যুক্তরাষ্ট্রে যে সংঘাত থেকে শুরু হয় স্বাধীনতা সংগ্রাম

যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা দিবস আজ, ৪ জুলাই। ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে এদিন স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতাকামী নেতারা। সেই দিন ধরে আমাদের আজকের আয়োজন।

যুক্তরাষ্ট্রে ৪ জুলাই স্বাধীনতা দিবসের প্যারেডফাইল ছবি: রয়টার্স

আজ থেকে ২৪৯ বছর আগে এই দিনে শোষণের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে নিজেদের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন (ডিক্লারেশন অব ইনডিপেনডেন্স) তৎকালীন ১৩টি ব্রিটিশ উপনিবেশের প্রতিনিধিরা, জন্ম হয় এক নতুন রাষ্ট্রের। সময়ের পরিক্রমায় তারাই আজকের পৃথিবীর সবচেয়ে প্রভাবশালী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে।

বলছি যুক্তরাষ্ট্রের কথা। ১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই, যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ার এক বৈঠকে তৎকালীন ১৩টি ব্রিটিশ উপনিবেশের প্রতিনিধিরা একজোট হয়ে ঘোষণা দিলেন, তাঁদের স্বাধীনতা চাই। এ ঘোষণাপত্র শুধু একটি কাগজ ছিল না; বরং ছিল একটি জাতির আত্মপরিচয় প্রকাশের সূচনা। ইতিহাসের পাতায় ওই ঘোষণাপত্র ‘ডিক্লারেশন অব ইনডিপেনডেন্স’ নামে পরিচিত।

মার্কিনরা বিপুল উৎসব আয়োজনে ৪ জুলাই নিজেদের স্বাধীনতা দিবস উদ্‌যাপন করেন। জাতীয় পতাকা উত্তোলন, জাতীয় সংগীত, আতশবাজি, প্যারেড, বারবিকিউ পার্টি আর দেশাত্মবোধক গানে-স্লোগানে দিনটি উদ্‌যাপন করা হয়। আয়োজনে কোনো কিছুর কমতি থাকে না।

তবে ৪ জুলাই মার্কিনদের জন্য শুধু স্বাধীনতা উদ্‌যাপনের দিন নয়; বরং পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতার এ ঘোষণাপত্র ঘিরে দ্বন্দ্ব আর প্রতিজ্ঞার ইতিহাসের কারণে অনেক মার্কিন এটি আত্মসমালোচনার দিনও মনে করেন।

যেখান থেকে জ্বলে ওঠে বিপ্লবের আগুন

১৭৭৫ সালের দিকে আটলান্টিক উপকূলে উত্তর আমেরিকায় উপনিবেশগুলোয় ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রবল ক্ষোভ জন্ম নিতে শুরু করে। কর আরোপে অনিয়ম, ব্রিটিশ সরকারে উপনিবেশগুলো থেকে কোনো প্রতিনিধি না থাকা, ব্রিটিশ সেনাদের দমনমূলক উপস্থিতি—সব মিলিয়ে উত্তেজনা চরমে ওঠে।

১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই, যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ার এক বৈঠককক্ষে তৎকালীন ১৩টি ব্রিটিশ উপনিবেশের প্রতিনিধিরা একজোট হয়ে ঘোষণা করলেন, তাঁদের স্বাধীনতা চাই। সেই থেকে ৪ জুলাই মার্কিনদের স্বাধীনতা দিবস। তবে দিনটি মার্কিনদের কাছে শুধু উদ্‌যাপনের দিন নয়; বরং স্বাধীনতার এ ঘোষণাপত্র ঘিরে দ্বন্দ্ব আর প্রতিজ্ঞার ইতিহাসের কারণে দেশটির অনেক নাগরিক একে আত্মসমালোচনার দিনও মনে করেন।

‘প্রতিনিধিত্ব ছাড়া কর আদায় নয়’ স্লোগানে মুখর হয় তখনকার বোস্টন থেকে ভার্জিনিয়া। উপনিবেশবাসীর দাবি, প্রতিনিধি না থাকায় তাঁরা ব্রিটিশ আইন ও করনীতি প্রণয়নে কোনো মতামত দিতে পারেন না। তাঁদের ওপর ইচ্ছেমতো করের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, যা অন্যায়।

