কেন যুক্তরাষ্ট্র ফ্রান্সকে আক্রমণ করছে, সৌদি আরবের বিষয়ে নীরব

কাতারের দোহায় অনুষ্ঠিত আরব–ইসলামিক জরুরি সম্মেলনে অংশ নেন সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫ছবি: এএফপি

ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং ‘দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধান’ (ইসরায়েল–ফিলিস্তিন সংকটের) কার্যকর করা বিষয়ে ফ্রান্স ও সৌদি আরবের উদ্যোগে আয়োজিত জাতিসংঘ শীর্ষ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্র খুশি নয়। ওয়াশিংটন এটি স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কয়েকজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও শীর্ষ কর্মকর্তা এ নিয়ে কিছু লুকোননি। তাঁরা নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনের সমালোচনা করেছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও সম্মেলনকে আগে ‘প্রতীকী’ ও ‘ইসরায়েল–ফিলিস্তিন সংঘাতের ওপর কোনো প্রভাব নেই’ বলে মন্তব্য করেছেন। তবে তিনি বলেছিলেন, এটি হামাসকে ‘সাহস জোগানোর’ একটি পদক্ষেপ।

ইসরায়েলে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মাইক হাকাবি আরও খানিকটা এগিয়ে সম্মেলনকে ‘ঘৃণ্য’ আখ্যায়িত করেছেন এবং বলেছেন, সহ-আয়োজক ফ্রান্সকে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের জন্য ‘ফ্রেঞ্চ রিভিয়েরা’ (ফ্রান্সের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের একটি সমুদ্রসৈকত এলাকা) ত্যাগ করতে হবে।

যেখানে ট্রাম্প প্রশাসন ফ্রান্সকে ব্যঙ্গ করাসহ সম্মেলনের সমালোচনায় জোরালো ও শক্ত ভাষা ব্যবহার করতে দ্বিধা করেনি; সেখানে সৌদি আরবের সহ-আয়োজক হওয়ার সিদ্ধান্তে উল্লেখযোগ্যভাবে নীরব থেকেছে তারা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রাম্প সৌদি আরবকে রাগাচ্ছেন না। তা এটাই দেখাচ্ছে যে গালফের দেশগুলো, বিশেষ করে সৌদি আরব গাজা বিষয়ে ট্রাম্পকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে ধারণার চেয়ে বেশি শক্তিশালী।

কূটনীতিক ও বিশেষজ্ঞরা মিডল ইস্ট আইকে বলেছেন, ফ্রান্সকে আক্রমণ করে সৌদি আরবকে ছাড় দেওয়ার এ দ্ব্যর্থহীন যুক্তরাষ্ট্রের নীতি রিয়াদের ক্ষমতাকেই প্রতিফলিত করে। এর পেছনে রয়েছে সৌদি আরবের আর্থিক শক্তি এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তা সম্পর্ক সম্প্রসারণের ক্ষমতা।

কুয়েত বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক বাদের আল-সাইফ বলেন, ট্রাম্প প্রশাসন নীরবে দেখিয়েছে যে, তারা ফিলিস্তিন বিষয়ে তাদের ঘনিষ্ঠ আরব মিত্রদের বিরুদ্ধে কোনো কঠোর পদক্ষেপ নিতে চায় না।

‘ফ্রান্স কি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে বিপুল বিনিয়োগ করছে’, প্রশ্ন তোলেন সাইফ। বলেন, ‘গালফভুক্ত দেশগুলোর প্রকৃত প্রভাব তাদের ধারণার চেয়েও অনেক বেশি, আর এটি এমন প্রভাব, যা ট্রাম্প সহজে বোঝেন।’

আরও পড়ুন

গতকাল সোমবার জাতিসংঘের শীর্ষ সম্মেলনে ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর বক্তব্যে উপস্থিত নেতারা দাঁড়িয়ে অভিনন্দন জানান। ফ্রান্স সম্মেলনে একটি উচ্চপর্যায়ের অবস্থান নিয়েছে। সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান উপস্থিত না হলেও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফয়সাল বিন ফারহান তাঁর পক্ষে বক্তব্য দেন।

গত মে মাসে ট্রাম্প সৌদি আরবে এক ঐতিহাসিক সফর করেন। সফরে তিনি আশা প্রকাশ করেছিলেন যে তাঁর প্রশাসন বৈদেশিক সংঘাতে কম হস্তক্ষেপ করবে। সফরের সময় সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্রে ৬০০ বিলিয়ন (৬০ হাজার কোটি) ডলারের বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর শেষে আলিঙ্গন করছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ ও সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫
ছবি: রয়টার্স

সফরে ট্রাম্পের দেওয়া ভাষণ ও সৌদি বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতির প্রভাব মিশ্র—কিছু ভালো ফল হয়েছে, কিছু হয়নি।

রিয়াদের চাপের কারণে ট্রাম্প ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের ওপর বিমান হামলা বন্ধ করেছেন। হুতিরা এখনো ইসরায়েলের ওপর ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করছে। একইভাবে, ট্রাম্প সিরিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছেন।

ট্রাম্প প্রশাসন নীরবে দেখিয়েছে যে তারা ফিলিস্তিন বিষয়ে তাদের ঘনিষ্ঠ আরব মিত্রদের বিরুদ্ধে কোনো কঠোর পদক্ষেপ নিতে চায় না।
বাদের আল-সাইফ, কুয়েত বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক

