প্রথম পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা কোথায় হয়েছিল, সেই বিজ্ঞানীদের প্রতিক্রিয়াই–বা কেমন ছিল

১৯৪৫ সালের ১৬ জুলাই পারমাণবিক বোমা পরীক্ষার পরছবি : লস আলমোস ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির সৌজন্যে

১৯৪৫ সালের ১৬ জুলাই ভোর ৫টা ২৯ মিনিট ৪৫ সেকেন্ড। নিউ মেক্সিকোর আলামোগর্ডোর মরুভূমির মাটির ওপর থেকে হঠাৎ একটি বিশাল আগুনের গোলা ওপরে উঠতে শুরু করে। এটি প্রথমে সূর্যের মতোই উজ্জ্বল ছিল। কয়েক মুহূর্ত পর টের পাওয়া যায় ঝাঁকুনি ও ফাটলের শব্দ। চারপাশের পর্বত থেকে তার প্রতিধ্বনি শোনা যেতে শুরু করে।

যুক্তরাষ্ট্রের একদল বিজ্ঞানী ও সামরিক কর্মকর্তাদের চোখে এ বিস্ফোরণ অবিশ্বাস আর বিস্ময়ের অনুভূতি তৈরি করে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন গোপন গবেষণাগারে তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে যে কাজ করছিলেন, এ বিস্ফোরণের পরীক্ষার মাধ্যমে তা স্বার্থক হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ করার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে পারমাণবিক এ বোমা তৈরি করেছিলেন তাঁরা।

১৯৪৫ সালের ১৬ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের নিউ মেক্সিকোর মরুভূমিতে নতুন এ ইতিহাস রচিত হয়। ওই দিন সেখানে প্রথমবার পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা চালানো হয়। এ সফল পরীক্ষা চালায় যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বে এটাই ভয়ংকর প্রাণঘাতী পারমাণবিক অস্ত্রের প্রথম পরীক্ষামূলক ব্যবহারের ঘটনা। এ পরীক্ষা কার্যক্রমের কোড নাম ছিল ‘ট্রিনিটি’। এর মধ্য দিয়ে বিশ্ব পারমাণবিক অস্ত্রের নতুন এক যুগে প্রবেশ করে।

এ পরীক্ষার মাসখানেক পর ৬ আগস্ট জাপানের হিরোশিমা ও ৯ আগস্ট নাগাসাকিতে পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র। নতুন ধরনের এক বিপর্যয় প্রত্যক্ষ করে বিশ্ববাসী।

স্বস্তির সঙ্গে আত্মসমালোচনা

পারমাণবিক বোমার পরীক্ষার পর গবেষক দলের প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল নিজেদের কাজে সাফল্যের স্বস্তি আর মুখে চওড়া হাসি। কিন্তু তারপর খুব দ্রুত তাঁরা যে জিনিস তৈরি করেছিলেন, তা নিয়ে গম্ভীর আত্মচিন্তায় নিমগ্ন হন। এ পরীক্ষাস্থলের সরাসরি তত্ত্বাবধায়নের দায়িত্বে ছিলেন মার্কিন পদার্থবিজ্ঞানী ও ট্রিনিটি প্রকল্পের পরিচালক কেনেথ টম্পকিনস বেইনব্রিজ। বিস্ফোরণের ঢেউ কেটে যাওয়ার পর উঠে দাঁড়িয়ে তিনি এ প্রকল্পের প্রধান বিজ্ঞানী রবার্ট ওপেনহাইমারকে অভিনন্দন জানান।

পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র যে প্রকল্প হাতে নিয়েছিল, তার নাম ছিল ‘ম্যানহাটান প্রজেক্ট’। সেই বোমা তৈরির প্রধান বিজ্ঞানী ছিলেন রবার্ট ওপেনহাইমার। তিনি প্রকৌশলী ও পদার্থবিদদের নিয়ে এমন একটি বোমা তৈরি করেন, যা ‘গ্যাজেট’ নামে পরিচিত ছিল।