উপনিবেশগুলোয় ব্রিটিশ শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে যখন ক্ষোভ দানা বাঁধছে, সে সময়ে ১৭৭৫ সালের এপ্রিল মাসে লেক্সিংটন ও কনকর্ডে ব্রিটিশ সরকারের পাঠানো সৈন্যদলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের মিলিশিয়াদের রক্তক্ষয়ী সংঘাত হয়। সেখান থেকেই সূচনা হয় এক গণ-অভ্যুত্থানের, অল্প দিনের মধ্যে যা স্বাধীনতার সংগ্রামে রূপ নেয়।

টমাস জেফারসনের হাতে লেখা যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের (ডিক্লারেশন অব ইনডিপেনডেন্স) খসড়া
ছবি: লাইব্রেরি অব কংগ্রেসের ওয়েব পাতা থেকে নেওয়া

স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র

লেক্সিংটন ও কনকর্ডে সেই রক্তাক্ত অধ্যায়ের পর এক বছরের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র গৃহীত হয় কন্টিনেন্টাল কংগ্রেসে।

ঘোষণাপত্রটির খসড়া তৈরি করেছিলেন টমাস জেফারসন, জুন মাসে তিনি খসড়া ঘোষণাপত্র তৈরির কাজ শুরু করেছিলেন। সে সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র ৩৩ বছর। জেফারসনের খসড়া ঘোষণাপত্রটি পড়ার পর তা নিয়ে বিতর্ক হয়, সেটির পরিমার্জন হয় ও অবশেষে সেটিতে সই করেন কন্টিনেন্টাল কংগ্রেসের প্রতিনিধিরা।

তবে সব প্রতিনিধি কিন্তু ৪ জুলাই ঘোষণাপত্রে সই করেননি; বরং বেশির ভাগ প্রতিনিধি দুই দিন আগে, অর্থাৎ ২ জুলাই ঘোষণাপত্রে সই করেছিলেন। কারণ, কন্টিনেন্টাল কংগ্রেস প্রথম যে দিনকে স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য বেছে নিয়েছিল, সেটি কিন্তু ৪ জুলাই ছিল না; বরং ২ জুলাই তারা স্বাধীনতা ঘোষণার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।

তবে কেন তা দুই দিন পিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তার উত্তর হলো, ২ জুলাই স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য প্রস্তুত প্রথম ঘোষণাপত্রটির প্রতিটি অক্ষর, শব্দ ও বাক্য পরবর্তী দুই দিন ধরে সম্পাদনা করা হয়। সংশোধিত ও পরিমার্জিত খসড়াটি সঠিক ও চূড়ান্ত বলে গৃহীত হয় ৪ জুলাই। এভাবেই ‘ডিক্লারেশন অব ইনডিপেনডেন্স’–এর মাধ্যমে ৪ জুলাই পৃথিবীর ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন হয়ে যায়।

তবে পরিমার্জিত সেই দলিলও নিখুঁত ছিল না। জেফারসনের খসড়ায় দাসপ্রথার সমালোচনা ছিল, যেখানে ব্রিটিশ রাজাদের দাস ব্যবসার জন্য দায়ী করা হয়েছিল। কিন্তু দক্ষিণের উপনিবেশগুলোর আপত্তিতে সেই অংশ বাদ দেওয়া হয়।

এ ছাড়া দলিলটিতে আদিবাসীদের নিয়ে লেখা হয়েছিল ‘নির্দয় ভারতীয় বর্বর’, যা আজকের দৃষ্টিতে বর্ণবাদী ও অবমাননাকর ভাষা হিসেবে বিবেচিত।

নারীদের বিষয়েও ঘোষণাপত্রে কোনো উল্লেখ ছিল না। সেখানে লেখা ছিল, ‘অল মেন আর ক্রিয়েটেড ইকুয়াল’ বা সব মানুষ সমানভাবে সৃষ্টি। এখানে সব মানুষ বোঝাতে ‘মেন’ শব্দের ব্যবহার নিয়ে অনেকেই আপত্তি তোলেন।

স্বাধীনতার ঘোষণা থামাতে পারেনি যুদ্ধ

১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই স্বাধীনতার ঘোষণা এলেও ব্রিটেন তা স্বীকার করেনি; বরং একে রাষ্ট্রদ্রোহ বলে বিবেচনা করে আরও কঠোর হয়ে তা দমনের অভিযান শুরু করে, লড়াই তীব্রতর হয়।

১৭৭৬ থেকে ১৭৮৩—এই সাত বছর ধরে চলে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার সংগ্রাম। এ যুদ্ধে ফ্রান্স, স্পেন ও ডাচ প্রজাতন্ত্র (আজকের নেদারল্যান্ডস) যুক্তরাষ্ট্রের পাশে দাঁড়ায়। এতে যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়।

