর্তি গড়েছেন।

আসুন, একনজরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দুইয়ের বেশিবার প্রার্থী হওয়া রাজনীতিকদের সম্পর্কে জেনে নিই—

টমাস জেফারসন

টমাস জেফারসন
ছবি: হোয়াইট হাউসের ওয়েবসাইট

প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনের শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক বিভাজন প্রকট রূপ নেয়। এর রেশ গিয়ে পড়ে টমাস জেফারসনের ওপর। তিনি তখন ডেমোক্রেটিক-রিপাবলিকান পার্টির নেতা। জেফারসন নির্বাচনে দাঁড়ান ফেডারেলিস্ট পার্টির প্রার্থী জন অ্যাডামসের বিপক্ষে। ১৭৯৬ সালের নির্বাচনে প্রথমবারের মতো দুই প্রার্থীর মধ্যে চরম হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়।

শেষ হাসি হাসেন জন অ্যাডামস। ইলেকটোরাল কলেজে ৭১-৬৮ ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তিনি। তখন মার্কিন নির্বাচনী ব্যবস্থায় একটা নিয়ম ছিল—প্রার্থীদের মধ্যে সর্বোচ্চ ভোট পাওয়া ব্যক্তি প্রেসিডেন্ট হবেন। ভোটের হিসাবে পরের অবস্থানে থাকা প্রার্থী হবেন ভাইস প্রেসিডেন্ট। কাজেই জন অ্যাডামসের সরকারের ভাইস প্রেসিডেন্ট হন জেফারসন।

এর চার বছর পর ১৮০০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আবারও হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পর জয়ী হয়ে হোয়াইট হাউসের বাসিন্দা হন টমাস জেফারসন। নিউইয়র্কের সাবেক সিনেটর অ্যারন বুর-কে হারান তিনি। নির্বাচনী নিয়ম মেনে অ্যারন হন ভাইস প্রেসিডেন্ট।

জনপ্রিয় একজন প্রেসিডেন্ট ছিলেন জেফারসন। এই জনপ্রিয়তা কাজে লাগান ১৮০৪ সালের নির্বাচনে। আবারও প্রার্থী হয়ে অনায়াসে নির্বাচনী বৈতরণী পার হন তিনি। হারিয়ে দেন ফেডারেলিস্ট প্রার্থী চার্লস পিঙ্কনেকে। জেফারসনের দ্বিতীয় মেয়াদে সংবিধান সংশোধন করে ভাইস প্রেসিডেন্টের জন্য পৃথক ভোটের ব্যবস্থা করা হয়।

গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড

গ্রোভার ক্লেভল্যান্ড
ছবি: হোয়াইট হাউসের ওয়েবসাইট

নিউইয়র্কের গভর্নর ছিলেন গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড। একজন সৎ, করিতকর্মা ও পরিশ্রমী ব্যক্তি হিসেবে তাঁর পরিচিতি ছিল। ১৮৮৪ সালের নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টি থেকে প্রথমবার প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হন তিনি। নির্বাচনে অল্প ব্যবধানে জেমস ব্লেইনকে হারিয়ে প্রেসিডেন্ট হন তিনি।

পরেরবার, অর্থাৎ ১৮৮৮ সালের নির্বাচনে অনায়াসে ডেমোক্রেটিক পার্টি থেকে প্রার্থিতা বাগিয়ে নেন গ্রোভার। প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন রিপাবলিকান পার্টির বেঞ্জামিন হ্যারিসন। তিনি সাবেক সিনেটর এবং সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম হেনরি হ্যারিসনের নাতি। জনগণের ভোটে জিতলেও ইলেকটোরাল কলেজে হেরে যান গ্রোভার। ফলে পরপর দুবার হোয়াইট হাউসের বাসিন্দা হওয়া হয়নি তাঁর।

১৮৯২ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আবারও ডেমোক্রেটিক পার্টি থেকে প্রার্থী হন গ্রোভার। তৃতীয়বারের লড়াইয়ে আর হতাশ হতে হয়নি তাঁকে। ভার্জিনিয়াভিত্তিক মিলার সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী, এবার ৮ শতাংশের বেশি ব্যবধানে জিতে আবারও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হন গ্রোভার।