পারমাণবিক পরীক্ষা চালানোর পর ব্রেইনব্রিজ এর ধ্বংসের ক্ষমতা দেখে চমকে উঠেছিলেন। তিনি ওপেনহেইমারকে বলছিলেন, ‘নাউ উই অল আর সানস অব বিচেস।’

ওপেনহাইমারও ভগবদ্‌গীতার একটি উক্তি প্রকাশ করেন, ‘এখন আমি মৃত্যু, বিশ্বের ধ্বংসকর্তা হয়ে উঠেছি।’ তবে তিনি ওই সময় এ উক্তি করেছিলেন কি না, এর অবশ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

অন্যদিকে আরেক পদার্থবিজ্ঞানী লরেন্স, যিনি একসময় ওপেনহাইমারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন, কিন্তু পরে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। তিনি ওই ঘটনা স্মরণ করে বলেন, ‘বিস্ফোরণের পরপরই সবার আচরণে গম্ভীরতা নেমে এসেছিল...যেন একধরনের নিঃশব্দ স্তব্ধতা, যা ভক্তির সীমানায় পৌঁছেছিল। তবুও তাঁরা সবাই এ অনুভূতি ভাগ করে নিয়েছিলেন যে আজ আমরা মানব অগ্রগতির এক বিশাল মাইলফলক অতিক্রম করেছি।’

বোমা বিস্ফোরণের পর তৈরি আগুনের গোলা ও মাশরুম আকৃতির মেঘ
ছবি: লস আলমোস ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির সৌজন্যে

পরীক্ষা শুরু আরও আগে

ট্রিনিটি পরীক্ষায় পৌঁছানোর পথ চলা শুরু হয়েছিল প্রায় তিন বছর আগে ১৯৪২ সালে, যখন পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির লক্ষ্যে মিত্রশক্তির একটি প্রকল্প হিসেবে ‘ম্যানহাটান প্রজেক্ট’ গঠিত হয়। এ প্রকল্পের সামরিক প্রধান জেনারেল লেসলি গ্রোভস বৈজ্ঞানিক উন্নয়নের দায়িত্বে লরেন্সকে নিযুক্ত করেন। লরেন্স তাঁর বন্ধু রবার্ট ওপেনহাইমারকে গোপন ল্যাব পরিচালনার প্রস্তাব দেন, যেখানে অস্ত্র তৈরির কারিগরি সমস্যাগুলোর সমাধান করা হবে।

প্রথম পারমাণবিক বোমাটি তৈরির ক্ষেত্রে মূল উপাদান ছিল সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম-২৩৫, তা পাওয়া তুলনামূলকভাবে সহজ ছিল। এর নকশাটি পরিচিত ছিল ‘গান ডিজাইন’ নামে। এখানে একটি সাবক্রিটিক্যাল ইউ-২৩৫ প্লাগকে গুলির মতো করে একটি ফাঁপা সাবক্রিটিক্যাল ইউ-২৩৫ সিলিন্ডারের মধ্যে নিক্ষেপ করা হতো। দুটি অংশ একত্র হলে তারা একটি সুপারক্রিটিক্যাল ভরের সৃষ্টি করত, যা ফিউশন বিক্রিয়ায় ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটাত।

এর জন্য সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম উৎপাদন করা হয়েছিল টেনেসির ওক রিজে লরেন্সের পরিকল্পনায় নির্মিত একটি কারখানায়। কিন্তু সেই উৎপাদনের হার এতই ধীর এবং অল্প ছিল যে কেবল একটি বোমা তৈরির মতো উপাদান সংগ্রহ করা গিয়েছিল। যেহেতু এ বোমার প্রকৌশলগত গঠন ছিল অত্যন্ত সরল, তাই এটি পরীক্ষার প্রয়োজন নেই বলে বিবেচনা করা হয়। একমাত্র ইউরেনিয়ামভিত্তিক সেই বোমাই ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট হিরোশিমায় ফেলা হয়।