১৭৮১ সালে ইয়র্কটাউনে ব্রিটিশ সেনারা পরাজিত হলে কার্যত যুদ্ধ শেষ হয়। পরবর্তী দুই বছর চলে শান্তি আলোচনা। অবশেষে ১৭৮৩ সালে প্যারিস চুক্তির মাধ্যমে ব্রিটেন যুক্তরাষ্ট্রকে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেয়।

এটি যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের প্রথম মুদ্রিত সংস্করণ
ছবি: লাইব্রেরি অব কংগ্রেসের ওয়েব পাতা থেকে নেওয়া

সেদিনের ঘোষণাপত্রে সত্যিই কি সব মানুষের সমান মর্যাদা নিশ্চিত হয়েছিল

ব্যাপক আলোচনা, সংশোধন ও পরিমার্জনের পরও সেদিনের সেই ‘ডিক্লারেশন অব ইনডিপেনডেন্স’-এ অনেক কমতি-খামতি থেকে যায়। সব মানুষের সমান মর্যাদা নিশ্চিত করতে প্রায় দুই শতাব্দী ধরে নানা ধাপে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের সংশোধনী আনা হয়েছে।

১৮৬৫ সালে ত্রয়োদশ সংশোধনীতে দাসপ্রথা নিষিদ্ধ হয়। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে নারীরা ভোটাধিকার পেয়েছেন ১৯২০ সালে। চার বছর পর ১৯২৪ সালে আদিবাসীদের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। বর্ণবৈষম্যবিরোধী আইন কার্যকর হয় ১৯৬৪ সালে। বলা যায়, ঘোষণাপত্রের প্রতিশ্রুতি পরবর্তী দুই শতাব্দী ধরে লড়াইয়ের মাধ্যমে ধীরে ধীরে বাস্তবায়িত হয়েছে।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যেভাবে উদ্‌যাপনের রং বদলেছে

১৭৭৭ সালে ফিলাডেলফিয়ায় প্রথম স্বাধীনতা দিবস উদ্‌যাপিত হয়—১৩টি তোপধ্বনি, ব্যান্ড, আতশবাজি ও দেশাত্মবোধক সংগীতে মুখর ছিল শহর। ১৮৭০ সালে এটি ফেডারেল ছুটি (তবে বেতনবিহীন) হিসেবে স্বীকৃতি পায় আর ১৯৪১ সালে হয় সবেতন ফেডারেল ছুটি।

যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের চিরন্তন প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ‘স্ট্যাচু অব লিবার্টি’
ছবি : রয়টার্স

প্রথম দিকে ৪ জুলাই মানে ছিল প্রার্থনা ও রাজনৈতিক বক্তৃতা। আজ সেটি হয়ে উঠেছে জাতীয় উৎসব—আতশবাজি, কনসার্ট, প্যারেড, পারিবারিক মিলনমেলা আর মার্কিন পতাকায় মোড়া জনজোয়ার।

১৮৮৬ সালে স্বাধীনতার শতবর্ষে ফ্রান্স যুক্তরাষ্ট্রকে উপহার দেয় ‘স্ট্যাচু অব লিবার্টি’, যা আজও যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের চিরন্তন প্রতীক।

১৯৭৬ সালের দ্বিশতবার্ষিকীতেও উদ্‌যাপন ছিল নজিরবিহীন—ওয়াশিংটন ডিসিতে কুচকাওয়াজ, নিউইয়র্ক বন্দরে টাল শিপ উৎসব আর দেশের প্রতিটি শহরে উৎসবমুখর পরিবেশে দিনটি উদ্‌যাপন করা হয়।

‘সব মানুষ সমানভাবে সৃষ্টি’—এ চেতনায় যে দেশের জন্ম হয়েছিল, প্রায় আড়াই শতক পর সেই আদর্শ পৃথিবীর নানা প্রান্তে ভূলুণ্ঠিত হতে দেখা যাচ্ছে। গাজা উপত্যকায় হাজার হাজার নিরীহ ফিলিস্তিনি নারী-পুরুষ-শিশু হত্যায় মৌন সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। তাই মনে প্রশ্ন জাগে—স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের আদর্শ কি তবে কেবল মার্কিনদের জন্যই প্রযোজ্য?

তথ্যসূত্র: লাইব্রেরি অব কংগ্রেস ও ইউএস ন্যাশনাল আর্কাইভ থেকে নেওয়া