কিন্তু মূল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ট্রাম্প তাঁর ভাষণ অনুযায়ী কাজ করেননি। তিনি ইসরায়েলের সঙ্গে ইরানের সংঘাতের সময় তেহরানের পারমাণবিক স্থাপনায় বোমাবর্ষণ করেন, যদিও দ্রুতই যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছেন। ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি হত্যাকাণ্ডেও নিঃশর্ত সমর্থন দিয়েছেন; যা জাতিসংঘ, ইতিহাসবিদ ও মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা জাতিগত হত্যা বলে উল্লেখ করেছেন।

এদিকে সৌদি আরব–যুক্তরাষ্ট্র দুই পক্ষের মধ্যে ১৪২ বিলিয়ন (১৪ হাজার ২০০ কোটি) ডলারের প্রতিরক্ষা চুক্তি সই হওয়ার পর থেকে কোনো বড় অস্ত্র বিক্রয়ের প্রকাশ্যে ঘোষণা আসেনি। সৌদি আরব এআই চিপের বড় ক্রেতা হতে চলেছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত এ–সংক্রান্ত চুক্তির কোনো প্রকাশ্য অগ্রগতি দেখা যায়নি।

আরও পড়ুন

‘সৌদি আরবকে পাশে রাখা’

গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যা নিয়ে আলোচনার সময় ট্রাম্প বিশেষভাবে আক্রমণাত্মক বা কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, ৭ অক্টোবর ২০২৩ ইসরায়েলে হামাসের হামলায় প্রায় ১ হাজার ২০০ জন নিহত হয়েছেন। এটি ‘জাতিহত্যা, সম্ভবত’। ইসরায়েল গাজায় জাতিহত্যা চালাচ্ছে—সম্প্রতি জাতিসংঘের এ সিদ্ধান্তে বিষয়টি (ইসরায়েলে হামাসের হামলা) এড়িয়ে গেছে।

কিন্তু সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের ঘোষণা—ইসরায়েল গণহত্যা করছে। এ বিষয়ে ট্রাম্প নীরব।

সৌদি আরব ও পাকিস্তানের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরের পর দুই দেশের নেতারা। ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, রিয়াদ
ছবি: পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়

‘যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈত নীতি এসেছে ট্রাম্পের ব্যক্তিগত অনুভূতি থেকে (ইউরোপ ও গালফের দেশগুলোর বিষয়ে)’, বলেন ওয়াশিংটনের গবেষণা প্রতিষ্ঠান মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞ গ্রেগরি গস।

রিয়াদের চাপের কারণে ট্রাম্প ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের ওপর বিমান হামলা বন্ধ করেছেন। হুতিরা এখনো ইসরায়েলের ওপর ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করছে। একইভাবে, ট্রাম্প সিরিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছেন।

গ্রেগরি বলেন, ট্রাম্প প্রথমেই জার্মানি বা ফ্রান্সকে নেতিবাচকভাবে দেখেন। কিন্তু গালফের দেশগুলো তাঁর মনোযোগ আকর্ষণ করে ও ইউরোপের চেয়ে বেশি প্রভাব ফেলতে পারে।

ট্রাম্পের আশা, জাতিসংঘে তুরস্ক, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিসর, কাতার ও সৌদি আরবের কর্মকর্তাদের সঙ্গে গাজার বিষয়ে আলোচনা করবেন তিনি; যদিও অনেক নেতাই এ সময় ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত থাকবেন না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফ্রান্সের সমালোচনা করা ট্রাম্পের দূতদের জন্য সহজ, কারণ এতে ঝুঁকি কম। বিপরীতে, গুরুত্বপূর্ণ গালফ মিত্র সৌদি আরবের সমালোচনা করা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কঠিন। কারণ, মিত্রদেশটির জনগণ গাজায় ইসরায়েলি বর্বরতা নিয়ে রেগে আছেন।

আরও পড়ুন

ফ্রান্স ন্যাটোর সদস্য হওয়ায় তারা চায়, যুক্তরাষ্ট্র জোটে সক্রিয় থাকুক এবং এজন্য দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে সচেষ্ট প্যারিস। কিন্তু সৌদি আরব ন্যাটোর অংশ নয়, তাই তাদের ওপর এমন চাপ নেই। ফলে তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আবার, সিরিয়া, লেবানন ও ইরানের ওপর ইসরায়েলের আগ্রাসন যুক্তরাষ্ট্র মেনে নেওয়ায় গালফের দেশগুলো উদ্বিগ্ন।

যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈত নীতি (ইউরোপ ও গালফের দেশগুলোর বিষয়ে) এসেছে ট্রাম্পের ব্যক্তিগত অনুভূতি থেকে। তিনি প্রথমেই জার্মানি বা ফ্রান্সকে নেতিবাচকভাবে দেখেন। কিন্তু গালফের দেশগুলো তাঁর মনোযোগ আকর্ষণ করে ও ইউরোপের চেয়ে বেশি প্রভাব ফেলতে পারে।
গ্রেগরি গস, ওয়াশিংটনের গবেষণা প্রতিষ্ঠান মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞ

গত সপ্তাহে সৌদি আরব পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ পাকিস্তানের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি করেছে। এ ছাড়া চীনের সহায়তায় নিজস্ব ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদনও শুরু করেছে রিয়াদ।

গ্রেগরি গস বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তান–সৌদি প্রতিরক্ষা চুক্তিকে আমলে নিয়েছে। সেই সঙ্গে সৌদি আরবকে পাশে রাখার চেষ্টা করছে তারা। কারণ, অনেকেরই ধারণা, পাকিস্তানের মাধ্যমে চীন ওই অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে। এ অবস্থায় ফ্রান্স যদি ন্যাটো ছেড়েও যায়, তাতে কারও মাথাব্যথা নেই।’

আরও পড়ুন