প্লুটোনিয়াম-২৩৯ ছিল প্রকল্পে ব্যবহারের জন্য পছন্দের বোমা উপাদান, যা বার্কলেতে গ্লেন সিবোর্গ কর্তৃক আবিষ্কৃত ও পৃথক করা হয়েছিল। এই পি-২৩৯ অপেক্ষাকৃত সহজেই বড় পরিমাণে উৎপাদন করা যেত। তবে সমস্যা ছিল, এটি এতটাই ফিসাইল (বিভাজ্য) ছিল যে গান ডিজাইন কার্যকর হতো না। কারণ, উপাদান দুটি একত্র হওয়ার আগেই এটি প্রি-ডিটোনেট করে ফেলত, ফলে বোমাটি নিষ্ক্রিয় হয়ে যেত।

লস আলামোস ল্যাবে অধিকাংশ গবেষণা কার্যকর প্লুটোনিয়াম বোমা তৈরির ডিজাইন নিয়ে করা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত তারা একটি ইমপ্লোশন মডেল বা ভেতরে বিস্ফোরণের পদ্ধতির নকশায় পৌঁছায়। এর কাঠামো ছিল এমন যে প্লুটোনিয়ামকে একটি ফাঁপা সাবক্রিটিক্যাল গোলক আকারে রাখা হতো। বিস্ফোরণ ঘটাতে বাইরের একটি স্তরে তরমুজের খোসার টুকরার মতো আকৃতির বিস্ফোরক বসানো হতো, যা একযোগে বিস্ফোরিত হয়ে ভেতরের প্লুটোনিয়াম গোলককে চেপে ধরে একটি সলিড সুপারক্রিটিক্যাল বল তৈরি করত।

এই ডিজাইন এতটাই নতুন ছিল যে এটি কাজ করবে কি না, সে বিষয়ে কেউ নিশ্চিত ছিলেন না। এমনকি এটি কত শক্তি উৎপন্ন করবে, তা–ও সম্পূর্ণ পরিষ্কার ছিল না। এমনকি কিছু বিজ্ঞানী আশঙ্কা করেছিলেন, বিস্ফোরণ এতটা তীব্র হতে পারে, এটি বায়ুমণ্ডলকেই আগুনে পুড়িয়ে ফেলবে। যদিও সেই আশঙ্কা পরে জটিল পদার্থবিজ্ঞানের হিসাব দিয়ে খণ্ডন করা হয়। এ নতুন বোমার নকশার চূড়ান্ত ধাপ ছিল একটি পরীক্ষা, যার কোড নাম ছিল ট্রিনিটি।

ট্রিনিটি প্রকল্পে তৈরি গ্যাজেট নামে বম্ব
ছবি: যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দপ্তরের সৌজন্যে

পরীক্ষার স্থান

বেইনব্রিজ আলবুকার্কির প্রায় ২০০ মাইল দক্ষিণে মরুভূমির এক দূরবর্তী এলাকা পরীক্ষার স্থান হিসেবে নির্বাচন করা হয়। কয়েক মাস আগেই সেখানে কিছু অস্থায়ী ঝুপড়ি তৈরি করা হয়েছিল। সেখানেই গবেষণার সবকিছু ঠিকঠাক করা হয়। পদার্থবিদ ইমিলিও সেগ্রে ওই স্থানের কথা স্মরণ করে বলেন, এমন এক স্থানে গোপন গবেষণা চালানো হয়েছিলে, সেখানে বিচ্ছুতে ভরে গিয়েছিল। সেখানে থাকা গবেষক দলটি কাজ করছিল চরম গোপনীয়তা ও তীব্র চাপের মধ্যে। সারা দিন কাজ করা ছাড়া আর তাদের কিছু করার ছিল না।

এ পরীক্ষার সঙ্গে যেসব পর্যবেক্ষক যুক্ত ছিলেন, তাঁরা সম্ভবত ইতিহাসে কোনো পরীক্ষাগারে পরীক্ষার জন্য একত্র হওয়া সবচেয়ে বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের দল। তাঁদের আটজন নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। অবশ্য এ তালিকায় ওপেনহাইমার ছিলেন না। যদিও তিনি ছিলেন তাঁর সময়ের অন্যতম প্রতিভাবান পদার্থবিদ।