উইলিয়াম জেনিংস ব্রায়ান

ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী ছিলেন উইলিয়াম জেনিংস ব্রায়ান। ১৮৯৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ৩৬ বছর বয়সে দলীয় মনোনয়ন পেয়ে সবাইকে চমকে দেন তিনি। নির্বাচনী প্রচারে চষে বেড়ান পুরো যুক্তরাষ্ট্রে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিজয়ীর হাসি হাসতে পারেননি।

এরপর ১৯০০ ও ১৯০৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আরও দুই দফায় ডেমোক্রেটিক প্রার্থী হয়েছিলেন ব্রায়ান। দুবারই পরাজিত হন। হোয়াইট হাউসের বাসিন্দা হওয়ার স্বপ্ন তাঁর পূরণ হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের লাইব্রেরি অব কংগ্রেসের নথিতে বলা আছে, ১৯১৩ থেকে ১৯১৫ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনের সরকারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন ব্রায়ান।

ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট

ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট
ছবি: হোয়াইট হাউসের ওয়েবসাইট

যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে জনপ্রিয় প্রেসিডেন্টদের একজন ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট। ১৯৩২ সালের নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টি থেকে প্রথমবার প্রার্থী হন। এর আগে মহামন্দার জেরে প্রেসিডেন্ট হারবার্ট হুভারের জনপ্রিয়তা তলানিতে ঠেকে। কান্ডারি হিসেবে এগিয়ে আসেন রুজভেল্ট। প্রথমবারই বাজিমাত করে প্রেসিডেন্ট হন।

১৯৩৩ সালে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেওয়ার পর ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত আমৃত্যু এ দায়িত্ব সামলেছেন ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট। রীতি ভেঙে দুই মেয়াদের বেশি সময় প্রেসিডেন্ট থাকার রেকর্ড ছিল তাঁর দখলে। এর কারণ হলো, তাঁর আমলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়ায় যুক্তরাষ্ট্র।

বিশ্বযুদ্ধের দামামায় মেয়াদ বাড়ে প্রেসিডেন্টের। এর মধ্যে ১৯৩৬ ও ১৯৪০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও জয় পান রুজভেল্ট। যুদ্ধকালে বিশেষ পরিস্থিতিতে ১৯৪৪ সালের নির্বাচনেও প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হতে আগ্রহ দেখান প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট। দলীয় মনোনয়ন পেতে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়েন নিউইয়র্কের গভর্নর টমাস ডিউয়ের কাছে। যদিও শেষ পর্যন্ত প্রার্থী হয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হন রুজভেল্ট।

প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট ১৯৪৫ সালের এপ্রিলে ৬৩ বছর বয়সে মারা যান। তখনো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয়নি।

রিচার্ড নিক্সন

রিচার্ড নিক্সন
ছবি: হোয়াইট হাউসের ওয়েবসাইট

প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ারের সরকারে পরপর দুই মেয়াদে ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন রিজার্ড নিক্সন। এরপর ১৯৬০ সালের নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টি থেকে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হন নিক্সন। তিনি ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী ও মিয়ামির সিনেটর জন এফ কেনেডির থেকে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় বেশ এগিয়ে ছিলেন। তবে স্নায়ুযুদ্ধ ও নাগরিক অধিকার আন্দোলনের পরিস্থিতিতে নির্বাচনে নিক্সন হেরে যান।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন

রিচার্ড নিক্সন দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হন ১৯৬৮ সালের নির্বাচনে। এবার আর সমর্থকদের হতাশ করেননি। জনসন সরকার জনপ্রিয়তা হারায় ভিয়েতনাম যুদ্ধের জেরে। সেই সুযোগে নিক্সন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জিতে হোয়াইট হাউসে প্রবেশ করেন।

১৯৭২ সালে তৃতীয়বার প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হয়ে সহজ জয় পান নিক্সন। টানা দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট হন তিনি। ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত নিক্সন প্রেসিডেন্ট পদে ছিলেন। সাড়াজাগানো ওয়াটারগেট কেলঙ্কারিতে নাম জড়ায় নিক্সনের। তুমুল সমালোচিত হন তিনি। অবশেষে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই পদত্যাগ করে হোয়াইট হাউস ছাড়তে হয় প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে।

তথ্যসূত্র: এএফপি, দ্য হিল, বিবিসি, হোয়াইট হাউস ও লাইব্রেরি অব কংগ্রেসের ওয়েবসাইট

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন
আরও পড়ুন