পরীক্ষার কেন্দ্রে ছিল মূলত একটি ১০০ ফুট উঁচু স্টিলের টাওয়ার, যেখান থেকে গ্যাজেট নামের বোমাটি ঝুলিয়ে রাখা হয়। এর কোর বা কেন্দ্রীয় অংশটি লস আলামোস থেকে সশস্ত্র পাহারায় ১৩ জুলাই আনা হয় এবং পরদিন সেটি টাওয়ারে উত্তোলন করা হয়।

বেসক্যাম্পটি ছিল টাওয়ার থেকে প্রায় ১০ মাইল দূরে। বিজ্ঞানী ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ভিড়ে মুখর ছিল এলাকাটি। তাঁদের অনেককে পাঠানো হয় কম্পানিয়া হিল নামের একটি পর্যবেক্ষণ পোস্টে, যা একটি ধূলিময়, ১০ মাইল দীর্ঘ ও ৩ ঘণ্টার যাত্রাপথ। সেখানে লরেন্স তাঁর কয়েকজন সহকর্মীর সঙ্গে দেখা করেন, যাঁদের মধ্যে ছিলেন তরুণ পদার্থবিদ রিচার্ড ফাইনম্যান, যিনি রেডিও তরঙ্গ বিশ্লেষণ করেন।

পারমাণবিক বোমা পরীক্ষার আগের দিন ট্রিনিটি পরীক্ষার স্থানে ব্যাপক মেঘ দেখা দেয়। শুরু হয় ঝড়। সে সন্ধ্যায় পদার্থবিদ ইমিলিও সেগ্রে স্মরণ করেন,‘একটি অবিশ্বাস্য শব্দ আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল, যার প্রকৃতি আমি কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না। শব্দটি থামছিল না...আমি টর্চ নিয়ে বাইরে বেরিয়ে দেখি, শত শত ব্যাঙ একটি বড় জলভরা গর্তে মিলনে ব্যস্ত।’

ঝড়ের কারণে পরীক্ষার সময় পরিবর্তন করে ভোর ৪টা থেকে পিছিয়ে ৫টা ৩০ মিনিট করা হয়। সময় কাটাতে পর্যবেক্ষকেরা বিস্ফোরণের শক্তি নিয়ে বাজি ধরছিলেন। সানট্যান মুখে লোশন মাখাচ্ছিলেন আর সুরক্ষার জন্য চশমা নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলেন। বেসক্যাম্পে থাকা পর্যবেক্ষকদের নির্দেশ দেওয়া হয়, যেন তাঁরা উপুড় হয়ে শুয়ে পড়েন, পায়ের দিক ঘুরিয়ে রাখেন টাওয়ারের দিকে এবং চোখ ঢেকে রাখেন হাত দিয়ে, যাতে বিস্ফোরণের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা পান।

জেনারেল গ্রোভস স্মরণ করেন, ‘আমরা এমন কিছু অজানা বিষয়ের মুখোমুখি ছিলাম, যা মানুষের অভিজ্ঞতা ও চিন্তার বাইরে। আমাদের কেবল কল্পনা করতে হতো, কী কী ঘটতে পারে।’

রবার্ট অপেনহাইমার (বাঁয়ে) ও ম্যানহাটান প্রকল্পের প্রধান জেনারেল লেসলি গ্রোভস ট্রিনিটি পরীক্ষাস্থলে ১০০ ফুট উঁচু টাওয়ারের ধ্বংসাবশেষের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন, যেখানে পরীক্ষামূলক বোমাটি রাখা হয়েছিল
ছবি : মার্কিন জ্বালানি বিভাগ

ক্ষণ গণনা

পদার্থবিদ বয়েস ম্যাকড্যানিয়েল বলেন, এরপর শুরু হলো শেষ মুহূর্তের কাউন্টডাউন বা ক্ষণ গণনা। অবশেষে এক বিশাল উজ্জ্বল গোলক বিস্ফোরণের পর দেখা দিল একটি দাউদাউ করা কমলা রঙের আগুনের গোলা, যা সমতল পেরিয়ে ওপরে উঠতে থাকে।

বিস্ফোরণের মুহূর্তে বেইনব্রিজ বলেন, ‘আমি আমার ঘাড়ের পেছনে তাপ অনুভব করলাম, অস্বস্তিকরভাবে গরম। শেষে আমি গগলস খুলে দেখলাম, আগুনের গোলা দ্রুত ওপরে উঠছে। এটি ঘিরে ছিল এক বিশাল বেগুনি-স্বচ্ছ বাতাসের মেঘ, যা বোমা ও এর ফিউশন পণ্যের বিকিরণে তৈরি হয়েছিল। যাঁরা তা দেখেছিলেন, কেউই তা ভুলতে পারেননি—এক ভয়ংকর ও বিস্ময়কর দৃশ্য।’

ওই সময় ট্রিনিটিতে সামরিক টেকনিশিয়ান হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ও পরে নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী ভ্যাল ফিচ বলেন, ‘দেখা গেল, বাঙ্কারের দরজায় থাকা সামরিক পুলিশকে কেউই বলে দেননি, কী হতে যাচ্ছে। সে একেবারে ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল, চোখেমুখে চরম আতঙ্কের ছাপ। সে দরজার সামনে থেকে সরে এসে আমার পাশে দাঁড়াল এবং বিস্ফোরণ দেখল। আমি শুধু মনের কথা বলে ফেললাম, ‘যুদ্ধ খুব শিগগির শেষ হবে।’

এ কথা সত্য ছিল, যুদ্ধ শিগগিরই শেষ হয়েছিল। তবে পারমাণবিক অস্ত্রকে ঘিরে লড়াই তখনো শেষ হয়নি।

রাজনীতি

প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান যখন বার্লিনের পাশের পটসডামে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল ও সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্তালিনের সঙ্গে বৈঠক করছিলেন, সে সময় তিনি পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা সফল হয়েছে বলে খবর পান। পরে ট্রুম্যান স্মরণ করেন, তিনি স্তালিনকে বলেছিলেন, ‘আমাদের কাছে এক নতুন ধরনের অসাধারণ ধ্বংসের ক্ষমতাসম্পন্ন অস্ত্র এসেছে।’

স্তালিন শুধু বলেছিলেন, ‘শুনে ভালো লাগল। আশা করি, জাপানিদের বিরুদ্ধে ভালোভাবে ব্যবহার করতে পারবেন।’

যুদ্ধের পর ওপেনহাইমার পারমাণবিক প্রযুক্তিকে আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণে আনার একটি আন্দোলন শুরু করেন। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে উত্তেজনাপূর্ণ স্নায়ুযুদ্ধ শুরুর পর সে উদ্যোগ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। হিরোশিমা ও নাগাসাকির পর যুক্তরাষ্ট্রের পদার্থবিদেরা জাতির চোখে নায়ক হিসেবে স্বীকৃতি পান। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের এ কৃতিত্বের ভয়াবহ বাস্তবতা ধীরে ধীরে উপলব্ধি হতে শুরু করে। এ উপলব্ধি আরও গভীর হয়, যখন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান হাইড্রোজেন বোমা তৈরির প্রকল্প চালুর সিদ্ধান্ত নেন। এ সিদ্ধান্ত পদার্থবিদদের সমাজকে দুই ভাগে ভাগ করে দেয়।

ম্যানহাটান প্রকল্পে কাজ করার নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। তবে ওই সময় সবার লক্ষ্য ছিল হিটলারকে হারানো, বিশেষ করে তাঁর হাতে পারমাণবিক বোমা যাতে না পৌঁছে, সে উদ্দেশ্যে আগে তৈরি করা। কিন্তু পরে দেখা যায়, হিটলার ওই সক্ষমতা অর্জন করতে পারেননি।

তবে ওপেনহাইমার আগে থেকেই যে আশঙ্কা করেছিলেন, তা ধীরে ধীরে বাস্তব হয়ে ওঠে—অসংযতভাবে তৈরি হতে থাকে একের পর এক ভয়াবহ শক্তিশালী অস্ত্র। এ অস্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতায় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষাক্ত হতে শুরু করে। এর ধারাবাহিকতা এখনো চলছে। এতে মানবজাতির ভবিষ্যৎ আরও অনিশ্চিত ও বিপন্ন হয়ে উঠেছে।

তথ্যসূত্র: লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস, নিউইয়র্ক টাইমস